বাঘের ওপর টাগ

প্রভাষ আমিন

সাদা চোখে দেখলে মনে হবে, গণমাধ্যমই সবচেয়ে শক্তিশালী, গণমাধ্যমই বুঝি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লিখছে, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে লিখছে, গডফাদারদের বিরুদ্ধে লিখছে, র‌্যাবের বিরুদ্ধে লিখছে, পুলিশের বিরুদ্ধে লিখছে। মহাপরাক্রমশালী। এরকমটাই হওয়ার কথা, এরকমটাই হওয়া উচিত। গণমাধ্যম যা সত্য তাই তুলে ধরবে। সকল অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। কিন্তু সবসময় কি এটা করা যায়? আমরা যারা ভেতর থেকে দেখি, তারা জানি, আসলে যায় না। প্রকাশিত অনেক সংবাদের পেছনেই অনেক অন্ধকার কার্যকারণ থাকে। অনেক স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। স্বার্থের কারণে যেমন অনেক সংবাদ প্রকাশিত হয়, তেমনি আবার অনেক সংবাদ গিলেও ফেলা হয় এমন স্বার্থের কারণেই।

গণমাধ্যম যেমন অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। তেমনি গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিতও হয়। আমি সরকার বা এজেন্সির নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি না। এই বিবেচনায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন যথেষ্ট স্বাধীনতা উপভোগ করছে। কিন্তু গণমাধ্যমেরও আরো অনেক নিয়ন্ত্রক আছে। প্লিজ অবিশ্বাসে চমকে উঠবেন না। সাথেই থাকুন, আজ সেই বাঘের ওপর টাগের গল্প শোনাবো আপনাদের। গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রক এক-দুজন নয়, অনেক। মূল নিয়ন্ত্রণ বিজ্ঞাপনদাতাদের হাতে। এছাড়া প্রিন্ট মিডিয়া জিম্মি এজেন্ট আর হকারদের হাতে। আর ইলেকট্রনিক মিডিয়া জিম্মি ক্যাবল অপারেটর আর টিআরপি প্রণেতাদের হাতে।

বিজ্ঞাপনের ওপর গণমাধ্যমের নির্ভরতাটা বোধগম্য। প্রিন্ট মিডিয়ায় তবু পত্রিকা বিক্রি করে কিছু টাকা আসে। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আয়ের একমাত্র উৎস বিজ্ঞাপন। তবে পত্রিকা বিক্রি করে যে টাকা আসে তা দিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়। কারণ ১০ টাকা দামের একটি পত্রিকা বিক্রি করে কমিশন বাদ দিয়ে নানা হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের হাতে আসে ৫/৬ টাকা, তাও ঢাকার বাইরের অনেক জায়গার টাকা কখনো পাওয়াই যায় না। অথচ এখন একটি পূর্ণাঙ্গ দৈনিকের প্রতি কপির উৎপাদন খরচ ১৫ টাকার ওপরে। তারমানে প্রতি কপি পত্রিকা বিক্রি হলেই অন্তত ১০ টাকা লস। তাই যত বেশি পত্রিকা বিক্রি হবে, তত বেশি লস হবে। এ কারণেই অনেক পত্রিকা লস কমাতে চাহিদার চেয়ে অনেক কম ছাপে। এই লস পোষানোর একমাত্র উপায় বিজ্ঞাপন। তাই যেকোনো পত্রিকাকে টিকে থাকতে হলে বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করতেই হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে এই নির্ভরতা ষোলআনা। কারণ দর্শকরা টিভি দেখতে পান বিনা পয়সায়। তাই পুরো খরচ তুলতে হয় বিজ্ঞাপন থেকে।

