‘বেলেম আউটকাম প্যাকেজ’ গৃহীত, বিশ্বনেতাদের আহ্বান—“কাজ এখনই, দেরি নয়”

আফরোজা আখতার পারভীন, ঢাকা

টানা উত্তেজনা, অচলাবস্থা এবং উপ্তপ্ত পরিস্থিতি আর অগ্নিকান্ডের মধ্যে কপ৩০ শেষ হলো একটি দীর্ঘায়িত ও আবেগঘন সমাপনী অধিবেশনের মাধ্যমে। নির্ধারিত সময়ের প্রায় ১৪ ঘণ্টা পরে গৃহীত হলো বেলেম আউটকাম প্যাকেজ, যা শেষ মুহূর্তে টেনে আনা এক নাজুক রাজনৈতিক ঐকমত্যের ফল।

চুক্তিটি জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসা, জলবায়ু অর্থায়ন বৃদ্ধি এবং অভিযোজন পরিকল্পনা জোরদারের প্রতিশ্রুতি দেয়—তবে স্পষ্ট সময়সীমা এবং বাধ্যতামূলক অর্থায়ন না থাকায় এটি “প্রত্যাশার বিপরীতে একটি আপস” বলে মনে করছেন ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ও নাগরিক সমাজ।

শেষ মুহূর্তের টানাপোড়েন: প্রস্তাব ভেঙে পড়ার উপক্রম

সমাপনী অধিবেশন শুরু হয় ক্লান্ত প্রতিনিধিদল ও মন্ত্রীদের দিয়ে, যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আপোসহীন অবস্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কয়েকটি বড় তেল উৎপাদনকারী দেশ ও উদীয়মান অর্থনীতির আপত্তি শেষ মুহূর্তে সমাধান করেই চুক্তি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় কপ৩০ সভাপতিমণ্ডলী।

কপ-৩০ প্রধান ব্রাজিলীয় কূটনীতিক আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো —“এই চুক্তি নিখুঁত নয়, কিন্তু এটি একটি সেতু—এখন আমাদের সাহস, দায়িত্ববোধ এবং জরুরিভিত্তি উদ্যোগ নিয়ে সেই সেতু পার হতে হবে।”তিনি বলেন, চুক্তিটি ১.৫°ডিগ্রী সেলসিয়াস লক্ষ্য “প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব” হলেও এর কার্যকর বাস্তবায়নই শেষ পর্যন্ত প্রকৃত ফলাফল নির্ধারণ করবে।

বেলেম আউটকাম প্যাকেজের মূল উপাদানগুলো

চূড়ান্ত পাঠে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে—

  • জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি (“ন্যায়সঙ্গত, ধীরে ধীরে এবং সুষম উপায়ে”),
  • ২০২৭ সালের মধ্যে পরবর্তী বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়ন কাঠামো নির্ধারণের রোডম্যাপ,
  • অভিযোজন পরিকল্পনা ও আগাম সতর্কতা ব্যবস্থার উন্নয়ন,
  • ক্রিটিক্যাল মিনারেলস বা গুরুত্বপূর্ণ খনিজের নীতিগত আলোচনার ভিত্তি,
  • নবায়নযোগ্য জ্বালানি তিনগুণ বৃদ্ধির লক্ষ্য (২০৩০ সালের মধ্যে)।

তবে জীবাশ্ম জ্বালানি ধাপে ধাপে বন্ধের স্পষ্ট সময়সূচি এবং নির্দিষ্ট অর্থায়নের অঙ্গীকারের অনুপস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে উচ্চাকাঙ্ক্ষী দেশগুলো।

