বাজারের ব্যাগ হোক পরিবেশবান্ধব

শবনম শিউলী

সম্প্রতি কথা চলছে বাজারে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা নিয়ে। এবারই প্রথম নয়, এই ব্যাগ এর আগেও অনেকবার নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এ উদ্যোগ খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ সঠিক মনিটরিং ও পদক্ষেপের অভাব। দেশে প্রতি মাসে ৪ কোটি ১০ লাখ পিস পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত সাধুবাদ জানানোর মতো। একটু চেষ্টা করলেই এর সুফল ভোগ করতে পারবে মানুষ। এ উদ্যোগ শুধু পরিবেশ নয়, স্বাস্থ্যকর পৃথিবী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল বয়ে আনবে।

আগামী ১ নভেম্বর থেকে দেশের সমস্ত বাজারে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে। একইসঙ্গে, রাজধানীর যেসব বাজার সম্পূর্ণ পলিথিন-মুক্তভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে, সেসব বাজারকে পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ব্যবসায়ীদের পলিথিনের পরিবর্তে পাটের মতো পরিবেশবান্ধব বিকল্পগুলো গ্রহণ ও প্রচারের আহ্বান জানিয়েছেন বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

পরিবেশবান্ধব কোনটি

সাধারণত কোনো ব্যাগ উৎপাদনে কতটা শক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, কতবার পুনরায় ব্যবহার করা যাচ্ছে এবং সেটা কত দ্রুত মাটিতে মিশে যেতে পারছে; তা বিবেচনায় নিয়েই পরিবেশবান্ধব কি না, তা যাচাই করা হয়। সরকারি নির্দেশনা হচ্ছে পাট বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করা। এসব টেকসই ও দ্রুত পচনশীল। তবে যারা ফ্যাশনসচেতন, তারা আরও নানা রকম ব্যাগ ব্যবহার করতে পারেন।

বিকল্প কি?

দামে সস্তা ও অন্য কোনো বিকল্প না থাকায় নানা সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার একদিনেই বাদ দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ দিনের পর দিন ব্যবহার ও উৎপাদনের কারণে এটি মানুষের জীবনে একটি সাধারণ প্রয়োজনে পরিণত হয়েছে। এই প্রয়োজন ও ব্যবহার বাদ দিতে হলে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও ফলপ্রসূ বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থাটি হাতের মুঠোয় না হলে বরাবরের মতো এবারের পদক্ষেপও খুব একটি সুফল বয়ে আনতে পারবে না। তাই ভাবতে হবে সহজ বিকল্পের কথা।

পলিথিনের পরিবর্তে হতে পারে কাপড়, কাগজের ব্যাগ। যেগুলো খুব সহজেই মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। সাধারণ পলিথিনের তুলনায় কাগজের ব্যাগকে অনেকে এগিয়ে রাখবেন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, কাগজের ব্যাগের পুনর্ব্যবহার খুব কম। সাধারণত দুই-একবারের বেশি এসব ব্যাগ ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব। আবার ভেজা জিনিসপত্র বহনের জন্য কাগজের ব্যাগ উপযুক্ত নয়। উত্তর আয়ারল্যান্ডে ২০১১ সালের একটি গবেষণায় জানা গেছে, একটি প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদনের চাইতে অন্তত ৪ গুণ বেশি শক্তি প্রয়োজন একটি কাগজের ব্যাগ তৈরিতে। এছাড়াও প্লাস্টিক ব্যাগের বিপরীতে কাগজের ব্যাগ তৈরিতে উজাড় হয় বনভূমি। এর বাইরে কাগজের ব্যাগের ওজন বেশি হয় প্লাস্টিকের তুলনায়। সুতরাং এটি পরিবহনে প্রয়োজন আরো বেশি শক্তি, ফলে কার্বন নির্গমনের হারও বেশি; গবেষণা তেমনটাই নির্দেশ করে। তবে পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগও ব্যবহার করা যেতে পারে।

টোট ব্যাগ

ব্যাগেরও আছে নানা রকম। টোট ব্যাগ, হ্যান্ড ব্যাগ, বাজারের ব্যাগ ইত্যাদি। টোট ব্যাগ এখন অনেক জনপ্রিয়। টোট ব্যাগ জেন্ডার নিউট্রাল ও আরামদায়ক। টিন এজারেরা বেশি ব্যবহার করছে টোট ব্যাগ। তাদের নিত্যদিনের ফ্যাশনের অংশ এখন এই ব্যাগ। টোট ব্যাগের হাতল প্রথম দিকে ছোট রাখা হতো, যেন ব্যাগ হাতেই বহন করা যায়। বাজারের ব্যাগের জন্যও ছোট বেল্টওয়ালা টোট ব্যাগ ব্যবহার করা যাতে পারে। ব্যাগগুলোর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এদের চেইন থাকে না। তাই বারবার খোলা বন্ধ করতে হয় না। টোট ব্যাগ মূলত আকারে কিছুটা বড় হয়ে থাকে। একে ওভারসাইজ ব্যাগ বললেও একেবারে ভুল হবে না। চামড়া, কাপড়, ডেনিম, পাট, সিনথেটিক উপকরণ দিয়ে টোট ব্যাগ তৈরি করা হয়।