আগে গণমাধ্যমের সাথে বিজ্ঞাপনদাতাদের পারস্পরিক সম্পর্কটা ছিল দ্বি-পাক্ষিক ও ভদ্রজনোচিত। কিন্তু প্রতিদ্বন্দি¦তা বেড়ে যাওয়ায় বিজ্ঞাপনদাতারা এখন গণমাধ্যমের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভুতের মতো চেপে বসেছে। আগে বিজ্ঞাপনের ডিজাইন হতো পত্রিকার চাহিদা অনুযায়ী, মাপ হতো কলাম-ইঞ্চিতে। এখন পুরো বিষয়টি উল্টে গেছে। এখন পত্রিকার মেকআপ হয় বিজ্ঞাপনের ডিজাইন অনুযায়ী। কখনো কখনো পত্রিকার প্রথম পাতার একটা বড় অংশ চলে যায় বিজ্ঞাপনের দখলে। মাঝে মাঝে এমনও হয়, পত্রিকার প্রথম পাতায় কোনো সাবানের সুন্দরী মডেলের ছবি ছাপা হয়। আর সেই সুন্দরীর চুলের ভাজে দুই লাইন, কানের আড়ালে চার লাইন, ঘাড়ের ফাঁকে পাঁচ লাইন নিউজ চলে যায়। সুন্দরী মডেলের শরীরের ভাজে ভাজে পাঠককে পড়তে হয়, মর্মান্তিক লঞ্চ দুর্ঘটনার নিউজ। এছাড়া এল সেপ, আই সেপ, বাকা-ত্যাড়া নানা ডিজাইনের বিজ্ঞাপনের অত্যাচার পাঠককে সইতে হয়।

ইদানীং দৈনিক পত্রিকায় জ্যাকেট বিজ্ঞাপন বেশ প্রচলিত প্রবণতা। প্রথম ও শেষ পাতায় লোগোর নিচে পুরোটাই বিজ্ঞাপন। পাঠক নিউজ পায় তিনের পাতায় গিয়ে। প্রথম এই বিস্ময়কর ও অভিনব এই বিজ্ঞাপনের অত্যাচার দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এ নিয়ে কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের সাথে কথাও বলেছি। তারা বলেছেন, এমন উদাহরণ উন্নত বিশ্বেও আছে। তাদের এই যুক্তিতেও একজন পাঠক হিসেবে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। উন্নত বিশ্বে অনেক কিছুই আছে, সবকিছুই কি আমাদের অন্ধের মতো অনুসরণ করতে হবে। আর উন্নত বিশ্ব একটি বাজে উদাহরণ তৈরি করলে তা আমাদের মেনে নিতে হবে কেন? যে পত্রিকাটি নিজেদের বাংলাদেশে এই জ্যাকেট বিজ্ঞাপন চালু করেছিল, অন্যদের কথা জানি না, অন্তত তাদের আর্থিক সামর্থ্য ছিল সেই বিজ্ঞাপনটি ফিরিয়ে দেওয়ার। কিন্তু সর্বগ্রাসী লোভ আমাদের ভালোমন্দের বোধটাই নষ্ট করে দিয়েছে। ইদানীং মলাট বা জ্যাকেট বিজ্ঞাপনে যে কন্টেন্ট ছাপা হয়, তা তৈরি করেন সেই পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদকেরা। তারা সেই পত্রিকার চাকরি করেন না বিজ্ঞাপনদাতার, বোঝা মুশকিল।

ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের এই অত্যাচার আরো বেশি। মানুষ এখন অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখে না, বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে নাটক দেখে। বিশেষ বিশেষ উৎসবে বিজ্ঞাপনের অত্যাচার এত বেড়ে যায় যে নাটক বা অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতাই ভুলে যাওয়ার দশা হয়। নাটক, সিনেমা বা অনুষ্ঠান যত ভালো; বিজ্ঞাপনের অত্যাচার তত বেশি। একটি অনুষ্ঠানের মাঝে সর্বোচ্চ কত মিনিট বিজ্ঞাপন বিরতি থাকবে, তার কোনো মানদণ্ড নেই। হয়তো আছে, আমি জানি না। থাকলেও তা ফলো করা হয় না। বিজ্ঞাপন না পেলে বিরতি ৪ মিনিট, পেলে ১৫ মিনিট পর্যন্ত হয়ে যায়। এরপরও যে দর্শকরা আমাদের টিভি দেখেন, তাতেই আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এখন যেহেতু অনেকে চ্যানেল, দর্শকের হাতে আছে রিমোট কন্ট্রোল, তাই অনেক চালাক দর্শক বিজ্ঞাপন শুরু হলেই চ্যানেল বদলে ফেলেন। আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হলে কয়েক মিনিট পর আবার ফিরে আসেন, নইলে অন্য চ্যানেলে ভালো অনুষ্ঠান খোঁজেন। দর্শকদের চেয়ে বিজ্ঞাপনদাতারা আরো চালাক। তারা এখন শুধু বিরতিতে নয়, অনুষ্ঠানের ওপরই বিজ্ঞাপন চাপিয়ে দেন। ইদানিং হঠাৎই টিভির পর্দা ছোট হয়ে যায়, এল সেপে ভেসে ওঠে বিজ্ঞাপন। এছাড়া পর্দার কোণায় কোণায় থাকে নানা বিজ্ঞাপন, সারাক্ষণই ঘুরতে থাকে বিজ্ঞাপনের গ্রাফিক্স। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ বা বিজ্ঞাপনদাতারা দর্শকদের চোখের প্রশান্তির বিষয়টি মাথায়ই রাখেন না।

টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠান তৈরি করেন দর্শকদের কথা মাথায় রেখে নয়, বিজ্ঞাপনদাতাদের কথা মাথায় রেখে। প্রথম কথা হলো, অনুষ্ঠানটি বিক্রি হতে হবে। অনুষ্ঠান যতই ভালো হোক, বিক্রি না হলে তার কোনো দাম নেই। এখন অতি চালাক বিজ্ঞাপনদাতারা আবার নাটক বা সিনেমার মাঝে তার পণ্য ঢুকিয়ে দেন। যেমন নাটক বা সিনেমায় ক্লান্ত নায়ক হয়তো কোনো এনার্জি ড্রিংকে চুমুক দিচ্ছেন। সেই ড্রিংকসটি হবে পূর্বনির্ধারিত, বিজ্ঞাপনদাতার পছন্দের। তার মানে বিজ্ঞাপন আপনাকে দেখতেই হবে। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। এক ছেলে কিছুতেই ঔষধ খেতে চায় না। তবে মিষ্টি তার খুব পছন্দ। তো সেই ছেলের মা রসগোল্লার ভেতরে ট্যাবলেটটি ঢুকিয়ে দিলেন, যাতে ছেলে মিষ্টির লোভে হলেও ট্যাবলেটটি খেয়ে ফেলে। পরে মা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা মিষ্টি খেয়েছো? ছেলে বললো, হ্যাঁ মা, খেয়েছি। তবে মিষ্টির বিচিটা ফেলে দিয়েছি। কিন্তু চালাক বিজ্ঞাপনদাতারা এমনভাবে অনুষ্ঠানে তার পণ্যেও প্রচারণা ঢুকিয়ে দেন যে আমরা চাইলেও মিষ্টির বিচিটা আলাদা করতে পারি না।

তবে সবচেয়ে বিপদজনক হলো নিউজ বিক্রি করে দেওয়া। প্রায় সব টিভির সংবাদ শিরোনাম কোনো না কোনো ব্যাংক বা টেলিফোন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা। এখন বিপদটা হলো, সেই বুলেটিনে স্পন্সর ব্যাংক বা কোম্পানির বিপক্ষে কোনো নিউজ থাকে তাহলে কী হবে? এ ধরনের স্বার্থের সংঘাত ঘটছে অহরহই। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে স্পন্সর কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো নিউজ থাকলে তা ড্রপ করা হয়। আর নিতান্তই ড্রপ করা সম্ভব না হলে লো ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়। শুধু সংবাদ শিরোনাম নয়, নিউজ বুলেটিনে নানা সেগমেন্ট তৈরি করা হয় বিজ্ঞাপনদাতাদের চাহিদা অনুযায়ী। কত বেশি বিক্রিযোগ্য পণ্য আপনি তৈরি করতে পারবেন, তাতেই ব্যস্ত থাকে সব সৃজনশীলতা। কোনো কোনো টিভির একটি বুলেটিনে অন্তত ৮/১০টি স্পন্সরড সেগমেন্ট থাকে। একটি টেলিভিশনেই ব্যবসার সংবাদ, বাণিজ্য সংবাদ, অর্থনীতির খবর, শেয়ারবাজারের খবরÑএমন বাহারি সব সেগমেন্ট থাকে। ঘুরেফিরে সব একই। কিন্তু শুধু বিক্রি করার জন্যই আলাদা আলাদা নাম। এই অতি বিজ্ঞাপন নির্ভরতার কারণে প্রায়শই সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা ক্ষুণ্ন হয়, সত্যি কথা বলা যায় না।

