সালেক সুফী
রেকর্ডস ভাঙা গড়ার অন্যন্য ক্রিকেট দিনে বলিউড নগরে অভিনীত হলো ক্রিকেট ব্লকবাস্টার ম্যাচ। ভিন্ন গ্রহের এলিয়েন হয়ে তাল গাছের মতো একপায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মেরে আকাশে ছাড়িয়ে গেলো দৃষ্টির সীমানা না. কাল ছিল এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বিস্ময় ক্রিকেটক্যাচটি। বীর প্রসবা আফগানিস্তান এবং ক্রিকেটের ব্রাজিল অস্ট্রেলিয়ার গুরুত্বপূর্ণ খেলা। ভারত ক্রিকেট দেবতা সচিন রমেশ টেন্ডুলকরের শহর। ওয়াংখেদে স্টেডিয়ামের ব্যাটিং বান্ধব উইকেটে কাল টস জিতে সাহসী আফগানিস্তান অস্ট্রেলিয়ার বোলাদের তুলোধুনো করেই ২৯১/৫ চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়ে তুলেছিল। ২১ বছরের অসীম সাহসী যুবক ইব্রাহিম জাদরান শুরু থেকে শেষ অবধি ব্যাটিং করে আফগানিস্তানের হয়ে বিশ্বকাপের প্রথম শতরানের মালিক (১২৯) করে ইতিহাসের পাতায় লাল হরোপে নাম লেখালো। জবাবে ব্যাটিং করতে এসে আফগানদের আগ্রাসী বোলিং এবং নিবেদিত ফিল্ডিং একসময় কোনঠাসা করে ফেলেছিলো ক্যাঙ্গারু বাহিনীকে। ১৮.৩ ওভারে ৯১ রানে ৭ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়ার পরাজয় সবাই ধরে নিয়েছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু খেলাটার নাম ক্রিকেট আর খেলছে ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়ার উত্তরসূরি। বাট হাতে একজন গ্লেন জেমস ম্যাক্সওয়েল ভিন্ন গ্রহের এলিয়েন হয়ে আবির্ভুত হলো। পায়ে আঘাত ,পা চলছে না সাবলীল ভাবে। কিন্তু হাতে আছে ব্যাট নামের তলোয়ার। ৮ম উইকেটে জুটিতে সঙ্গী দল নায়ক প্যাট্রিক জেমস কামিন্স। বিধাতা নির্ধারিত করে রেখেছিলেন ক্রিকেট বিশ্বকে অন্য ভুবনের ক্রিকেট উপহার দেয়া হবে. আর তাই গোটা ম্যাচে উজ্জীবিত ক্রিকেট খেলতে থাকা আফগানদের গুরুত্বপূর্ন ক্যাচ ফস্কে গেলো। মুজিব ফেলে দিলো ম্যাক্সওয়েলের ক্যাচ। ফস্কে গেলো ম্যাচ। একপায়ে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস দক্ষতায় একের পর এক নয়নমনোহর চার ছক্কার ফল্গুধারা রচনা করে বিশ্বকাপে প্রথম দ্বিশতকের মালিক হলো ম্যাক্সওয়েল। অসমাপ্ত ৮ম উইকেট জুটিতে যোগ হলো ২০২ রান. নিশ্চিত জয় হাতের মুঠো গোলে বেরিয়ে গেলো বীরের মতো লড়াই করা আফগান বাহিনীর। বিশ্ব ক্রিকেট দেখলো আগামী শতাব্দীর এক অনন্য ম্যাচ। যারা দেখেছেন বা পরে রেকর্ডেড ভার্সন দেখবেন অনেক নতুন মাইল ফলক স্থাপনকারী ম্যাচটির প্রতি মুহূর্ত উপভোগ করবেন। হয়তো এই ধরণের ম্যাচ নিয়ে লেখার যোগ্যতা ছিল ইংল্যান্ডের নেভিল কার্ডাস বা ভারতের শঙ্করী প্রসাদ মজুমদারের।
এবারের টুর্নামেন্টে কিন্তু রূপকথার ক্রিকেট খেলে একে একে তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড , পাকিস্তান এবং শ্রীলংকাকে ভড়কে দিয়েছে আফগানিস্তান। অনেকেই জানেন আত্মঘাতী বোমা ,আতংকবাজদের তান্ডব আর বিশ্ব মোড়লদের আগ্রাসনের কারণে দেশটিতে গড়ে উঠেনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অবকাঠমো। সেই দেশের কিছু সাহসী যুবক ভালোবেসে ক্রিকেট শিখেছে পাকিস্তানের পেশোয়ারে শরণার্থী শিবিরে। এখনো ক্রিকেট অনুশীলন করে হয় ভারতে না হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এবার