বিজয়ের মাসে টেস্ট সিরিজ জয় হবে অনন্য মাইলফলক

সালেক সুফী

ডিসেম্বর মাস জাতির গৌরব আর গর্বের মহান বিজয়ের মাস।  ১৯৭১ সালের এই মাসের ১৬ ডিসেম্বর সাড়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে মানবজাতির ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যাকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসাবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ। ৫২ বছর পর আরেক ডিসেম্বরে বাংলাদেশের আলোকিত  ছেলে মেয়েরা বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন থেকে ছিনিয়ে আনছে বিজয়।

১ ডিসেম্বর বাংলার নারী ফুটবল দল  ৩-০ গোলে পরাজিত করে সিঙ্গাপুর দলকে, ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ক্রিকেট দল শক্তিশালী নিউ জিল্যান্ড দলকে ১৫০ রানের বিশাল ব্যাবধানে পৰ্যায়ত করে ঐতিহাসিক টেস্ট জয় করে।  ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল দক্ষিণ আফ্রিকা নারী দলের বিরুদ্ধে জয় লাভ করে।  ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল ৮-০ গোলের বিশাল ব্যাবধানে পর্যুদস্ত করে সিঙ্গাপুর দলকে। বিজয়ের নতুন নতুন মাইলফলক স্থাপনের মাধ্যমে আনন্দের পসরা সাজিয়ে আসা এবারের সুযোগ ৬ ডিসেম্বর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সফরকারী নিউ জিল্যান্ড দলকে পরাজিত করে বাংলাওয়াশ করার।

মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম এবং রমনায় পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ দেখার গৌরবের অধিকারী হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিটি অর্জন আমাকে আবেগ আপ্লুত করে। আমি মনে করি নিজেদের নিবেদন করে সামর্থের সবটুকু নিংড়ে দিলে বাংলাদেশের তরুণ দল অবশ্যই টেস্ট ম্যাচটি জিতে নিতে পারবে।  আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ সিরিজের প্রথম দুটি টেস্ট জয় সিরিজে বাংলাদেশকে সুবিধাজনক পর্যায়ে নিয়ে যাবে।

মনে রাখতে হবে নিউ জিল্যান্ড কিন্তু প্রথম আইসিসি টেস্ট সিরিজ চ্যাম্পিয়ন দল।  সিলেটে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্ট পরাজয়ের পর ব্ল্যাক ক্যাপসরা কিন্তু পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াতে জীবনপণ লড়াই করবে। বিনাযুদ্ধে এক ইঞ্চি ভূমি ছেড়ে দিবে না। তারুণ্য নির্ভর বাংলাদেশকে কিন্তু চোখে চোখ রেখেই লড়াই করতে হবে। কিছু কিছু নিন্দুক ধীর, নিচু, ঘূর্ণি উইকেটের কথা বলছে।  খোদ নিউ জিল্যান্ড দল কিন্তু সিলেট উইকেট নিয়ে নেতিবাচক কিছু বলেনি।

শুরুতে উইকেটে ঘাস ছিল, তবে কিছুটা ধীর গতির উইকেটে পরে বল সহজে উইকেটে আসছিল না। বাংলাদেশ ভালো খেলেই প্রথম ইনিংসে ৩১০ রান করেছিল। সূচনাকারী ব্যাটসম্যান মাহমুদুল হাসান জয় অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের মতো ব্যাটিং করে ৮৬ রান সংগ্রহ করেছিল। নাজমুল শান্ত এবং মমিনুল উভয়ের ৩৭ রানের ইনিংস দুটির অন্তত একটি বড় হলে বাংলাদেশ স্কোর ৩৫০ -৪০০ হতে পারতো। নুরুল হাসান ২৯, শাহাদাত দিপু অভিষেকে ২৪ করলেও উইকেটে স্থিতু হয়ে বড় ইনিংস খেলতে পারেনি।

একটু কঠিন হয়ে আশা উইকেটে ভালো বোলিং করেই বাংলাদেশ তুখোড় নিউ জিলান্ড দলকে ৩১৭ রানে বেঁধে রেখে কাজের কাজটি করেছিল। সফরকারী দলের অন্যতম বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান অধিনায়ক কেন উইল্লিয়ামসন ১০৪ রান করার পথে দুবার সুযোগ দিয়েছিল। একটি সুযোগ হাতছাড়া না হলে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে লিড পেত।  হয়নি সেটি। বাংলাদেশের সেরা স্পিনার অথচ অবহেলিত তাইজুল ইসলাম (৪/১০৯) আবারো বল দিয়ে নিজের প্রতি অবিচারের জবাব দিলো।

