নূরজাহান
অবসরে কিংবা কাজের ফাঁকে ফেসবুকে স্ক্রল করতে থাকি আমরা। স্ক্রল করতে করতে কারো ছবিতে লাইক আবার কারো ছবিতে কেয়ার। অন্যদিকে কারো পোস্টে লাভ রিয়েক্ট আবার কারোটাতে হা হা। কারো পোস্টে মন্তব্য করার জন্য আমরা বেছে নেই নানা ইমোজি। আপনি জেনে অবাক হতে পারেন ইমোজির একজন জনক রয়েছেন। সেই ভদ্রলোকের নাম শিগেটাকা কুরিতা। কখনো ভেবে দেখেছেন পৃথিবীতে কত শত ইমোজি রয়েছে! হয়তো ভাবেননি। আচ্ছা ইমোজি মূলত কি এটা ভেবে দেখেছেন! এটা নিশ্চয়ই ভেবেছেন। ইমোজি অনেকের কাছেই নিজের ইমোশন এক্সপোজ করা পাশের মানুষটার কাছে। সহজ বাংলায় বললে, মানুষের অনূভুতির আর হরেক রকমের মুখভঙ্গির সমন্বয়ে তৈরি হওয়া একটা ডিজিটাল সিম্বল। একটা ইমোজি দিয়ে আপনি নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে ফেলতে পারেন; এটা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। কমিউনিকেশনের দিক থেকে ইমোজি কিন্তু খুবই পাওয়ারফুল আইকন। অনেকের বড় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে একটা ইমোজি নিয়ে। আবার একটা ইমোজি অনেক সমস্যাকে সেকেন্ডের মধ্যে সমাধান করে ফেলতে সক্ষম। ইমোজি একটা জাপানি শব্দ। জাপানিজ ভাষায় ই(e) বলতে বোঝায় ছবি আর মোজি (moji) অর্থ হলো অক্ষর। ইমোজি মানে ছবি অক্ষর।
প্রথম ইমোজি তৈরি হলো কবে! ১৯৯৯ সালে সিজেতাকা কুরিতা নামের এক ব্যক্তি প্রথম ইমোজি তৈরি করেন। তিনি ছিলেন একজন জাপানি নকশাকার। যখন প্রথম ইমোজি নিয়ে কাজ করেন তখন তিনি ১৭৬টি ক্ষুদ্রাকার ছবি এঁকেছিলেন। মাত্র তিন কিলোবাইট জায়গা নেওয়া এই ছবিগুলোয় প্রকাশ পেয়েছিল নানা অনুভূতি। জাপানি টেলিকম প্রতিষ্ঠান এনটিটি ডোকোমোর জন্য কাজটি করেছিলেন শিগোতাকা। ১২ পিক্সেলের (১৪৪টি ডট) মধ্যে ১৭৬টি ভাবনা ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে। মানুষ, জায়গা, অনুভূতি; সবকিছুই ছিল তার সেই আঁকা ইমোজিতে। সেদিনের সিজেতাকা কুরিতার সেই ভাবনা থেকেই আজকের এই ইমোজির সৃষ্টি। কিন্তু ১৮৮১ সালে অর্থাৎ আমাদের পরিচিত ইমোজির জন্মের প্রায় ১০০ বছর পূর্বে আমেরিকান হিউমার ম্যাগাজিনে ইমোজির প্রাচীন পূর্বপুরুষ ইমোটিকন প্রকাশিত হয়। যেগুলো বিভিন্ন বিরাম চিহ্ন এবং টাইপোগ্রাফিক ক্যারেক্টার দিয়ে তৈরি করা হতো এবং আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট ইত্যাদি অর্থ বহন করত। এগুলোকে প্রথমে ‘টাইপোগ্রাফিক আর্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ইমোজি আবিষ্কারের বেশ আগে থেকেই ইমোটিকন ছিল ভীষণ জনপ্রিয়। বিশেষ করে , , 8-D এই সব ইমোটিকনের ব্যবহার তখন বেশি ছিল। মূলত সিজেতাকা কুরিতার মাথায় ইমোজির আইডিয়া আসে কিন্তু ইমোটিকন থেকেই। তিনি ভাবলেন, প্রতিটি বিষয়ের একটা আইকন তৈরি করবেন। তার ভাবনায় আসলো ইমোজির আইকনগুলো স্মার্টফোনের কিবোর্ডে সেট করার কথা ভাবনা একসময় সত্যি হলো। ১২/১২ পিক্সেল-এর গ্রিড দিয়ে আই মোড ইন্টারফেসের মাধ্যমে ইমেজের একটি সেট তৈরি করে ফেলেন তিনি। এই ইমেজ সেটে ছিল ১৭৬টি ইমোজি। বর্তমানে নিউ ইয়র্কের ‘মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট’-এ সংরক্ষিত আছে কুরিতার তৈরি করা এই ১৭৬টি ইমোজি। সিজেতাকা কুরিতার কর্মস্থল ডোকোমোর ইমোজি তখন জাপানে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এক পর্যায়ে জাপানের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যায় ডেকোমার ইমোজি। সমস্যা ছিল একটাই এই ইমোজির ব্যবহারে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় ছিল না। ২০০৭ সালে গুগলের সফটওয়্যার টিম কাজ শুরু করে ভাষায় পরিণত হওয়া এই ইমোজিগুলোকে বাগে আনার জন্য। ইউনিকোড কনসর্টিয়াম কম্পিউটারের টেক্সটের স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখার জন্য কাজ করে থাকে। ২০০৭ সালে এই প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হয় গুগলের সফটওয়্যার ইন্টারন্যাশনালাইজেশন টিম। ইউনিকোড দায়িত্ব নেওয়ার আগে প্রায় কয়েকশ রকম এনকোডিং সিস্টেম ছিল। একেক কম্পিউটারে একেক রকম এনকোডিং সিস্টেম থাকায় সার্ভার এই আইকনগুলোকে ঠিকভাবে রিপ্রেজেন্ট করতে পারত না। ইউনিকোড এই ল্যাঙ্গুয়েজের কোডটাকে স্ট্যান্ডার্ড করার জন্য কাজ শুরু করে তাদের টিম। তারপর ২০১০ সালে ৬৬৫টি নতুন ইমোজিকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ঘোষণা করল ইউনিকোড।
২০১১ সালে অ্যাপল অফিসিয়ালি ইমোজি কিবোর্ড ফিচারটি যোগ করে তাদের IOS-এ (মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম) তে। ২০১৩ সাল নাগাদ এই ইমোজি কিবোর্ড অ্যান্ড্রয়েডেও চলে আসে। তখন থেকেই ইমোজি কিবোর্ড ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো রকম চিহ্ন ছাড়াই সরাসরি বসিয়ে দেওয়া যেত টেক্সটে। অ্যাপলের পর গুগলের জিবোর্ড (G board) কিবোর্ডেও এই ফিচারটি যুক্ত করা হয়। বর্তমান সময়ে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোনে ইমোজি কিবোর্ডটি আপডেট করা হয়েছে। শত-শত ইমোজির ভিড়ে ঠিক সময়ে ঠিক ইমোজিটা খুঁজে পাওয়ার জন্য সার্চ অপশন যেমন যোগ করা হয়েছে বহু আগেই। ইমোজি কিবোর্ডে রয়েছে ‘ইমোজি রিকগনাইজার’ ফিচার। যার মাধ্যমে কিবোর্ডের ইমোজি লাইব্রেরিতে না গিয়ে একেবারে টাইপ করলেই ইমোজি কিবোর্ড বুঝতে পারবে তুমি স্মাইলি ইমোজি চাও।
বিশ্ব ইমোজি দিবসও আছে পৃথিবীতে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রতিদিনই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, ইমো, মেসেঞ্জার, স্ন্যাপচ্যাট সহ নানা সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে পোস্টের ক্যাপশনে, কমেন্টে কিংবা টেক্সটে কতশত ইমোজি ব্যবহার করছি। আর তার একটা দিবস থাকবে না তা কেমন দেখায়? হয়তো এটা ভেবেই ইমোজি রেফারেন্স ওয়েবসাইট