আফরোজা আখতার পারভীন
জলবায়ু অস্বীকারবাদ ও বিজ্ঞানবিরোধী মনোভাবের বিরুদ্ধে লুলার কড়া বার্তা
ঢাকা ১১ নভেম্বর ২০২৫: ব্রাজিলের আমাজন অঞ্চলের শহর বেলেমে সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো জাতিসংঘের ৩০তম জলবায়ু সম্মেলন (COP30)। উদ্বোধনী দিনে আয়োজক দেশ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে আহ্বান জানান, “এবার সময় এসেছে প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার।”
লুলা বলেন, “জলবায়ু জরুরি অবস্থা আসলে বৈষম্য বৃদ্ধির আরেক রূপ। বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন দারিদ্র্য ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর গভীর আঘাত হানছে।”
তিনি আরও বলেন, “বেলেমকে আয়োজক শহর হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ হলো আমাজনের বাস্তব সংকট ও মানবিক প্রভাবকে সামনে আনা।”
এই বছর কোনো বড় নতুন চুক্তি প্রত্যাশিত নয়। বরং, কপ৩০-কে বলা হচ্ছে ‘ইমপ্লিমেন্টেশন কপ’— অর্থাৎ, প্রতিটি দেশকে তাদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (NDCs) হালনাগাদ ও বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখাতে হবে।
জাতিসংঘের জলবায়ু সচিব সাইমন স্টিল বলেন, “জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে একা লড়াই নয়, আপনাদের কাজ একসাথে লড়াই করা।”
সম্মেলনের সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো স্থানীয় আদিবাসী শব্দ ‘মুতিরাও’ (একসাথে কাজ করার প্রচেষ্টা) উল্লেখ করে বলেন, “এই কনফারেন্স সফল হবে কেবল তখনই, যখন আমরা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাব।”
মার্কিন অনুপস্থিতি ও প্যারিস চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার সমালোচনা
উদ্বোধনী দিনেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
লুলা কড়া ভাষায় বলেন, “তারা প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞান ও বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করছে। এখন সময় এসেছে অস্বীকারবাদীদের আরেকটি পরাজয় দেখানোর।”
ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ড স্টেটস (AOSIS)–এর চেয়ার পালাউয়ের রাষ্ট্রদূত ইলানা সাইদ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া এই আলোচনার ভারসাম্য নষ্ট করেছে।”
তবে সাবেক মার্কিন জলবায়ু বিশেষ দূত টড স্টার্ন মন্তব্য করেন, “তারা যদি অংশ নিত, তা গঠনমূলক হতো না। বরং না আসাটাই ভালো।”
প্যারিস চুক্তির বাস্তবতা ও জরুরি সতর্কতা
দশ বছর আগে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, বর্তমান গতিতে সেই লক্ষ্য অর্জন প্রায় অসম্ভব।
চীন বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমনকারী দেশ হলেও, ইতিহাসগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদন করেছে।
লুলা ও স্টিল দুজনেই বলেন, চুক্তিটি আংশিক সফল হলেও অ্যাকশন দ্রুততর করা ছাড়া বিকল্প নেই। তারা সাম্প্রতিক দুর্যোগের কথা উল্লেখ করেন— ক্যারিবীয় অঞ্চলে হারিকেন মেলিসা, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনে টাইফুন, এবং দক্ষিণ ব্রাজিলে টর্নেডো— যা জলবায়ু বিপর্যয়ের ভয়াবহ উদাহরণ।
“জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যতের হুমকি নয়,” লুলা বলেন, “এটি ইতোমধ্যেই বর্তমান সময়ের এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি।”

উদ্বোধনী অধিবেশনের মূল দিকসমূহ
- উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট লুলা বলেন, “কপ৩০ হবে সত্যের কপ। আমরা আর অপেক্ষা করতে পারি না—পরিবর্তন ঘটাতে হবে এখনই।”
- সম্মেলনের সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো জানান, বিতর্কিত বিষয় যেমন জলবায়ু অর্থায়ন, বাণিজ্যিক পদক্ষেপ এবং স্বচ্ছতা নিয়ে বিশেষ পরামর্শ ও পরবর্তী সপ্তাহে একটি স্টক-টেকিং অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
- জাতিসংঘ সচিব সাইমন স্টিল বলেন, “আমরা এখন নির্গমন কমাতে সঠিক পথে বাঁক নিচ্ছি, কিন্তু গতি অনেক বাড়াতে হবে।”
মূল পর্যবেক্ষণ
- আলোচ্যসূচি সহজভাবে গ্রহণ হওয়ায় কপ৩০ শুরু হয়েছে ইতিবাচক নোটে। তবে অর্থায়ন, জ্বালানি রূপান্তর ও বাণিজ্য-সম্পর্কিত পদক্ষেপে বড় মতবিরোধ রয়ে গেছে।
- আপডেটেড NDC অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে নির্গমন হ্রাসের প্রক্ষেপণ প্রায় ১২%, যেখানে প্রয়োজন ৬০% — এই ব্যবধানই বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নির্দেশ করছে।
- অভিযোজন, প্রযুক্তি ও প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান নিয়ে আলোচনা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করতে পারে— যদি অর্থায়ন নিশ্চিত হয়।
আগামী দিনগুলোতে নজর রাখার বিষয়
- বিতর্কিত বিষয়গুলোর (অর্থায়ন, ট্রেড ও স্বচ্ছতা) আলোচনায় অগ্রগতি হয় কিনা
- অভিযোজন ও লস-অ্যান্ড-ড্যামেজ ফান্ডে নতুন অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি আসে কিনা
- বড় নির্গমনকারী দেশগুলো বাস্তব পদক্ষেপ নেয় কিনা
- প্রযুক্তি ও প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানগুলো কিভাবে বাস্তবে প্রয়োগ হয়