মুশফিকুর রহমান
আগামী ৯-১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিতব্য জি২০ শীর্ষ বৈঠকের জন্য শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। ১৮তম জি২০ সম্মেলনের মূল কেন্দ্র এবং দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ সড়কসমূহ বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে। এবারের জি২০ সম্মেলনের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় ‘সবুজ উন্নয়ন, জলবায়ু অর্থায়ন এবং জীবন’ আলোচ্য সূচিকে সামনে রেখে নয়াদিল্লীর সড়ক দ্বীপ, সম্মেলন কেন্দ্রের অলঙ্করণে অন্যান্য স্লোগানের সাথে লেখা হয়েছে ‘একটাই পৃথিবী-একই পরিবার-অভিন্ন ভবিষ্যত’। উপণিষদ থেকে উদ্ধৃত করে সম্মেলনের প্রধান বার্তায় বিশ্ববাসীকে জীবনের মূল্য, পৃথিবী এবং মহাবিশ্বের সাথে জীবনের আন্তঃসম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জি২০ সম্মেলনে যে সকল বিশ্বনেতৃবৃন্দ প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠির বসবাসের দেশ, বৈশ্বিক অর্থনীতির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৮৫% এবং বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৭৫% কে প্রতিনিধিত্ব করেন। সংগত কারণে জি২০ সম্মেলনে আলোচিত এবং সম্মত বিষয়সমূহের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি ও প্রধান প্রধান বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরে নেওয়া যায়, সেপ্টেম্বর ২০২৩-এর জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বপরিসরে তার বৈরী প্রভাব নিয়ন্ত্রণে করণীয় প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত হবে। সেসব সিদ্ধান্ত চলতি বছরের শেষ নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই নগরীতে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের ২৮তম জলবায়ু সম্মেলনেরও গতিমুখ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বৈরী প্রভাব এখন যে মাত্রায় প্রকট তাতে কেবল দুর্বল ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশসমূহে নয়, শিল্পোন্নত ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশসমূহেও তা প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছে। আবহাওয়ামণ্ডলীর উষ্ণায়ন যে দ্রুততায় ঘটছে তার প্রভাবে বিশ^ব্যাপী খাদ্য ঘাটতি, ক্ষুধার বিস্তৃতি, বন উজাড় এবং প্রজাতির বিলুপ্তি, মহামারির আক্রমণ, জলবায়ু শরণার্থীর ক্রমবর্ধমান চাপ বৈশি^ক ভারসাম্য এবং শান্তির জন্য হুমকিকে সামনে এনেছে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার কারণসমূহকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই।
২০০৯ সালে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সম্মত হয়েছিলেন যে, ‘অদক্ষ’ জীবাশ্ম জ¦ালানির জন্য ‘মধ্য মেয়াদে’ পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হবে। প্রায় একই সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে (২০২১) যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৬) গৃহীত হয়েছিল। একই সম্মেলনে জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার সঙ্কুচিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সম্মেলনে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করা হবে; জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সমূহের সাথে খাপ খাওয়ার সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য জলবায়ু অর্থায়নের তহবিল গড়ে তোলা হবে। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ স্পষ্ট করেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সঙ্কট মোকাবেলায় বিশ্ব নেতৃত্ব যে সিদ্ধান্তসমূহে একমত হয়েছিলেন, সেগুলো থেকে পিছু হটেছেন অথবা উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছেন।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত (২৩ আগস্ট ২০২৩) দি গার্ডিয়ান রিপোর্ট করেছে, বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ সমূহ (জি২০) ২০২২ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল, গ্যাস, কয়লা) খাতে প্রায় ১.৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে। বলা বাহুল্য, রেকর্ড পরিমাণ বিনিয়োজিত ওই অর্থ জনগণের সম্পদ। বৈশ্বিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ (আইআইএসডি) প্রকাশিত তথ্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছে যে, ‘উল্লিখিত তথ্য স্পষ্ট স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, জি২০ জোটভূক্ত দেশসমূহের সরকার জলবায়ু পরিবর্তনে জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পদ বিনিয়োগের বিধ্বংসী প্রভাব জেনেও তা অব্যাহত রেখেছে।’