উন্নত বিশ্বে আপনি যত টাকাই থাকুক কোনো নির্দিষ্ট ড্রিংকস খেলে টলার, স্ট্রংগার, শার্পার হয়ে যাবেন; এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবেন না, যদি সেটা সত্যি না হয়। তার মানে প্রচারিত বা প্রকাশিত বিজ্ঞাপনও বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে টাকা থাকলে যা ইচ্ছা তাই প্রচার করা যায়। কিন্তু এটা হওয়া উচিত নয়। আগে পত্রিকায় চিঠিপত্র কলামে লেখা থাকতো ‘মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়’। এখন অনেক পত্রিকাতেই এটা লেখা থাকে না। তার মানে পত্রিকায় যা কিছু ছাপা হয় তার সবকিছুর দায়-দায়িত্ব সেই পত্রিকাকেই নিতে হবে। আসলে বিজ্ঞাপনও এক ধরনের নিউজ। বিজ্ঞাপন থেকেও মানুষ তথ্য সংগ্রহ করে। এক সময় ইত্তেফাকে বিজ্ঞাপন দেখে মানুষ সিনেমা দেখার সিদ্ধান্ত নিতো। অনেক সাধারণ মানুষ বিজ্ঞাপন আর নিউজের পার্থক্যটা ধরতে পারে না। আমি অনেক মানুষকে তর্ক করতে দেখেছি, আমি অমুক পত্রিকায় এটা দেখেছি। কিন্তু সেই পত্রিকায় তিনি বিজ্ঞাপন দেখেছেন। অনেক বড় বড় পত্রিকায় নানা রকমের বিজ্ঞাপন ছেপে অনেকে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করেন। সাধারণ মানুষ বড় পত্রিকায় ছাপা দেখে নিশ্চিন্তে যোগাযোগ করে প্রতারিত হন। সেই পত্রিকা কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনের দায়িত্ব নেয় না। তাই অন্তত বড় বড় পত্রিকাগুলোর উচিত বিজ্ঞাপন ছাপার আগে বিজ্ঞাপনদাতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া।

তবে বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে সবচেয়ে বিপদজনক দিক হলো, গণমাধ্যমের ওপর বিজ্ঞাপনদাতাদের খবরদারি বা নিয়ন্ত্রণ। যেই সাইজে বা যেভাবে দেওয়া হয় সেভাবে তো ছাপতে হয়ই, এমনকি পুরো পত্রিকা আড়াল করে হলেও। তারপরও বিজ্ঞাপনদাতারা যা বলে তাই শুনতে হয়। তাদের বিরুদ্ধে কোনো নিউজ ছাপা যায় না। বিজ্ঞাপনদাতারা যাই করে তাই নিউজ, তাই ছাপতে হয়। অনেক বড় বড় পত্রিকা বা টিভিতে এমন অনেক নিউজ ছাপা হয় বা প্রচার হয়, যার কোনো সংবাদমূল্য নেই। পঞ্চগড়ের কোন উপজেলায় কোন ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ওপেন হলো, তা নিয়ে পাঠকদের কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু সেই ব্যাংক যদি বিজ্ঞাপনদাতা হয়, তাহলে সেই সংবাদটি অবশ্যই ছাপতে বা প্রচার করতে হবে। যা ছাপা হয়, তারচেয়ে বিপদজনক যা ছাপা যায় না, তা। বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানিগুলো ভালো কিছু করলে অবশ্যই ছাপতে হবে, তার সংবাদমূল্য থাকুক আর নাই থাকুক। কিন্তু খারাপ কিছু করলে তা কোথাও ছাপা হয় না। মাঝে মাঝে অনেক বড় নিউজ হয়ে গেলেই শুধু তার ব্যতিক্রম ঘটে। তখন সেই কোম্পানি আরো বেশি বিজ্ঞাপন দিয়ে গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করে।