EMOJIPEDIA (ইমোজিপিডিয়ার)-এর প্রতিষ্ঠাতা জেরেমি বার্জ একটা ইমোজি দিবস থাকার প্রয়োজন অনুভব করেন। তিনি ১৭ জুলাইকে ইমোজি দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০১৪ সাল থেকে ইমোজি দিবসটি পালন করা শুরু হয়। বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবং প্রতিষ্ঠান যেমন পেপসি, কোকাকোলা, অ্যাপেল, গুগোল, সনি, ডিজনি এমনকি অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ও দিবসটিকে কেন্দ্র করে অনেক কিছু করে থাকেন। ২০১৬ সালে গুগল ইমোজি দিবসে এক সেট নতুন ইমোজি প্রকাশ করে। আবার অন্যদিকে ২০১৬ সালেই ইমোজিপিডিয়া বিশ্বের প্রথম ইমোজি আওয়ার্ড দেওয়ার প্রথা চালু করে। মূলত ডাটা বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি ‘Most Popular New Emoji’ অ্যাওয়ার্ড দিয়ে থাকে। এবছরও ইমোজি দিবসে এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে।
২০১৭ সালে লন্ডনের ‘রয়েল অপেরা হাউস’ এই দিনে ২০টি অপেরা এবং ব্যালে নাচের শো করে ইমোজির থিম-এর আদলে। অ্যাপলও রড়ং-এ নতুন ইমোজিদের স্বাগত জানায় এই দিনে। ২০১৮ সালে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব কিম কার্দাশিয়ান ইমোজি দিবস উপলক্ষ্যে ‘শরসড়লর ভৎধমহবহপব’ নামের সুগন্ধি বাজারে ছাড়েন। আবার ২০১৭ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের উদ্দেশ্যে দুবাইতে ‘Largest gathering of people dressed as emojis’এর আয়োজন করে। ইমোজি দিবসকে ঘিরে নানান ধরনের আয়োজন হয় সারাবিশ্বে।
আপনাদের সঙ্গে পরিচিত কিছু ইমোজির পরিচয় করিয়ে দেই। কোন ইমোজি কী বুঝায় সেটা জানা ভীষণ জরুরি। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ইমোজি সম্পর্কে জানানো যাক এবার।
ইমোজি তিন অক্ষরের একটা শব্দ হলেও এটার রয়েছে আলাদা একটা ল্যাঙ্গুয়েজ। শত কথাকে একটা ইমোজিতে প্রকাশ করা চাট্টিখানি কথা হয়। ইমোজির কারণে আমাদের বিপরীত পাশের মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেশন করা কতটা সহজ হয়ে গেছে তা আমরা নিজেরাই আঁচ করতে পারি। সামনের দিনে হয়তো ইমোজির হয়তো আরো নতুন নতুন আইকন আসবে। কিন্তু আমাদের জীবনের অংশ হয়ে ওঠা ইমোজির সৃষ্টি কিন্তু আচমকা। কেউ কি জানতো ৯০ দশকের এই ইমোজি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে এভাবে। গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, ইমোজি ব্যবহারের সতর্ক থাকা জরুরি। আপনার বন্ধু কিংবা প্রিয় মানুষের সঙ্গে যে ইমোজি আদানপ্রদান করবেন সেটা কিন্তু আপনার অফিসের বস কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের সঙ্গে করতে পারবেন না। সহজলভ্য কিংবা সহজতর হওয়ার কারণে এটা ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করবেন না তা কিন্তু নয়।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার