বৈদ্যুতিক আলোয় উদ্ভাসিত বাংলাদেশ

ড. আজাদ শাহরিয়ার: একছটা আলো বদলে দিয়েছে সমগ্র বাংলাদেশকে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন,সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, কর্মময় জীবন ও জীবিকার অবধারিত পথ উন্মোচন এসবই সম্ভব হয়েছে বিদুৎপ্রাপ্তির সহজলভ্যতার কারণে। ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে দেশে বিদুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্হায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশের সর্বত্র বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে। দেশের শতভাগ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। ২০০৯ বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে দেশে সাকুল্যে  বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল  ৪২০০ মেগাওয়াট। তখন দিনের অধিকাংশ সময় লোডশেডিং হতো। বিদ্যুৎ সুবিধা খুব কম পাওয়া যেতো। বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৫৬ মেগাওয়াট।  আর গত ১৬ এপ্রিল ২০২২ এ দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো বিবেচনায় স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো অর্জন বিদ্যুৎ খাত। যেখানে শতভাগ মানুষকে বিদুৎ সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। আজ থেকে দুদশক আগেও অনেকেই বিশ্বাস করেনি ২০২১ সালের মধ্যে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ কর্মসূচির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে । বর্তমান সরকারের সময়াবদ্ধ পরিকল্পনার মাধ্যমে বিদ্যুৎখাতের এ সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

আমরা যদি পিছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব সদ্য স্বাধীন দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দায়িত্ব নিয়েই তিনটি মৌলিক কাজ করেছিলেন। সেগুলো হলো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করা, জ্বালানি অনুসন্ধান, আহরণ ও ব্যবহারের জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং এসব কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য দক্ষ নেতৃত্ব ও জনবল তৈরিসহ তাদের ক্ষমতায়িত করা। বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। সদ্য স্বাধীন দেশের হাজারো সমস্যার মাঝেও তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি পেট্রোবাংলাকে গড়ে তুলে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তেল গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনের। আর পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে একত্রিত করে গঠন  করে ছিলেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। আর খনিজ সম্পদ কয়লা, কঠিন শিলাসহ অন্যান্য অনুসন্ধান, উন্নয়ন কাজ করার জন্য গঠন করে ছিলেন বাংলাদেশ মিনারেল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম ‘মেরিটাইম বাউন্ডারি আইন’ প্রণয়ন করে। বঙ্গবন্ধু তেল গ্যাসসহ নানা  সম্পদ বঙ্গোপসাগরে পাওয়ার সম্ভবনার বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন তখন দেশে বিদুৎ উৎপাদন হতো ২ শত মেগাওয়াটের কিছু বেশি যা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল ছিল। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশের  সব মানুষকে বিদুৎ সুবিধার আওতায় আনার। আর তাই তিনি মানুষের বিদ্যুৎ পাওয়ার বিষয়টিকে অধিকার হিসেবে সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছিলেন। তৎকালীন বিশ্বে যা ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিম জার্মানির সহায়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু আশুগঞ্জ ও ঘোড়াশালে বিদ্যুৎ  উৎপাদন হাব স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। বিগত এক দশক ধরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত হারে বেড়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এশিয়ার সকল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি  প্রবৃদ্ধি  হার ছিল সবচেয়ে বেশি ৮.১৫ শতাংশ। দেশের কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে বিদ্যুতের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান এ চাহিদা পূরনের জন্য বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসময়ে অর্থাৎ ২০৩০ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুতের সম্ভব্য চাহিদা হবে ৩৩ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪০ সম্ভব্য চাহিদা বাড়বে ৫২ হাজার মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে মাথাপিছু বিদ্যুতের পরিমাণ ছিল ২২০ কিলোহার্জ, বর্তমান মাথাপিছু বিদ্যুতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬০ কিলোহার্জ। যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৭০০ কিলোহার্জ। ২০৩০ এ লক্ষ্যমাত্রা ৮১৫ এবং ২০৪১ এ লক্ষ্যমাত্রা ১৪৭৫ কিলোহার্জ। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। যার মাধ্যমে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান পরিমাপ করা সম্ভব। দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, শিল্পায়ন, কৃষি ও সেবা খাতের বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে প্রচলিত পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থা যেমন সৌরবিদ্যুত, জলবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে এ বর্ধিত চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে তিনটি সোর্স থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে থাকে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ( বিপিডিবি), বেসরকারি সোর্স এবং গ্রামীণ বিদ্যুৎ কোম্পানি থেকে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের কাজটি করে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অভ বাংলাদেশ লিমিটেড ( পিজিসিবি)। আর বিতরণের কাজ করে ছয়টি প্রতিষ্ঠান এগুলো হলো বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি), বাংলাদেশ রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন বোর্ড ( আরইবি),ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি( ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি ( ডব্লিউজেডপিডিসি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিঃ(ওজোপাডিকো)এবং নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লি. ( এনইএসকো)।

২০১০ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরের পরিকল্পনায় কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ১৬ হাজার ৮৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৪৮ টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন,২ হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ২০ টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে।  সরকারের আরও  ১৫ হাজার ৬৬৯ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৯ টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে বিদ্যুতের সিস্টেম লস ১৪.৩৩ শতাংশ থেকে কমে ৮.৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ২২ লাখ। প্রি-পেইড মিটার স্হাপন করা হয়েছে ৪৮ লাখ ৩১ হাজার ৬০৭টি।

বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে গৃহীত মেগা- প্রকল্পসমূহের অন্যতম রামপাল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা ভিত্তিক মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র,মাতার বাড়ি ১ হাজার ২ শত মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আল্ট্রাসুপার ক্রিটিকাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রূপপুর ২ হাজার ৪ শত মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইতিমধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৭ শত মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। সোলার সিস্টেম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬০ লাখ। দেশে মোট সঞ্চালন লাইন আছে ১৩ হাজার ৪০২ কিলোমিটার এবং বিতরণ লাইন আছে ৬.২২ লাখ কিলোমিটার। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইন ২৮ হাজার কিলোমিটার এবং বিতরণ লাইন ৬.৬ লক্ষ কিলোমিটারে উন্নীত করার লক্ষ্য পরিকল্পনা করা হয়েছে।

মুজিব শতবর্ষে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা বাংলাদেশের জন্য এক মাইলফলক। এর মাধ্যমে সরকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের বিদ্যুৎ পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার পূরণ করতে সক্ষম হলো। এখন বৈষম্যহীনভাবে দেশের সব মানুষের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়াই সরকারের জন্য সবচেয়ে বড়ো চ্যলেঞ্জ। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ২০৩০ সালে এসডিজি এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব হবে এটাই প্রত্যাশা।

পিআইডি ফিচার

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × 3 =