গবেষক বিজ্ঞানীদের উপর্যুপরি সতর্কতা উপেক্ষা করে জীবাশ্ম জ্বালানি উন্নয়ন ও ব্যবহার অব্যাহত রাখার অবধারিত প্রভাব পড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনে। জীবাশ্ম জ¦ালানি পুড়িয়ে যে তাপশক্তি উৎপাদন করা হয় তা বায়ুমণ্ডলে বিপুল পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করে; বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে দেয় জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন দূষণ উপাদান। নিঃসরিত গ্রিন হাউস গ্যাস আবহাওয়ার বৈরী আচরণ এবং চরম ভাবাপন্নতা ত্বরান্বিত করে।
কোভিড১৯ মহামারি এবং পরবর্তিতে ইউক্রেইন সঙ্কট বিশ্ব পরিসরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধির জন্য নানামুখি চ্যালেঞ্জ সামনে এনেছে। বিশ্বব্যাপি জ্বালানি, খাদ্য সরবরাহ সঙ্কট সৃষ্টিসহ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিতে অভূতপূর্ব দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট ডেকে এনেছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি’র অনুমান, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপি জ্বালানি তেল খাতে ৮৫% এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে রাষ্ট্রিয় ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুন হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে সরকারি ভর্তুকি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে দেশে দেশে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও পণ্য মূল্য বৃদ্ধির চাপ কমানোর জন্য সরকারের উপর দ্রুত কিছু করার তাগিদ কাজ করেছে।
সরকারি ভর্তুকি দেবার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভর্তুকি ছাড়াও বিভিন্ন জ্বালানি পণ্যের আমদানি শুল্ক ও কর প্রত্যাহার বা হ্রাস করা, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ খাতে সময়মতো বিল পরিশোধ না করায় দ্রুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে সাময়িক ‘স্থগিত’ অবস্থা বহাল রাখার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া অধিক জ্বালানি ব্যবহারকারি শিল্প-কারখানা সমূহ জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন ভর্তুকি মূল্য ও অব্যাহতভাবে বিভিন্ন প্রশাসনিক সহায়তা পেয়ে চলেছে। এ জাতীয় সহায়তা অব্যাহত থাকায় জ্বালানিদক্ষ প্রযুক্তি উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন পিছিয়ে যাচ্ছে এবং দূষণকারি প্রযুক্তির ব্যবহার প্রলম্বিত হচ্ছে। তাছাড়া প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে জীবাশ্ম জ্বালানির সরবরাহ অব্যাহত থাকায় তার অতি ব্যবহার ও অপচয় উৎসাহিত হচ্ছে। একইভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি অব্যাহতভাবে এবং বেশি পরিমাণে ভর্তুকি সহায়তা পেতে থাকায় স্বল্প দূষণের প্রযুক্তির উন্নয়ন ও তার প্রতিযোগতা দক্ষ হবার চ্যালেঞ্জ বাড়ছে।
একইভাবে লক্ষ্য করার বিষয়, জি২০ গ্রুপের অভ্যন্তরে শিল্পোন্নত এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান দেশগুলো ২০৫০ সাল নাগাদ এনার্জি সিস্টেমে ‘নেট জিরো’ অর্জন করতে চায়। দেশগুলো কয়লা ব্যবহার দ্রুত পরিহার এবং অধিকতর দক্ষ ও প্রতিযোগিতা সক্ষম পরিবেশবান্ধব বিকল্প জ্বালানি সহজলভ্য না হওয়া পর্যন্ত প্রাকৃতিক গ্যাসকে অন্তবর্তী জ্বালানি হিসেবে উৎসাহভরে ব্যবহার করতে আগ্রহী। ভারত এবং চীনের মতো বৃহৎ এবং প্রভাবশালী অর্থনীতির দেশ ভিন্ন দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখতে আগ্রহী। প্রথমত দেশ দুটি জ্বালানি সিস্টেমে ‘নেট জিরো’ অর্জনের সময়সীমা আরও পিছিয়ে দেবার পক্ষে এবং জ্বালানি সিস্টেমে ‘নেট জিরো’ অর্জনের অন্তবর্তী পর্যায়ে ‘বহুবিধ জ্বালানি’ ব্যবহারের পথ খোলা রাখার পক্ষে।
স্মরণ রাখা ভােেলা, চীন ও ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার নির্ভরতা এখনও প্রায় দুই তৃতীয়াংশ। ফলে দেশ দুটির জন্য (এবং উন্নয়নশীল আরও অনেক দেশের জন্য) কয়লাসহ বহুমুখী জ্বালানির ব্যবহার সুযোগ খোলা রাখা এমনকি অন্তবর্তী সময়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এ পটভূমিতে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিতব্য সেপ্টেম্বরের (২০২৩) জি২০ শীর্ষ সম্মেলন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কী কী পদক্ষেপ নেয় তার প্রতি বিশ্ববাসী আগ্রহভরে লক্ষ্য রাখবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