বাঁশ, বেত ও হোগলাপাতার ব্যাগ

হোগলাপাতায় তৈরি ব্যাগগুলো সবজি ও ফলমূল বহনের জন্য ভালো। টেবিলে ফলমূল রাখতে বা ফুল কুড়াতে ঝুড়ির ব্যবহার বেশ পুরোনো। অফিসে খাবার নিতে, বাজার করতে বা ঘোরাঘুরি, নানা কাজেই এমন ব্যাগ ব্যবহার করা যায়। এসব ঝুড়ি ব্যাগ তৈরির উপকরণেও ব্যবহৃত হচ্ছে বাঁশ, বেত, হোগলাপাতা, খেজুরপাতা। এ ছাড়া পুরোনো কাপড় পেঁচিয়েও তৈরি হচ্ছে এক রকমের নান্দনিক ঝুড়ি বা ঝুড়ি ব্যাগ। অর্থাৎ কেউ চাইলে বাড়িতে থাকা কাপড় দিয়েও এমন ঝুড়ি ব্যাগ বানিয়ে নিতে পারবেন। দেশীয় ও প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা বাঁশ, বেত, পাট, হোগলাপাতা, খেজুরপাতার তৈরি এসব ঝুড়ি যেমন আধুনিক, তেমনি বাঙালিয়ানাও রয়েছে শতভাগ। এ ব্যাগ ব্যবহারে আভিজাত্যও ফুটে ওঠে। দেখতে চমৎকার এই ব্যাগে ভরে আনতে পারবেন ছোট সংসারের প্রয়োজনীয় সদাইপাতি। রাজধানীর নিউ মার্কেট, আড়ং, যাত্রা, জয়িতা, দোয়েল চত্বর, সোর্স, ইউনিমার্টসহ বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যাবে এ ব্যাগ।

ভুট্টা থেকে তৈরি ব্যাগ

২০২২ সালে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের পাশে গোদাগাড়ী উপজেলায় ‘ক্রিস্টাল বায়োটেক’ নামের ব্যাগ তৈরির একটি কারখানা গড়ে তোলেন স্থানীয় উদ্যোক্তা ইফতেখারুল হক। বিদেশ থেকে আনা যন্ত্রপাতি ও উপকরণ এনে তিনি ভুট্টার নির্যাস থেকে ব্যাগ তৈরি করছেন। এখন রাজশাহীতে বাজারের ব্যাগ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। পরিবেশ দূষণকারী পলিথিনের বিকল্প হিসেবে রাজশাহীতে তৈরি করা হচ্ছে ভুট্টার স্টার্চ থেকে তৈরি পরিবেশবান্ধব ব্যাগ। শতভাগ পচনশীল ভুট্টার নির্যাস থেকে তৈরি হয় এই ব্যাগ।

পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ

পাটের তৈরি পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ বাজারে আসবে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে। দিনে উৎপাদন হবে পাঁচ থেকে সাত টন। বর্তমানে দেশে ৮ লাখ হেক্টরের ওপরে পাট ও পাটজাতীয় ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। এক কেজিতে গড়ে ১০০ ব্যাগ করা যায়। প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৫ টন সোনালি ব্যাগ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ সহজেই মাটির সঙ্গে মিশে যায় এবং মাটিতে উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যাগ বিশ্বজুড়ে যখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন পাটের এই প্রাকৃতিক ব্যাগ বিশ্বের পরিবেশ দূষণ কমাতে সহায়তা করবে। বিশ্বের এই চাহিদা কাজে লাগিয়ে পাটের সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকেও উৎসাহিত করতে হবে।

বর্তমানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ব্যাগের ৪০ শতাংশই একবার ব্যবহৃত হয়। গবেষকেরা বলছেন, এসব ব্যাগে ১৮ ধরনের কেমিকেলের মধ্যে ১২টি উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত। যা ক্ষুদ্রকণা হিসেবে রক্ত, মস্তিষ্কে মিশে যাচ্ছে। মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে প্রবেশ করছে নবজাতকের শরীরেও। রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তোলার নেপথ্যে রয়েছে পলিথিনের অবদান। যা থেকে ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশনের মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষতি বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।

লেখাটির পিডিএফে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 + 20 =