ভারতের পণ্য বর্জন নিয়ে রাজনৈতিক বাহাস

সালেক সুফী

মুসলিম বিশ্ব এবং বিশ্বের সংবেদনশীল মানুষ যখন গাজায় বর্বর ইসরাইল সামরিক বাহিনীর গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি পণ্য বর্জন করছে বাংলাদেশে কিছু মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবেশী ভারতের পণ্য বর্জন করার আন্দোলন করছে। সরকারবিরোধী মহলের ধারণা ভারত এককভাবে বর্তমান সরকারকে সমর্থন দিয়ে নাকি ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে। বাস্তব পরিস্থিতি হলো দেশে এখন কোন রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই।  জনস্বার্থ সম্পৃক্ত কোনো বিষয় নিয়ে প্রধান বিরোধী দল একক ভাবে বা অন্যান্য প্রান্তিক দলগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কোনো আন্দোলন করার সক্ষম অবস্থায় নাই।

তাই বর্তমান মুহূর্তে অবাস্তব ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা দিয়ে আসর গরম করার চেষ্টা নিয়েছে। বিশাল ভারত একচেটিয়া ভাবে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বাংলাদেশ চাল, ডাল, চিনি, পিঁয়াজ, মরিচ থেকে সবধরনের মসলা ভারত থেকে আমদানি করে।  এখন বিদ্যুৎ, ডিজেলের মত পণ্য ভারত থেকে আমদানি হয়।  ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে কৃষক সমাজ প্রায় অধিকাংশ পণ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন করলেও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব এবং পণ্য চলাচলে দুর্বৃত্তায়নের কারণে একদিকে কৃষক অন্যদিকে গ্রাহক সঠিক মূল্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত।  এই সব কারণে ভারতীয় পণ্যের উপর নির্ভরশীলতা অপরিহার্য।  অদূর ভবিষ্যতে এই নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দেখি  না। এই পরিস্থিতির জন্য সরকার, সরকার ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেট এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল সবার দায় রয়েছে।

দেশে যথেষ্ট উঁচু মানের তৈরি পোশাক এবং শাড়ি উৎপাদিত হলেও মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের কাছে ভারতীয় একই জাতের পণ্যের বিপুল চাহিদা। ভারতীয় শাড়ি আর লেহেঙ্গা ছাড়া মধ্যবিত্তের বিয়ে সাদী হয় না। ভারতীয় মসলা ছাড়া উপাদেয় খাবার রান্না হয় না। ভারতীয় টিভি সিরিয়াল না দেখলে বাংলাদেশি অনেক নারীদের রাতের ঘুম ভালো হয় না।

যদিও এভাবে বলা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর হয়তো যাথার্থ হয়নি তবু উনি সঠিক বলেছেন।  বিরোধী দলের নেতা নেত্রী যারা ভারতের পণ্য বর্জনের আহ্বান জানাচ্ছেন তারা যেন তাদের স্ত্রীদের ভারতের শাড়ি পুড়িয়ে ফেলেন। হেঁশেল থেকে ভারতীয় মসলা ফেলে দেন।

বাস্তব অবস্থা হলো যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ বিহীন সুষ্ঠু সাপ্লাই চেন গড়ে না উঠবে, যতদিন পর্যন্ত মৌসুমী ফসলগুলো সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে না উঠবে ততদিন বাংলাদেশকে ভারতীয় পণ্যের উপর নির্ভর করতে হবে।

দেখুন বাংলাদেশে একসময় ভারতীয় গরু আমদানি না হলে কোরবানি হত না। এখন কিন্তু দেশে গরু পালন শিল্পে পরিণত হওয়ায় ভারতীয় গরুর প্রয়োজনীয়তা নাই বললেই চলে। একইভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের একার পক্ষে সবকিছু করা অসম্ভব। সর্বস্তরের জনসাধারণের মাঝে সচেতনতার সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক। আর এই কাজটি সম্মিলিতভাবে করতে হবে সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, মিডিয়াকে।

একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে আমি নিজে ভারতের উপর নিরংকুশ নির্ভরতার ঘোর বিরোধী।  কিন্তু ভারত বিষয়ে ভারতীয়দের যত দেশপ্রেম দেখেছি বাংলাদেশিদের বাংলাদেশ নিয়ে তত দেশপ্রেম দেখি না। আর তাই বাংলাদেশে ব্যবসায়ী মহল সকল পণ্যে ভেজাল দিতে কুণ্ঠা করে না। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে নানা পণ্য অবৈধভাবে গুদামজাত করে মূল্য বৃদ্ধি করে।

আমি মনে করি বাংলাদেশে মাছ, মাংস, সবজি, ফলমূল সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। চাহিদা-সরবরাহ ভারসাম্যের কারণেই সবকিছুতে ভারত নির্ভরতার কারণ নাই। একই সঙ্গে বাস্তবতার কারণে ভারতের পণ্য বর্জনের ঘোষণা সময়ের অপচয় মাত্র। এগুলো নিয়ে সরকারি দল বা প্রধানমন্ত্রীর বিচলিত হবার কারণ নাই। বরং সরকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ এবং বাজার ব্যাবস্থাপনা উন্নয়নে অধিক মনোযোগ দিলে ভালো হবে।

ভারতের পণ্য বর্জন নিয়ে রাজনৈতিক বাহাস রীতিমত হাস্যকর।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × four =