ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কের যে সীমানার মধ্যে প্রয়াত কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের বাড়ি, সেখানে ভাঙার কাজ শুরু হওয়ায় উদ্বেগে পড়েছেন তার স্ত্রী অধ্যাপক দিলারা হাফিজ। তিনি বলেছেন, বাড়িটি ‘দখল করে হাউজিং তৈরির’ ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আর গণপূর্ত অধিদপ্তর বলছে, বাড়ি ভাঙার বিষয়ে তারা ‘কিছুই জানে না’। খবর বিডিনিউজ
কবির স্ত্রী দিলারা হাফিজ বলেছেন, আশির দশকে ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কের ১৩৯/৪ এ বাড়িটি চারটি পরিবারকে সরকার থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারও আছেন। ওই বাড়িটির পশ্চিমাংশ, কম-বেশি ৫ কাঠা বরাদ্দ পান দিলারা হাফিজ। সেখানকার বাড়িতে এখনো থাকেন কবির স্ত্রী অধ্যাপক দিলারা হাফিজ, তার সন্তানরা আছেন প্রবাসে।
যে অংশটি ভাঙা হয়েছে, সেটি ‘আরেকজনের নামে বরাদ্দকৃত’ বলে জানিয়েছেন দিলারা হাফিজ। এই মুহূর্তে কবির বাড়ির অংশ ভাঙা না পড়লেও, যে কোনো মুহূর্তে ‘সেটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে’ বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কবি পত্নী।
দিলারা হাফিজ বলেন, “বাড়িটি কিছু লোক দখল করার জন্য অনেক বছর থেকেই লেগে আছে। এ নিয়ে আদালতেও আমরা দৌড়ঝাঁপ করছি। কিন্তু কয়েক মাস ধরে বাড়িটি ছাড়তে আমাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে।”
পাশেই একটি ফ্ল্যাটে জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়েছেন জানিয়ে দিলারা হাফিজ বলেন, “আমাকে তো কিছুদিন ধরেই বাড়ি ভাঙতে চাপ দিচ্ছে। আমি এখন বাড়িটির পাশেই একটি ফ্ল্যাটে কিছু মালামাল তুলেছি। আজকে আমার অংশটি ভাঙা হয়নি। হয়তো বুঝতে চাইছে, কী প্রতিক্রিয়া হয়। এরপর হয়তো কালই ভেঙে ফেলবে।”
এদিকে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ ২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী এ এস এম সানাউল্লাহ জানিয়েছেন ওই বাড়িটি ‘গণপূর্ত অধিদপ্তর ভাঙছে না’।
তিনি বলেন, “গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বাড়িটি ভাঙলে আমি জানতাম। আমার কাছে এ ধরনের কোনো খবর নেই। তার মানে সরকারি প্রতিষ্ঠান ওই বাড়িটি ভাঙছে না।”
বুধবার বাড়িটিতে সরেজমিনে দেখা গেছে বাড়ির কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাড়ির ভাঙার ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশাল মিডিয়ায়। একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারজয়ী কবি রফিক আজাদের বাড়ি ভাঙার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
গত ১১ এপ্রিল বাড়িটি রফিক আজাদের নামে স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টাকে চিঠি লিখেছেন দিলারা হাফিজ।
চিঠিতে তিনি বলেন, “১৯৮৮ সাল থেকে আমি দিলারা হাফিজ, শিক্ষা ক্যাডারের একজন প্রভাষক হিসেবে বরাদ্দপ্রাপ্ত উপর্যুক্ত এই বাড়িতে বসবাস করছি। চাকুরিজীবনের শেষভাগে সরকারি তিতুমীর কলেজে ৪ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন শেষে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকার একজন চেয়ারম্যান হিসেবে চাকুরি-জীবন থেকে অবসরে যাই।”
২০১২ সালে নেহাল নামে এক ব্যক্তি ভুয়া দলিলের মাধ্যমে বাড়িটির পক্ষে তার নিজের মালিকানার রায় পেলে সরকারের পক্ষভুক্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে জজকোর্টে একটি মামলা রজু করা হয় বলে জানিয়েছেন দিলারা হাফিজ।
তিনি বলেন, “এই মামলা পরিচালনায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করি নিজস্ব তহবিল থেকে। পরবর্তী সময়ে মামলায় কথিত নেহাল সাহেব হেরে গেলে বাড়িটি সরকারের মালিকানা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।”
কবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদ প্রয়াত হন ২০১৬ সালে । এই বাড়িতে বসে তিনি বহু কবিতা ও কাব্য রচনা করেছেন। রফিক আজাদ তার আত্মজীবনী ‘কোনো খেদ নেই’ এই বাড়িতে বসেই রচনা করেছিলেন বলেও জানিয়েছেন দিলারা হাফিজ।
১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতাটি রচনার জন্য রফিক আজাদ সাহিত্যে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন।
দিলারা হাফিজ বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো সুবিধা বিগত সরকারের কোনো আমলেই তিনি গ্রহণ করেননি।”
রফিক আজাদের স্মৃতি রক্ষায় বাড়িটি রফিক আজাদের নামে বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দিলারা হাফিজ।
দিলারা হাফিজ বলেন, “বাড়িটি কবি রফিক আজাদের পদচারণায় একদিন মুখর ছিল, তার অসংখ্য রচনায় কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে এই বাড়িটি। সেই বিবেচনাবোধ থেকে কবির স্মৃতি সংরক্ষণের জন্যে এই বাড়িটি (কম-বেশি ৫ কাঠা, অংশবিশেষ) ‘কবি রফিক স্মৃতি পর্ষদের’ নামে স্থায়ী বন্দোবস্তের আবেদন করেও ইতোপূর্বে কোনো সহযোগিতা পাইনি।”
দিলারা হাফিজ নিজেও কবি। গবেষণাগ্রন্থ, আত্মজীবনী, স্মৃতি-উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ মিলে ১৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে তার।এছাড়া দেশের পিছিয়ে পড়া বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য বিটিভিতে সবার জন্যে শিক্ষা কার্যক্রমের গবেষণা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন দুই দশকের বেশি সময়ব্যাপী। সরকারি মিরপুর বাংলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছেন।
দেশের অন্যতম প্রধান কবি এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কবি রফিক আজাদের সার্বিক অবদান মূল্যায়ন করে তার স্মৃতি সংরক্ষণ ও ধারণের জন্যে বাড়িটির অংশবিশেষের স্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন দিলারা হাফিজ।