বেশি দূষণকারী ডিজেল আমদানি অযৌক্তিক

মুশফিকুর রহমান: বেশ কিছুদিন ধরেই সংবাদ শিরোনামে লেখা হচ্ছে ‘ফের দূষিত বাতাসে শীর্ষে ঢাকা।’ বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বায়ুমান সূচকের নিয়মিত পরিবীক্ষণ ফলাফল এয়ার কোয়লিটি ইনডেক্স (একিউআই) দেখে বোঝা সম্ভব ঢাকা নগরীর বায়ুমান সাধারণ ভাবে শীত মৌসুমে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে, ২২ জানুয়ারি ২০২৩ সকাল ৭টায় একিউআই অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহর ছিল ঢাকা। এসময় প্রতি ঘনমিটার বাতাসে দূষণের বিপদজনক উপাদানের (অতি সূক্ষ ভাসমান বস্তুকণা) উপস্থিতি ছিল ২৬৬ মাইক্রোগ্রাম। একিউআই সূচক অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার বাতাসে অতি সূক্ষ ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতি ৫০ মাইক্রোগ্রাম-এর মধ্যে সীমিত থাকলে তাকে স্বাস্থ্যকর (ভালো), ৫১-১০০-এর মধ্যে থাকলে তাকে সহনশীল, ১০১-১৫০-এর মধ্যে থাকলে সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীর (শিশু, বয়োবৃদ্ধ ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষ) জন্য অস্বাস্থ্যকর, সূচক ১৫১-২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং সূচক ৩০০ অতিক্রম করলে বিপদজনক মাত্রায় দূষিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বায়ুমান সূচকে বাতাস দূষণ অসহনীয় থেকে বিপদজনক হলে ঘরের বাইরে মানুষের বেশীক্ষণ অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। নইলে অসুস্থ হবার ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু বাস্তবে তেমন বিলাসিতা কমজনের পক্ষেই সম্ভব। ২২ জানুয়ারি ২০২৩ ঢাকার বাতাস উল্লিখিত সূচক অনুযায়ী বিপদজনক মাত্রায় দূষিত (প্রতি ঘনমিটার বাতাসে অতি সূক্ষ ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতি ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ছাড়িয়ে গিয়েছিল) হিসেবে রেকর্ড করা হয়। এখন প্রায় নিয়মিত দেশের বাতাসের বিপদজনক দূষণের সতর্ক বার্তা জানানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের ঈষবধহ অরৎ ধহফ ঝঁংঃধরহধনষব ঊহারৎড়হসবহঃ চৎড়লবপঃ এর বিবেচনায় দেশে বায়ু দূষণের প্রধান উৎস ইটভাটা এবং যানবাহনের দূষণ। সম্মিলিত ভাবে এই দুই উৎস থেকে প্রায় ৭০% বায়ুদূষণ ঘটে। তাছাড়া, শিল্প কারখানা, বায়োমাস জ্বালানি সহ ক্ষতিকর কঠিন বর্জ্য (যেমন পলিথিন) পোড়ানো, নির্মাণ কর্মকাণ্ডে (শহরের বিরতিহীন খোঁড়াখুড়ি, নির্মাণ সামগ্রী ছড়িয়ে রাখা ও পরিবহন) ইত্যাদি থেকেও ব্যাপক বায়ুদূষণ ঘটে। দেশে শহর ও নগরাঞ্চলে মোটরগাড়ি, মোটরসাইকেল সহ যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে কিন্তু সেগুলি মানস্পন্ন, কারিগরি ভাবে চলাচল উপযোগী কি না তা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা অনুপস্থিত। ফলে অত্যন্ত পুরোনো ও উচ্চমাত্রায় দূষণকারী যানবাহন অবাধে রাস্তায় চলাচল করছে। সেই সাথে যানবাহনে ব্যবহৃত জ্বালানি তেল ও লুব্রিকেন্ট এর মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও অত্যন্ত শিথিল।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক দেশের বায়ুমান নিয়ে পরিচালিত সমীক্ষায় (ইৎবধঃযরহম ঐবধাু-ঘবি ঊারফবহপব ড়হ অরৎ চড়ষষঁঃরড়হ ধহফ ঐবধষঃয রহ ইধহমষধফবংয, ২০২২) ২০১৩-২০২১ সময়কালে সংগৃহীত তথ্য পর্যালোচনা করে জানিয়েছে, যে বাংলাদেশে উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের (প্রধানত অতি ক্ষুদ্র ভাসমান বস্তুকণার দূষণ) কারণে ২০১৯ সালে প্রায় ৭৮,১৪৫-৮৮,২২৯ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বায়ুমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০১৯ সালে আমাদের দেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত এবং ঢাকা (২০১৮-২০২১ সময়কালে) দ্বিতীয় শীর্ষ দূষিত নগরী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাছাড়া, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল সময়কালে বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুর পাঁচ প্রধান কারণের মধ্যে চারটি বায়ুদূষণের সাথে সম্পর্কিত ছিল। উল্লিখিত সমীক্ষা অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে দেশে নিয়মিত ও অপরিকল্পিত নির্মাণ কর্মকাণ্ডের (বাড়িঘর, রাস্তা এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ ও নির্মাণসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড) এবং পথঘাটে প্রায় স্থবির যানজটের দায় সবচেয়ে বেশি। দেশে বায়ুদূষণে দ্বিতীয় প্রধান ভূমিকা পালন করে ইটভাটা।