অধিনায়ক নাজমুল শান্ত অনিয়মিত বলার মোমিনুলকে (৩/৪) কাজে লাগিয়ে মুন্সিয়ানা দেখান। প্রকৃতপক্ষে নাজমুল শান্তর অধিনায়কত্বে জ্বলে উঠে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটিং ছিল সৃষ্টি সুখের উন্মাদনায় উদ্দীপ্ত।  চতুর্থ দিনশেষে ২১২/৩ বাংলাদেশকে টেস্ট ম্যাচ নিয়ন্ত্রকের অবস্থানে নিয়ে যায়। অসাধারণ ব্যাটিং করে দ্বিতীয় ইনিংসে নতুন মাইলফলক স্থাপন করে নাজমুল শান্ত।  অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকে শতরান করে শান্ত এলিট তালিকায় নাম লেখান। শান্তর সঙ্গে প্রথম মোমিনুল (৪০) এবং পরে অভিজ্ঞ মুশফিক (৬৭) লম্বা জুটি গড়ে তোলে। শেষ দিকে মেহেদী মিরাজ অপরাজিত ৫০ রান করে ৩৩১ রানের লিড পেল বাংলাদেশ।

কিছুটা কঠিন হয়ে ওঠা উইকেটে ৩৩২ রান করে টেস্ট জয় অথবা দুই দিনের অধিকাংশ সময় ব্যাটিং করে টেস্ট রক্ষা দুরূহ ছিল। তারপর উইকেটের সুবিধা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে সফরকারী দলের ব্যাটিংয়ে ধস নামায় ওই তাইজুল ইসলাম (৬/৭৫) যাকে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে অবজ্ঞা করেছে।  গায়ে লাল বল ক্রিকেটের তকমা লাগিয়ে দিয়েছে। তাইজুলের টেস্ট ম্যাচে ওকে যোগ্য সাঙ্গ দেয় নাঈম হাসান, মেহেদী মিরাজ। ১৮১ রানে শেষ হয় সফরকারী দলের ইনিংস।

১৫০ রানের বিশাল ব্যাবধানে পরস্পরের বিরুদ্ধে খেলা ১৪ টেস্ট ম্যাচে দ্বিতীয় জয় অর্জন করে বাংলাদেশ। স্মরণে আছে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ অধীন পূর্ববর্তী পর্যায়ে নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওদের দেশে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। তারুণ্য নির্ভর এবারের বাংলাদেশ দলে তামিম, সাকিব, লিটন, তাসকিন, এবাদত ছিল না। কৃতিত্বপূর্ণ জয় প্রমাণ করে ড্রেসিং রুমের গুমোট পরিবেশ মুক্ত হয়ে মানসিক ভাবে চাঙা ছিল দলটি।

দ্বিতীয় টেস্ট মীরপুরে অনুষ্ঠিত হবে কাল ৬ ডিসেম্বর বুধবার থেকে। বিজয়ী দল ঐতিহ্যগতভাবে কম্বিনেশন পরিবর্তন করে না। অতীত বলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুর্গম দুর্গে উইকেট স্পিন সহায়ক হয়। প্রথম দিন থেকেই উইকেটে স্পিন ধরে। এখন শীতকাল। রাতে শিশির ঝরবে। টস জয় করে সাধারণত ক্যাপ্টেন ব্যাটিং করতে চাইবে।

ঐতিহ্যগতভাবে প্রথম দিন সকালের সেশনে উইকেটে ল্যাটারাল মুভমেন্ট থাকে। আমি বাংলাদেশ দলকে দুইজন পেসার নিয়ে খেলার পরামর্শ দিবো। শরিফুলের সাথে খালেদ অথবা হাসান মাহমুদকে খেলানো যেতে পারে। তাইজুল, মিরাজের সঙ্গে প্রয়োজনে মোমিনুল এমনকি শান্ত নিজে স্পিন বোলিং করতে পারবে।

অতিথি দল হয়তো রাচীন রাভিন্দ্রাকে সংযুক্ত করে ব্যাটিং শক্তি বাড়াতে পারে।  কোনওয়ে, উইলিয়ামসন, মিচেল একই ভুল বার বার করবে বলে মনে হয় না। ওরা হয়তো বাম হাতি স্পিনার মিচেল সান্টনারকে খেলিয়ে স্পিন আক্রমণ শক্তি বাড়াবে। রাচীন রবীন্দ্র নিজেও স্পিন বোলিং করে। উইকেটের চরিত্র যাই হোক না কেন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।

বাংলাদেশকে সেরা খেলা উপহার দিয়ে লড়াই করতে হবে। খেলাটি ৫ম দিন পর্যন্ত বিস্তৃত করা গেলে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা উন্মুক্ত হবে। এই সিরিজ জয় অন্যের সমীকরণের সমাধান দিবে। তরুণ এই দলে বিতর্কিত খেলোয়াড়দের অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন থাকবে না। দুরন্ত বোলিং এবং পাশাপাশি টপ অর্ডার ব্যাটিং বাংলাদেশকে স্বস্তি দিয়েছে সিলেট টেস্টে।  লেট্ মিডল অর্ডার ব্যাটিং আরো সুসংহত হলে বাংলাদেশকে হারানো সহজ হবে না।

বিজয়ের মাসে টেস্ট সিরিজ জয় বিজয় উৎসবকে রাঙিয়ে দিবে।

সালেক সুফী: আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four + 6 =