বিশ্বকাপ যখন সোনার হরিণ

উপল বড়ুয়া

আর বেশিদিন নেই। দরজায় কড়া নাড়ছে ক্রিকেট বিশে^র সবচেয়ে মর্যাদার লড়াই ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ভারতের ১০ ভেন্যুতে ৫ অক্টোবর থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত ১০ দল একে অন্যের মুখোমুখি হবে সোনালি শিরোপার জন্য। আগের আসরের চেয়ে দেরিতে হলেও ইতিমধ্যে সূচিও প্রকাশ করেছে আইসিসি। উদ্বোধনী ম্যাচে আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হবে ইংল্যান্ড ও নিউ জিল্যান্ড। গত বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট তারা। ২০১৯ বিশ্বকাপে নিজেদের মাটিতে নাটকীয় ড্রয়ের পর সুপার ওভারে বাউন্ডারির হিসেবে কিউইদের হারিয়ে প্রথমবার একদিনের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ জিতে ইংলিশরা।

শিরোপা ধরে রাখার মিশনে এবারও ফেবারিটদের কাতারে ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও জিতেছে তারা। তবে গতবার খুব কাছে গিয়েও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা এবার লাঘব করতে চাইবে নিউ জিল্যান্ড। আর সোনালি শিরোপাটা ছয়ে উন্নীত করতে চাইবে অস্ট্রেলিয়া। আসর ঘরের মাটিতে হওয়ায় ছাড় দিয়ে কথা বলবে না ক্ষুধার্ত ভারত। গত এক দশক ধরে আইসিসির কোনো শিরোপা নেই টিম ইন্ডিয়ার শো পিসে। সর্বশেষ কোনো বিশ্বকাপ জিতেছে ২০১১ সালে। এশিয়ায় হওয়া সেই ওয়ানডে বিশ্বকাপে ওয়াংখেড়েতে মহন্দ্রে সিং ধোনির নেতৃত্বে ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’ শচীন টেন্ডুলকারের দুঃখ ঘোচায় ভারত।

তবে এবার ক্রিকেটবিশ্ব মিস করবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে জায়গা হয়নি ক্যারিবিয়ানদের। ১৯৭৫ সালে শুরু প্রথম বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন তারা। জিতেছে পরের বিশ্বকাপও। দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও আছে তাদের দখলে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের ভঙ্গুর ক্রিকেট দশার পরিণতি ঠিকই দেখল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভিভ রিচার্ডস, কার্টলি আমব্র্রোস, ব্রায়ান লারাদের উইন্ডিজের প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই ক্রিকেট পাগলদের। কিন্তু এবার যে তারাই দর্শক হয়ে গেল! বাছাইপর্বের সাঁকো পার হওয়া হয়নি জেসন হোল্ডার-শাই হোপদের। বাছাইয়ের গ্রুপ পর্বে টানা দুই হারে খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল উইন্ডিজ। সুপার সিক্সে জায়গা করে নিলেও বিশ^কাপের টিকিট কাটতে পারেনি। গ্রুপ পর্বে দুই পরাজয়ের কারণে সুপার সিক্সে সব ম্যাচে জিততে হতো উইন্ডিজকে। সঙ্গে তাকিয়ে থাকতে হতো বাকি দলগুলোর ফলাফলের ওপর। কিন্তু এত অপেক্ষা কি সয়! এমনিতে নিজেদের নিজেদের সোনালি অতীত হারানো ক্যারিবিয়ানদের গায়ে সেঁটে আছে ‘হায়ার’ ক্রিকেটারের তকমা। মারমার-কাটকাট টি-টোয়েন্টি খেলার জন্য সুনাম থাকায় আজ এখানে কাল সেখানে হায়ারে যায় তারা। সেই উইন্ডিজ ভক্তদের আর অপেক্ষায় রাখতে চাইলেন না বাছাইয়ে। সুপার সিক্সের প্রথম ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে বাজেভাবে হেরে বিশ্বকাপ স্বপ্ন মুঠোছাড়া করে উইন্ডিজ।

কপাল পুড়েছে জিম্বাবুয়েরও। অথচ নিজেদের মাটিতে হওয়া বাছাই পর্ব উতরাতে চেষ্টার কমতি রাখেনি তারা। ক্যারিবিয়ানদের মতো অসহায় আত্মসমর্পণ বা হালকা মেজাজে বাছাইয়ে নামেনি জিম্বাবুয়েনরা। কিন্তু বুলায়াওতে তাদের স্বপ্নও কেড়ে নেয় স্কটিশরা। সুপার সিক্সে নিজেদের এর আগের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারায় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জিততে হতো সিকান্দার রাজাদের। কিন্তু শেষটা ভালো হয়নি তাদের। অথচ নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবার ওয়ানডেতে ৪০০ পেরোনো স্কোর, অনেক দিন পর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো; কতকিছুই করে দেখাল জিম্বাবুয়ে। কিন্তু ব্যর্থ হলো টানা দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপের টিকিট কাটতে। আর দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ বাছাই খেলে মূলপর্বে জায়গা পেল লঙ্কানরা। তাদের সঙ্গী হলো স্কটল্যান্ড।