বিশ^ব্যাংকের উল্লিখিত সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে বায়ূদূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সাথে সে সময়ে দেশের জিডিপি’র প্রায় ৩.৯-৪.৪ শতাংশ ক্ষতির কারণ হিসেবে বায়ুদূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা দূষিত বাতাসে উপস্থিত ভাসমান অতিক্ষুদ্র (পিএম ২.৫) বস্তুকণা, ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ১০), ভূ-উপরিস্থিত ওজোন গ্যাস, নাইট্রোজেনের অক্সাইড, সালফার অক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসকে জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রধান উদ্বেগের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আগামীতে শিল্পায়ন ও নগরায়নের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ সমস্যার অবনতি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে মানুষের রোগ বালাই মোকাবেলার ব্যয় ও ঝুঁকি উভয়ই বাড়বে। বায়ুদূষণের কারণে সৃষ্ট রোগ বালাই মোকাবেলার জন্য দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া অপরিহার্য ।

দেশে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করা হয় যার সিংহভাগ (প্রায় ৭০%) যানবাহনে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন মানের ডিজেলে বিভিন্ন মাত্রায় প্রাকৃতিক সালফার উপস্থিত থাকে। তেল পরিশোধনের সময় ডিজেলে উপস্থিত সালফার অপসারণের সাথে বাজারজাত করা ডিজেলের মূল্যের সম্পর্ক রয়েছে। কম সালফার সমৃদ্ধ ডিজেলের দাম বেশি। কিন্তু যানবাহন (ডিজেল কার, ট্রাক, নৌ এবং সমুদ্র পরিবহনের জাহাজ, রেল ইঞ্জিন ইত্যাদি) এবং অন্যান্য ইঞ্জিনে (সেচযন্ত্র, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, বিভিন্ন নির্মাণ ও পরিবহন যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ) জ্বালানি হিসেবে ডিজেল পোড়ালে উদ্গীরণ করা ধোঁয়ায় অন্যান্য দূষণ উপাদানের (অতিক্ষুদ্র ভাসমান বস্তুকণা, নাইট্রোজেনের অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস এবং অন্যান্য বিষাক্ত বায়ুদূষণ উপাদান) সাথে সালফারের যৌগ (প্রধানত সালফারের অক্সাইড) নির্গত হয় যা বায়ুদূষণের উপাদান। তাছাড়া, জ্বালানি ডিজেলে সালফারের উপস্থিতি ইঞ্জিনের ক্ষয় ত্বরান্বিত করে। বাতাসে সালফার অক্সাইড দূষণ বাড়লে এসিড বৃষ্টি’র ঝুঁকি বাড়ে ।

প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) উচ্চ সালফার যুক্ত ডিজেল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে (বিপিসি দেশে ডিজেল সহ জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন করে)। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) আমদানিতব্য ডিজেলে সালফারের অনুমোদিত পরিমাণ সম্পর্কিত বিদ্যমান বেঞ্চমার্ক (৫০ পিপিএম) শিথিল করেছে। গত ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আমদানিতব্য ডিজেলে সালফারের বর্ধিত মাত্রা (৩৫০ পিপিএমযুক্ত ডিজেল) অনুমোদন দেবার সিদ্ধান্ত হয়, যাতে বিপিসি অন্তত ২০% উচ্চ সালফারযুক্ত ডিজেল আমদানি ও বিপণন করতে পারে। বিপিসি তুলনামূলক কম মূল্যে উচ্চ সালফারযুক্ত ডিজেল আমদানির মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে বছরে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা অর্থ সাশ্রয়ের আশা প্রকাশ করেছে। একসময় দেশে ৫০০ পিপিএম পর্যন্ত সালফারযুক্ত ডিজেলও আমদানি হতো। দেশে বায়ুদূষণ হ্রাস করবার তাগিদে বিএসটিআই ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর ডিজেলে অনুমোদিত সালফারের পরিমাণ নির্ধারণ করে সর্বোচ্চ ৫০ পিপিএম।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ দেশে বায়ুদূষণের তীব্রতায় জনস্বাস্থ্য কিভাবে বিপন্ন হচ্ছে তার বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে সাবধান করছেন। বায়ুদূষণ বেড়ে চলার অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি এবং জিডিপিতে তার প্রভাব সম্পর্কিত তথ্য বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও বিপিসির যৎসামান্য ‘ব্যয় সাশ্রয়ের’ জন্য উচ্চমাত্রার সালফার যুক্ত ডিজেল আমদানি ও বিপণনের সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক তা ভেবে দেখার বিষয়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে ক্লিক করুন: পরিবেশ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four + one =