বাংলাদেশের বাজারে ম্যাংগো জুসের নামে যা বিক্রি হয়, তার বেশিরভাগেই যে আমের লেশমাত্র নেই, তা আমজনতা জানতেও পারে না। কারণ কোনো পত্রিকায় কখনো সেই নিউজ ছাপা হয় না। কারণ অধিকাংশ ম্যাংগো জুস নির্মাতা বড় বিজ্ঞাপনদাতা। মোবাইল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বড় বিজ্ঞাপনদাতা। তাই তারা দিনের পর দিন খারাপ সার্ভিস দিয়ে বেশি টাকা নিলেও কোনো পত্রিকায় তাদের বিরুদ্ধে এক লাইনও লেখা হয় না। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের অনেক অনিয়মের খবর আপনারা ব্যক্তিগতভাবে জানেন, কিন্তু কোনো পত্রিকায় কখনো তেমন কোনো নিউজ দেখেছেন? এভাবে প্রতিদিন অনেক অসংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়। আবার অনেক সংবাদ হারিয়ে যায় অন্ধকার গহ্বরে। এভাবে বিজ্ঞাপনদাতারা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা ভোগ করেন। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন, কোনো পত্রিকায় কোনো সংবাদ ছাপা হবে না। রাজনীতিবিদদের পান থেকে চুন খসলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু বিজ্ঞাপনদাতাদের অনেক অন্যায় মুখ বুজে সয়ে যাই। দেশে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন যারা চাইলেই একাধিক টিভি বা পত্রিকা প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু তারা বোঝেন, শত কোটি বিনিয়োগ করে একটি টিভি বা পত্রিকা প্রকাশ করার চেয়ে মাসে মাসে বিজ্ঞাপন দিলেই তো বাংলাদেশের সব টিভি বা পত্রিকাই তার কথা বলবে। তাহলে একটি পত্রিকার মালিক হওয়ার মতো বোকামি তিনি কেন করবেন। পত্রিকা বা টিভির নিউজ রুমের কাছে মালিকের নির্দেশ আর বিজ্ঞাপনদাতার অনুরোধ সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন পত্রিকা এবং টিভিতে বিজ্ঞাপন দেয় এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অন্তত একশো। তার মানে বাংলাদেশে এমন একশো কোম্পানি আছে, যারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। কারণ তারা জানে, তারা অন্যায় করলেও কোনো নিউজ হবে না। বরং গণমাধ্যম তাদের পক্ষে দাঁড়াবে। কী ভয়ঙ্কর!

গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় পণ্যের প্রচার এবং সেই প্রচারের মাধ্যমে প্রসারের জন্য। বাংলাদেশে অনেক কোম্পানির পণ্য আছে, যার যথেষ্ট প্রসার আছে, প্রসারের জন্য আর বিজ্ঞাপন দেওয়ার দরকার নেই। অনেক কোম্পানি আছে যাদের ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের সক্ষমতা নেই। তারপরও তারা দিনের পর দিন বিজ্ঞাপন দিয়ে যান। কেন? এই বিজ্ঞাপন পণ্যের প্রচারের জন্য নয়। এই বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ রাখার জন্য বা গণমাধ্যমকে হাতে রাখার জন্য। যাতে তাদের পণ্য নিয়ে কোনো নেতিবাচক রিপোর্ট ছাপা না হয়। আপনারা হয়তো এতক্ষণে বিভিন্ন উদাহরণ হাতে নিয়ে তৈরি হয়েছেন, আমার লেখা ভুল প্রমাণ করার জন্য। অমুক পত্রিকায় তো অমুক কোম্পানির বিরুদ্ধে নিউজ ছাপা হয়েছে। না, এগুলো একধরনের বিভ্রম। আমি আপনাদের নিশ্চিত করে বলছি, এমন রিপোর্ট দেখলে আপনাদের ধরে নিতে হবে, সেই পত্রিকার সাথে সেই কোম্পানির কোনো বিষয় নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। হয়তো বিজ্ঞাপন কমে গেছে বা বিজ্ঞাপনের টাকা বাকি আছে। কয়েকদিন পরেই দেখবেন ঝামেলা মিটে গেছে। সেই পত্রিকায় সেই কোম্পানির বিজ্ঞাপন আবার ছাপা হচ্ছে। মধুরেন সমাপয়েত। এছাড়া প্রথম আলোতে বসুন্ধরার বিরুদ্ধে, কালের কণ্ঠে প্রথম আলো ও যমুনার বিরুদ্ধে, যুগান্তরে বসুন্ধরার বিরুদ্ধে নিউজ ছাপার সাথে বিজ্ঞাপনের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো আরো ওপরের বিষয়। কোম্পানি টু কোম্পানি বিরোধ। রাজায় রাজায় যুদ্ধ।