গত দুই বিশ্বকাপ থেকে বাছাইপর্বের নিয়ম চালু করেছে ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা আইসিসি। এর আগে ২০১১ ও ২০১৫ বিশ্বকাপ হয়েছিল ১৪ দল নিয়ে। তবে ১২তম আসর (২০১৯ বিশ্বকাপ) থেকে নতুন নিয়ম চালু হয়। সেবার আয়োজক দেশ ইংল্যান্ড ও ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে থাকা বাকি ৭ দল সরাসরি স্থান করে নেয় মূল আসরে। বাছাইয়ের সাঁকো পেরিয়ে যোগ দেয় আফগানিস্তান (চ্যাম্পিয়ন) ও উইন্ডিজ। ১০ দল নিয়ে শুরু হয় রবিন রাউন্ড। সেখান থেকে সেমিফাইনাল। এবারও একই নিয়ম। ২০২৩ বিশ্বকাপে র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে থেকে আগে থেকে টিকিট কেটে রাখে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জিল্যান্ড ও আফগানিস্তান। রবিন রাউন্ডে এরা সবাই একে অপরের সঙ্গে খেলবে।

সেখান থেকে শীর্ষে থাকা চার দল যাবে শেষ চারে। সেমিতে শীর্ষ দল খেলবে চতুর্থ স্থানে থাকা দলের সঙ্গে। দুই ও তিন নম্বরে থাকা দলের মধ্যে হবে আরেক সেমিফাইনাল। শুরু যেখানে শেষও হবে সেখানে। ফাইনাল হবে আহমেদাবাদেই। সেই ফাইনালে কোন দুই দলকে দেখা যাবে সেটি নিয়ে ইতিমধ্যে চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে ক্রিকেট পাড়ায়। অলটাইম ফেবারিট অস্ট্রেলিয়া তো আছেই। সঙ্গে গতবারের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডও। তবে ঘরের মাটিতে হওয়ায় ফেবারিট হিসেবে এবার ভারতকে এগিয়ে রাখছে সবাই। নিজেদের মাটিতে টিম ইন্ডিয়া সবসময় ভয়ঙ্কর দল। তাদের নিকট প্রতিবেশি পাকিস্তানকে নিয়ে অবশ্য সেভাবে আলোচনায় নেই। কারণ বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে যাওয়ায় বিষয়টি এখনো ফয়সালা হয়নি।

বিশ্বকাপের আগে ৩১ আগস্ট থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানে হবে এশিয়া কাপ। গতবার টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে হলেও বিশ্বকাপ সামনে রেখে এবার এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই হবে ওয়ানডে ফরম্যাটে। কিন্তু পাকিস্তান নামকাওয়াস্তে আয়োজক দেশ। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) যে সূচি দিয়েছে সেখানে মাত্র চারটি ম্যাচ হবে পাকিস্তানে। বাকি ম্যাচগুলো হবে বিকল্প ভেন্যু শ্রীলঙ্কায়। এর কারণ খুঁজতে একটু পেছনের দিকে যেতে হবে। ২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কার টিম বহনকারী বাসের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। এরপর থেকে পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের ওপর খড়গহস্ত হয় আইসিসি। এক দশক পর আস্তে আস্তে সেই জট খুলছিল। বিরতি দিয়ে হলেও পাকিস্তানে গেছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজসহ অনেক দেশ। এই তো কদিন আগে ঘুরে গেছে ইংল্যান্ড। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে পাকিস্তানে এশিয়া কাপ খেলতে যেতে চায় না ভারত।

এর মধ্যে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডেও (পিসিবি) ক্ষমতার রদবদল হয়েছে। গত বছর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার আনুকূল্যে থাকা পিসিবি চেয়ারম্যান রমিজ রাজাও পদ হারান। এমনিতে রাজনৈতিক উত্তাল অবস্থা দেশটিতে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতও যেতে চায় না পাকিস্তানে। পিসিবিও কেন ব্যাপারটি মেনে নেবে! তারাও সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ভারত এশিয়া কাপ খেলতে না এলে পাকিস্তানও বিশ্বকাপ খেলতে যাবে না। দুই পক্ষের মধ্যে এসিসিতে বেশ কয়েকবার বৈঠকও হয়েছে। তারই ফলশ্রুতিতে, এশিয়া কাপ নিয়ে এই সিদ্ধান্ত। একেই বলে বোধহয়, ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না’।