সমাপনী অধিবেশনে নেতাদের মন্তব্য

বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মোটলি“কূটনীতির আপসকে জলবায়ু নিরাপত্তা মনে করা ভুল। আমাদের জন্য বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই সীমিত।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু কমিশনার হেলেনা লিন্ডবার্গ“জীবাশ্ম জ্বালানির বিষয়ে আরও শক্ত ভাষার প্রয়োজন ছিল। এখন এই চুক্তিকে সর্বনিম্ন ভিত্তি হিসেবে নিতে হবে—সর্বোচ্চ নয়।”

সৌদি আরবের প্রতিনিধি“জ্বালানি নিরাপত্তা অগ্রাহ্য করা যাবে না। প্রতিটি দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী রূপান্তর ঘটতে হবে।”

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস“আমরা বেলেম ছাড়ছি মিশ্র অনুভূতি নিয়ে: কিছু অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা পর্যাপ্ত নয়।”

বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া: ‘বহুপাক্ষিক জলবায়ু কূটনীতির সংকীর্ণ রক্ষা’

জলবায়ু নীতি বিশেষজ্ঞরা কপ৩০–কে “নাজুক ঐকমত্য”, “রাজনৈতিকভাবে জোড়া লাগানো সমঝোতা” এবং “ধ্বংস এড়ালেও রূপান্তরমূলক নয়” বলে বর্ণনা করেছেন।

গ্লোবাল ক্লাইমেট ইনস্টিটিউটের ড. লেনা হার্টমান্ন বলেন—“এই কপ ছিল সংঘর্ষপূর্ণ পরিকল্পনার লড়াই—তেল উৎপাদনকারীরা ভবিষ্যত উত্তোলনের পরিকল্পনা করছে, ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো বাঁচার পরিকল্পনা করছে, আর শিল্পশক্তি দেশগুলো জ্বালানি রূপান্তরের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করছে।”

ব্রাজিলের ভূমিকা: চাপের মধ্যে কূটনীতি

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা সমাপনী বক্তব্যে বলেন—“ঐকমত্য কোনো দেশের জয় নয়; এটি মানবতার পক্ষাঘাত কাটিয়ে ওঠার জয়।”

আর পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রী মারিনা সিলভা যোগ করেন—“বেলেম দেখিয়েছে কূটনীতি কঠিন, কিন্তু দেরি আরও মারাত্মক। আমাদের আরও দ্রুত কাজ করতে হবে।”

নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়া: ‘চুক্তি দুর্বল, গতি ধীর’

ইন্ডিজেনাস, যুব ও পরিবেশকর্মীরা সমাপনী অধিবেশন চলাকালেও প্রতিবাদ চালিয়ে যান। তারা বলেন, এই চুক্তি “বাস্তব সংকটের তুলনায় খুবই দুর্বল।”

ইন্ডিজেনাস নেত্রী সোনিয়া আরারা বলেন—“অ্যামাজন সময়ের অপেক্ষা করে না। নদী-জঙ্গল আলোচনায় বসে না। নেতাদের এখন কাজ করতে হবে, প্রতীকী প্রতিশ্রুতি দিয়ে নয়।”

পরবর্তী পদক্ষেপ

  • কপ৩১–এ জীবাশ্ম জ্বালানি রূপান্তরের ভাষা আরও শক্তিশালী করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
  • ২০২৬ সালের মধ্যে বেলেম অঙ্গীকার অনুযায়ী নবায়নকৃত NDC জমা দিতে হবে।
  • ২০২৭ সালের মধ্যে নতুন বৈশ্বিক অর্থায়ন কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে।
  • খনিজ, অভিযোজন এবং অর্থায়ন নিয়ে নতুন কর্মপ্রক্রিয়া শুরু হবে।

কপ৩০ শেষ হয়েছে একটি নাজুক কিন্তু ঐতিহাসিক আপসের মাধ্যমে। বেলেম আউটকাম প্যাকেজ একটি পথ তৈরি করেছে—তবে এটি কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে বিশ্বব্যাপী দ্রুত, আন্তরিক এবং বাস্তবায়িত পদক্ষেপের ওপর।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fifteen − five =