এই তো গেল বিজ্ঞাপনের সমস্যা। চলুন এবার দেখি প্রিন্ট মিডিয়ার আরেক বস হকারদের দৌরাত্ম্য। আপনি যত ভালো পত্রিকাই প্রকাশ করুন না কেন, তা বিক্রি করার জন্য পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে হকারদের ওপর। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় যাই হোক, সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা তাজা পত্রিকা পেয়ে যাই হকারদের কল্যাণে। একজন পাঠক হিসেবে হকাররা আমার অতি প্রিয়। কোনো কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা না পেলে আমার দিনটাই শুরু হতে চায় না। হকাররা রাত জেগে কাজ করে আমাদের দিনের শুরুটা আনন্দময় করে তোলার জন্য। কিন্তু এই হকারদের কাছেই জিম্মি পত্রিকার প্রকাশকরা। হকারদের ব্যবসার কোনো পুঁজি নেই। হকারদের চাহিদামতো দেশের যেকোনো প্রান্তে নিজ খরচে তাদের হাতে পত্রিকা পৌঁছে দিতে হয়। বিক্রির পর হকাররা তাদের কমিশন রেখে বাকি টাকা এবং অবিক্রিত পত্রিকা ফেরত দেন। তবে ঢাকার বাইরের অনেক হকারের কাছ থেকে টাকা এবং অবিক্রিত পত্রিকা পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। কখনো কখনো হকাররা শুধু বলে দেন, এত কপি বিক্রি হয়েছে। আসলেই কত কপি বিক্রি হয়েছে, তা জানার সুযোগ থাকে না, হকারদের কথার ওপর বিশ্বাস রাখতে হয়। বড় পত্রিকাগুলো হয়তো নিয়মিত ঢাকার বাইরের হকারদের কাছ থেকে টাকা পান। কিন্তু ছোট ছোট পত্রিকাকে টাকার জন্য দিনের পর দিন ধর্র্না দিতে হয়। অনেক সময় পাওয়াই যায় না। কোনো কারণে পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে হকারদের লাভ ষোলো আনাই। হকাররা চাইলে একটি পত্রিকাকে পুরোপুরি ভাসাতে না পারলেও ডুবাতে পারেন। কমিশন বেশি পেলেই হকাররা কম চালু পত্রিকাও সামনে রাখে এবং পাঠকদের সেই পত্রিকা কেনার জন্য অনুরোধ করে। আর কোনো কারণে পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সাথে বনিবনা না হলে সেই পত্রিকাটি আড়ালে রাখা হয়। পাঠকরা কিনতে চাইলে বলে নেই বা শেষ হয়ে গেছে। আর দিন শেষে পত্রিকার প্রকাশকদের বলে, ধুর মিয়া কী পত্রিকা বাইর করছেন, চলে না। এটা সবাই জানেন বলেই, পত্রিকা অফিসে হকাররা ভিআইপি মর্যাদা পান। হকারদের বড় নেতা অফিসে এলে স্বয়ং সম্পাদক তাকে আপ্যায়িত করেন। প্রায়শই পত্রিকা কর্তৃপক্ষ হকারদের নানা গিফট দেন। ঢাকায় এনে আপ্যায়ন করেন। হকারদের যেকোনো অনুরোধ রাখে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ।

প্রিন্ট মিডিয়ার যেমন হকার, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার তেমনি ক্যাবল অপারেটর। হকারদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ক্যাবল অপারেটররা। হকাররা তবু পত্রিকা বিক্রি করে টাকা দেয়। কিন্তু ক্যাবল অপারেটররা গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিলেও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে কোনো টাকা দেন না। টাকা তো দেনই না, উল্টো গোপনে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ ক্যাবল অপারেটরদের উৎকোচ দেন। নিয়মিত গিফট, ঢাকায় ডেকে আপ্যায়ন, যেকোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণÑসবকিছুতেই অপারেটররা অগ্রাধিকার পান। পত্রিকা অফিসে হকাররা ভিআইপি, আর টিভি অফিসে ক্যাবল অপারেটরা ভিভিআইপি। নিয়মিত তাদের সন্তুষ্ট রাখতে হয়। মাঝে মাঝেই আবদার আসে অমুক জেলায় ক্যাবল অপারেটরদের অফিসে টেলিভিশন বা সোফা সেট কিনে দিতে হবে। এখন যেহেতু দেশে প্রায় ৪০টি টিভি। তাই দেশের যেকোনো প্রান্তে ক্যাবল অপারেটররা কিছু করলেই টিভি স্টেশনগুলো প্রতিযোগিতা করে তাদের পাশে দাঁড়ায়। ক্যাবল অপারেটররা সন্তুষ্ট থাকলেই টিভির উন্নতি।

প্রিয় পাঠক, এই হলো বাংলাদেশে স্বাধীন গণমাধ্যমের চিত্র। হা হা হা। হাত পা বেধে সাঁতার কাটা অনেক আনন্দের। আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা সেই আনন্দ উপভোগ করছি প্রতিদিন। আর দিন গুণছি, কবে সত্যি সত্যি সত্যিকারের স্বাধীন গণমাধ্যম পাবো।

প্রভাষ আমিন, হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

13 − 6 =