ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিশা

নাহিন আশরাফ

নুসরাত ইমরোজ তিশাকে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষই তাকে এক নামে চেনেন। অভিনয় জগতে বেশ দাপটের সাথে অভিনয় করছেন। ন্যাচারাল অভিনয়, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও চমৎকার বাচনভঙ্গির জন্য সবার প্রশংসা কুড়িয়ে থাকেন তিনি।

মিডিয়ায় তিশার যাত্রা শুরু হয়েছিল শিশুশিল্পী হিসেবে। ১৯৯৫ সালে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিশা, সেই থেকে তার টেলিভিশনে কাজ শুরু। শিশুশিল্পী হিসেবে গানও গাইতেন তিনি। তিশা এঞ্জেল ফোর নামের একটি ব্যান্ড দলও গঠন করেছিলেন। নতুন কুঁড়িতে অংশগ্রহণের দুবছর পর ১৯৯৭ সালে ‘হীরার সাতপেড়ে কাব্য’ নামে একটি নাটকে অভিনয় করেন। এটিই তার প্রথম কাজ। শুরু থেকে তিশা তার অভিনয় দক্ষতার জন্য সবার নজর কেড়েছেন। ২০১৪ সাল থেকে তিনি বিজ্ঞাপনে কাজ শুরু করেন। ছোট পর্দার অভিনেত্রী হিসেবে তার জনপ্রিয়তা বেশি থাকলেও, তিনি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘টেলিভিশন’, ‘ডুব’, ‘হালদা’ ইত্যাদি। সম্প্রতি ‘মুজিব’ সিনেমায় বেগম মুজিবের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এই সিনেমার মধ্যে দিয়ে সকলের প্রশংসা পান।

মুজিব সিনেমার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানান, যে ভালোবাসা তিনি এ সিনেমায় অভিনয় করে পেয়েছেন তার কথা তিনি সারাজীবন মনে রাখবেন। ১৩ অক্টোবর সারা দেশে মুক্তি পায় ‘মুজিব’। এটি পরিচালনা করেছেন ভারতের খ্যাতিমান পরিচালক শ্যাম বেনেগাল। সহযোগী পরিচালক ছিলেন দয়াল নিহালানি। সিনেমা মুক্তির পর তিশা জানান, অসংখ্য মানুষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন পান তিনি। বঙ্গমাতা চরিত্রে কাজের সুযোগ পাওয়ার পর যেমন খুশি হয়েছিলেন, তেমন কিছুটা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। কারণ এটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। তিনি নিজের সবটুকু দিয়ে অভিনয় করতে পারবেন কি না তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছিলেন। তবে সবার ভালোবাসায় আমি সঠিকভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি, এমনটাই বলেন তিনি। শুটিং শুরু করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময় প্রধানমন্ত্রী তাকে নিজের মায়ের বর্ণনা দেন, যা তাকে অনেক সাহায্য করেছিল। মুজিব সিনেমাটি শুধু একটি সিনেমা ছিল না এটা তিশার কাছে দায়িত্ব ছিল, কারণ এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম আমাদের দেশের ইতিহাস জানবে।

অভিনয়ের ক্ষেত্রে তিশা কখনো আপস করেন না, কঠোর পরিশ্রম তাকে আকাশ ছুঁতে সাহায্য করেছে। তিনি দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র ও দশবার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পান। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ সিনেমাটি অস্কারের বিদেশি ভাষা বিভাগে প্রতিযোগিতায় মনোনয়নের জন্য বাংলাদেশ ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটিজ ও ৮৩তম অস্কার বাংলাদেশ কমিটি নির্বাচিত করে। যতবার পুরস্কৃত হয়েছেন ততবার তার মনে হয়েছে এখন দায়িত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে। সফলতার শীর্ষে যাওয়ার পরেও তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই কারণ তিশা মনে করেন গাছ যত বড় হবে তত তার শেকড় মাটিকে আঁকড়ে রাখবে। জীবনে বিনয়ী হওয়াটা খুব প্রয়োজন বলে মনে করেন এই গুণী অভিনেত্রী।

তিশার কথা বললে আরেকজনের কথা বলতেই হবে তিনি হলেন জনপ্রিয় পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ২০১০ সালে ১৬ জুলাই তিশা ও ফারুকী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বাংলাদেশের জনপ্রিয় কিছু তারকা জুটির মধ্যে তারা অন্যতম। যেখানে মিডিয়ায় জুটিদের কাদা ছোড়াছুড়ি থেকে কত সমালোচনা সেখানে সফলভাবে কাজ করে গুছিয়ে সংসারও যে করা যায় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ তারা দুজনে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের খুনসুটি ও একে অপরকে সম্মান করা দেখে মুগ্ধ ভক্তরা। তিশার সকল বিষয়ে অকপটে কথার বলার পদ্ধতি পছন্দ করেন সকলে। কিছুদিন আগে তিশার কিছু কথা গণমাধ্যমে ভাইরাল হয় তা হলো ‘আমি এক পাগলের সাথে সংসার করছি’। তার এই কথা বলার কারণ হচ্ছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ সিনেমার শুটিং চলাকালীন সময় ডাবিং হয়ে গেছে। রিলিজও পেয়ে গেছে, বুসানেও চলে গেছে। এরপর আচমকা ফারুকী তার ঘুমের মধ্যে একটি সিন দেখেন সেই সিন শুট করার জন্য আবার সবাইকে ব্যস্ত হতে হয়। সেজন্য শুটিংয়ের ফাঁকে স্বামীকে পাগল বলেন তিনি। তাদের দুইজনের খুনসুটি বেশ পছন্দ করেন ভক্তরা। চলতি বছর তাদের বিয়ের ১৩ বছর। সে উপলক্ষ্য কেন্দ্র করে তিশা আবার বউ সাজেন। তিশাকে দেখা যায় সাদা জামদানি ও মেহেদি রাঙা হাতে। আর সেই শাড়িটি ছিল তিশার বিয়ের শাড়ি। ঢাকার কাছেই হিজল তমাল নামে একটা পিকনিক স্পটে তারা ফটোশুট করেন। সেদিন তিশাকে নিয়ে আবেগ ঘন স্ট্যাটাস লেখেন ফারুকী। জানান, এখনো তিশাকে ছাড়া বিদেশ গেলে বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে পারেন না তিনি। বড় থেকে ছোট সব বিষয়ে তিনি আজও তিশার উপর নির্ভরশীল।