পাকিস্তান এটা সেটা বললেও বিশ্বকাপ খেলবে সেটা প্রায় নিশ্চিত। সূচি দেওয়ার পর পিসিবি অবশ্য এখন ভারতে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইছে দেশটির সরকারের থেকে। আর যদি কোনো কারণে বিশ^কাপ না খেলে তবে ক্ষতিটা তাদেরই। হয়তো আইসিসির নিষেধাজ্ঞাও পেতে পারে। তবে ভারত-পাকিস্তানের এমন কঠিন অবস্থানে শেষ পর্যন্ত ক্ষতি ক্রিকেটেরই। এক যুগেরও বেশি আগে দুই দেশের মাঝে যে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হতো সেই ইতিহাস ধুলোয় ঢাকতে বসেছে। বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্ট ছাড়া উপমহাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা দুই চিরশত্রুর লড়াই আর দেখতে পায় না বললেই চলে। এই বৈরিতা ভুলে কবে দুই দেশ অন্তত ক্রিকেটে হলেও একজন আরেকজনকে বুকে জড়িয়ে নেবে, সেটির অপেক্ষায় ভক্তরা।

ফেবারিটদের মধ্যে বাংলাদেশ নেই। তাদের গায়ে ‘ডার্কহস’ শব্দটিও জুড়ে নেই। তারপরও এশিয়ার মাটিতে বিশ^কাপ বলে সাকিব আল হাসান-তামিম ইকবালরা স্বপ্ন দেখতেই পারেন। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ বেশ সমীহ জাগানিয়া দল। টাইগারদের সাফল্যের মুকুটে যা কয়েকটি মণিমুক্তো রয়েছে তার প্রায় সব একদিনের ম্যাচের। বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ানডে র‌্যাংকিংয়ের সাতে আছে। গত মার্চে ঘরের মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সীমিত ওভারের সিরিজ জিতেছে। ওয়ানডেতে প্রথম দুই ম্যাচ হারলেও সিরিজের পরের ম্যাচ জিতে হোয়াইটওয়াশ এড়িয়েছে। এরপর আয়ারল্যান্ডের মিরপুর, সিলেট ও চট্টগ্রাম মিলিয়ে তিন সংস্করণই জিতেছে বাংলাদেশ। চেমসফোর্ডে গিয়েও আইরিশদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতে এসেছে। এখন চট্টগ্রামে আফগানদের বিপক্ষে খেলছে (এই লেখা পর্যন্ত) ৫০ ওভারের ম্যাচ। ঘরের মাটিতে পাওয়া সাফল্য ভারতে টেনে আনতে পারলে ভালো কিছু আশা করা যেতেই পারে টাইগারদের ওপর।

বাংলাদেশ গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ শেষ করেছিল সাতে থেকে। ৯ ম্যাচে ৩ জয় ও ৫ হারে পেয়েছিল ৭ পয়েন্ট। তবে সেই আসরে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ছিলেন সাকিব। এবারও দলের অন্যতম এই অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার। আইপিএল খেলার সুবাদে ভারতের মাটি বেশ চেনা তার। ৩৬ বছর বয়সী তারকার এটিই শেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। শেষের আগে যদি সাকিব আরেকবার ব্যাট-বল হাতে জ্বলে ওঠেন তবে সেটিই বাংলাদেশকে এগিয়ে দেবে অনেক দূর। শেষ বিশ্বকাপ হতে পারে তামিম ইকবাল-মুশফিকেরও। ২০০৭ বিশ্বকাপে এই দুজনের কল্যাণে ভারতের বিপক্ষে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। এবারও তেমন কিছু করে দেখাতে পারবেন? কিন্তু দীর্ঘদিন নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছেন না ড্যাশিং ওপেনার তামিম। বাংলাদেশ অধিনায়ক আফগানদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজও শুরু করছেন চোট শঙ্কা নিয়ে। বলতে গেলে, পঞ্চপাণ্ডবের এটিই শেষ বিশ্বকাপ।

সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে দলের বাইরে। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিলেও ওয়ানডে থেকে অবসরের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো দেননি। আরেক পাণ্ডব মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এই বিশ্বকাপে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের অধীনে খেলার সুযোগ না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অনেকদিন ধরে দলে নেই তিনি। বিশ্বকাপে ভালো কিছু করার ভরসা এখন আফিফ হোসেন, হাসান মাহমুদ, তাওহীদ হৃদয়ের মতো তরুণদের ওপরেই রাখতে হচ্ছে। আগামীর বাংলাদেশের দায়িত্ব যে তাদেরই সামলাতে হবে। সঙ্গে একটু সিনিয়র হয়ে যাওয়া লিটন দাস, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ তো আছেনই। সঙ্গে ভারতে চিরচেনা কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমানকে দেখা যাবে তো? অনেক আশার বিশ^কাপে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্নটা এবার দেখতেই পারে বাংলাদেশ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

13 − two =