বিদ্যুৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সময়োচিত হয়নি

সালেক সুফী

অঙ্গীকার সত্ত্বেও পুরানো সরকার নতুন টার্মে এসে সিন্ডিকেটের কবল থেকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করতে পারেনি। মূল্যস্ফীতি উদ্বেগজনক। খেটে খাওয়া মানুষ, সীমিত আয়ের চাকরিজীবীদের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর জীবনে ত্রাহি মধুসুধন অবস্থা।

শুরু হয়েছে সেচ মৌসুম, আসছে রোজা, সঙ্গে সঙ্গে আসছে গ্রীষ্মকাল। বাস্তবতার কারণেই জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে গভীর চিন্তা সর্বত্র।  জানি সরকার জ্বালানি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে সাবসিডি কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকার ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে।

সরকারের মন্ত্রীর ঘোষণায় নিয়মিত বিরতিতে মূল্য বৃদ্ধি করে ঘাটতি মেটানোর ইঙ্গিত আছে। তবে ঠিক এই মুহূর্তে মূল্যবৃদ্ধি যথাযথ হয়নি। জ্বালানি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি চক্রাকারে সব কিছুর মূল্য বৃদ্ধি ঘটাবে। সরকারের কিন্তু কোন কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। অনেকের মতে সরকার ঘনিষ্ট সিন্ডিকেটদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার।

এমনিতেই জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটে শিল্পখাত বিপর্যস্ত। গ্যাসের অভাবে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।  ডলার সংকটের কারণে কয়লা, গ্যাস আমদানি বাধাগ্রস্ত। বিপিডিবি, পেট্রোবাংলা, বিপিসির মতো সরকারি সংস্থাগুলো দেউলিয়া প্রায়।

সরকার সময়মত সাবসিডির অর্থ ছাড় করছে না। তাই দাম বাড়িয়েও মানসম্মত বিদ্যুৎ জ্বালানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। ২০২৪ গ্রীস্ম মৌসুমে বড় ধরনের লোড শেডিংয়ের আশঙ্কা আছে।  জ্বালানি বিদ্যুতের বেহাল অবস্থায় শিল্প মালিকরা স্বাভাবিক শিল্প উৎপাদন বজায় রাখতে পারছে না। দেশি বিদেশি বিনিয়োগে অশুভ প্রভাব পড়েছে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠগুলোতে তারল্য সংকট, পুঁজিবাজার বিপর্যস্ত।  সরকারেরও এখন কূল রাখি না শ্যাম রাখি অবস্থা।

জ্বালানি বিদ্যুৎ মূল্য বৃদ্ধি বা সমন্বয়ের একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। সরকার নিজেই জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে ব্যাবসা করে। আছে বেসরকারি বিনিয়োগ।  বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মাধ্যমে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে হেয়ারিং করে সৃষ্ট পন্থায় মূল্য বৃদ্ধি করা হলে তবুও কিছু সম্পৃক্ততা এবং জবাবদিহিতা থাকে।  একটি  ফর্মুলার ভিত্তিতে মূল্য সমন্বয় বা বৃদ্ধি করা হলে কারো কিছু বলার থাকে না। সরকারি সংস্থাগুলোর জবাবদিহিতা থাকে। কিন্তু সরকার এককভাবে ঘোষণা দিয়ে মূল্য বৃদ্ধি স্বার্থের সংঘাত বলে বিবেচিত হয়।

কেন কোন পরিস্থিতিতে নিয়মিত মূল্য বৃদ্ধি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে সবাই জানে। সরকারি পরিকল্পনায় দূরদৃষ্টির অভাব, বাস্তবায়ন দুর্বলতা, দুর্নীতি পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা বৈষয়িক কারণে অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি।

মাটির নিচে স্বল্প গভীরতায় উঁচু মানের কয়লা সম্পদ, নানা তালবাহানায় মাটির নিচে রয়ে গেছে। অথচ প্রতিবেশী দেশের প্রভাবশালী কোম্পানি কয়লা আমদানি করে সেই দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বিদ্যুৎ রপ্তানি করছে বাংলাদেশে।  জলে স্থলে বিপুল তেল গ্যাস আবিষ্কারের সম্ভাবনা থাকলেও ২০০০-২০২৩ বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে আহরণ এবং উত্তোলন করতে। এখন প্রতিবেশী দেশে এলএনজি আমদানি করে বাংলাদেশে পাইপ লাইনে রপ্তানির আয়োজন জোরে শোরে এগিয়ে চলছে।

স্বাধীনতার ৫২ বছরেও একমাত্র তেল শোধনাগারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়নি। দ্বিতীয় শোধনাগার স্থাপন দূরের কথা। কিন্তু ভারতের তেল শোধনাগার থেকে পাইপ লাইন দিয়ে পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য আমদানি চলছে।  স্বাধীন সার্বভৌম দেশ নিজেদের জ্বালানি সম্পদ আহরণ না করে আমদানির পথে ছুটে বর্তমান সংকট সৃষ্টি করছে।

আমি আসন্ন গ্রীষ্মে ভয়াবহ জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটের আশঙ্কা করছি। হঠাৎ  করে  জেগে উঠেছে পেট্রোবাংলা। জোরে শোরে শুরু করেছে তেল গ্যাস অনুসন্ধান। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারে কয়লা তোলার ইঙ্গিত থাকলেও এখন পর্যন্ত কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। এখন উপায় সর্বস্তরে কৃচ্ছতা সাধন, অপচয় রোধ,  চুরি নির্মূল করা,  জ্বালানি বিদ্যুৎ ব্যাবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি। এছাড়া যথাযথ প্রণোদনা দিয়ে যতটা সম্ভব সৌর বিদ্যুৎ এবং বায়ু বিদ্যুতের অবদান বাড়ানো।

পরিশেষে বলবো জ্বালানি সরবরাহের, জ্বালানি ব্যবহারের ব্যবস্থা উন্নত না করে এই মুহূর্তে পর্যায়ক্রমিক মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা জনগণের প্রতি অন্যায় হয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

12 − five =