প্রায়ই তিশাকে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞাসা করা হয় সংসার সুখী রাখার রহস্য কি? এই জবাবে তিনি বলেন, যেকোনো সম্পর্কে খুনসুটি হতেই পারে, আমাদেরও হয়। কিন্তু সেই সমস্যা দীর্ঘ সময় আঁকড়ে রাখা যাবে না। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া থাকাটা খুব প্রয়োজন। অন্যান্য মিডিয়ার মানুষদের মতো তিশাকেও অনেক সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি তাকে নিয়ে যা সমালোচিত হয়েছিল তা হলো ‘বাচ্চা নিচ্ছেন না কেন?’। এ প্রশ্ন তিশাকে সবসময় বিভ্রান্ত করতো। কিন্তু তিশা সবসময় বলতেন, ‘লোকের কাজই কথা বলা, তারা বলবেই কিন্তু নেগেটিভ কথা কানে নেওয়ার কিছু নেই। আমাকে যে সবাই বাচ্চা নিতে বলে আমার বাচ্চা হলে মানুষ করার দায়িত্ব তো আমাকেই নিতে হবে। তাই আমি যখন নিজেকে মা হবার জন্য প্রস্তুত মনে করব তখনই বাচ্চা নিব’। তার এই সহজ স্বীকারোক্তি ছিল সবসময়। তিশা সব সময় চেষ্টা করেন নেগেটিভ ব্যাপার না দেখে কারা পজিটিভ কথা বলছে তাদের নিয়ে ভাবতে।

বিয়ের ১১ বছর তিশার কোল জুড়ে আসে তার প্রথম সন্তান ইলহাম। কন্যা পৃথিবীতে আসবার পর থেকে তিশার জীবনযাপন অনেক বদলে গেছে। ছোট থেকে তিশা ছিলেন পরিবারের সবার আদরের। বাবা ছিলেন তার বন্ধুর মতো, সব আবদারের জায়গা ছিলেন তার বাবা। এছাড়া মামা, চাচা ও খালারাও তাকে বেশ আহ্লাদ করতেন। বিয়ের আগে কোনোদিন কিছুর দায়িত্ব নিতে হয়নি তাকে। কিন্তু ইলহাম আসবার পর তার দায়িত্ব যেন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এখন তিশার জীবনে যেকোনো কিছুর আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইলহাম। সারাক্ষণ তার চিন্তা থাকে মেয়েকে ভালো করে মানুষ করার। কিন্তু তিনি সবসময় বলেন, তিনি কন্ট্রোল করতে পছন্দ করেন না, এমনকি তিনি তার মেয়েকেও কখনো কন্ট্রোল করার চেষ্টা করবেন না। মেয়েকে সঠিক পথ দেখাবেন কিন্তু কোনো পথে সে হাঁটবে সেটা একান্তই তার ব্যাপার হবে। তিশার তার মেয়েকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে বড় করতেন চান। তিশা গণমাধ্যমে জানান, ‘মা হিসেবে আমাকে আরো ধৈর্যশীল হতে হবে বলে আমি মনে করি। এছাড়া আমি জীবনে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার চেষ্টা করি, ঠিক তেমনি মাতৃত্বও উপভোগ করছি। মা হিসেবে প্রতিদিন নতুন অনেক কিছু শিখছি।’

ব্যক্তিজীবনে তিশা সাধারণত থাকতে খুব ভালোবাসেন। খুব জাঁকজমকপূর্ণ জীবন তাকে টানে না। নিজের যত্ন বলতে তিশা খাঁটি নারকেল তেল ব্যবহার করেন ত্বকে ও চুলে। শুটের জন্য মেকআপ ব্যবহার করতে হলেও অন্য সময় তিনি একদম মেকআপ ছাড়া থাকেন। পোশাকের ক্ষেত্রে তিনি দেশীয় পোশাককে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেন। তিশা বিশ্বাস করেন কেউ যদি ভেতর থেকে সুন্দর হয় তবে তার প্রকাশ বাইরেও হবে। তাই তিনি সবসময় নিজেকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করেন। নিজের বাইরের রুপকে যত্ন নেওয়ার চাইতে মনের যত্ন নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে। হতাশা, কষ্ট সবকিছুকে দূরে রেখে তিনি বাঁচতে চান। এটিই তার রুপের মূল রহস্য।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fourteen − ten =