নিয়ে খেলছে তৃতীয় বিশ্ব কাপ। সাড়া বিশ্বে চলমান টি ২০ ফ্রাঞ্চাইজ ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা এখন আফগান ক্রিকেটার। এহেন একটি দেশ এবারের বিশ্বকাপের অনেক স্মরণীয় বরণীয় মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে। কালও কিন্তু ৫ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে কোনঠাসা করে জয়ের পথে ছিল. কিন্তু গেলেন ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ইনিংস বঞ্চিত করেছে আফগানদের।
টস জয় করে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তুখোড় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখেই লড়াই করেছে আফগান বাহিনী। তরুণ ওপেনার ইব্রাহিম জাদরান শুরু থেকে শেষ অবধি অসাধারণ ব্যাটিং করে আফগানিস্তানের হয়ে বিশ্বকাপে প্রথম শতরানের মালিক হয়েছে। টপ অর্ডারে রাহমাত শাহ (৩০) ,হাসমাতুল্লাহ শাহিদী (২৬) ,রামানুল্লাহ গুরবাজ (২১) দের অন্তত একজন আরো বেশি সময় জাদরানের সঙ্গে উইকেটে থাকলে কাল ৩৩০-৩৪০ হতে পারতো। শেষ দিকে ১৮ বলে ৩০ রানের একটি অপরাজেয় ইনিংস খেলছিল রাশিদ খান. পরিস্থিতি অনুযায়ী ২৯১ /৫ উইকেটে কিন্তু ম্যাচ জয় সম্ভবা সংগ্রহ মনে হয়েছিলো।
জবাব দিতে এসে আফগানিস্তানের আগ্রাসী বোলিং ফিল্ডিং মোকাবেলায় ক্রমাগত উইকেট হারিয়ে কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল ক্যাঙ্গারু বাহিনী। সবাই ভাবছিলো মাত্র ৯১ রানে ৭ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়া নিশ্চিত পরাজয়ের পথে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক বিধাতা নির্ধারণ করেন ভিন্ন কিছু। ইতিহাস সৃষ্টির নেশায় আহত ক্যাঙ্গারুর মতো জ্বলে উঠলো গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। অস্ট্রেলিয়ান হিসাবে জানি লড়াই ছাড়া হারতে ঘৃণা করে অস্ট্রেলিয়া। হয়তো ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ইনিংস ক্রিকেট বিশ্ব দেখবে বলেই ম্যাক্সওয়েলের সহজ ক্যাচ হাত ফস্কে পড়ে গিয়েছিলো মুজিবের। পায়ে ব্যাথা থাকায় ফুটওয়ার্ক সীমিত , সিঙ্গেলস ,ডাবলস নেয়ায় অসুবিধা। তাই অনেকটা এক পায়ে দাঁড়িয়েই ২১ টি চার এবং ১০ টি প্রচন্ড ছক্কায় বিশ্ব কাপের প্রথম দ্বিশত রানের (২০১* ) মালিক হলো ম্যাক্সওয়েল। এমন ইনিংস একজনের জীবনে এক মাহেন্দ্ৰ ক্ষনে একবার হয়. ৮ম উইকেট জুটিতে পাট কামিন্সের সঙ্গে সংগ্রহীত ২০২ রানের জুটি শেন ওয়ার্ন এবং পল রাইফেলের ১১৯ রানের জুটি ভেঙে দেয়। তীরে এসে তরী ডুবে আফগানিস্তানের ,ভাবতে পারেন এতো বিশাল পার্টনারশিপে কামিন্সের অবদান ছিল ৬৮ বল খেলে মাত্র ১২.
আগেই বলেছি ম্যাক্সওয়েলের ইনিংসের বর্ণনা দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই. বিধাতাকে কৃতজ্ঞতা এমন একটি ইনিংস দেখার সুযোগ দেয়ার। আমার স্মরণে আছে ১৯৮৩ বিশ্বকাপে ভারতের কপিল দেব বিদ্ধস্ত ভারত ইনিংসের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ১৭৫ রানের এমনি ইনিংস খেছিলো। আমি সাঈদ আনোয়ার বা এবারের বিশ্বকাপে ফখর জামান , রাচীন রাভিন্দ্রা , এইডেন মারকরামের ইনিংস থেকেও ম্যাক্সওয়েলের ইনিংসটি অনেক এগিয়ে রাখবো।
সান্তনা আফগান বীরদের। হয়তো জয়ী হয় নি। কিন্তু এমন একটা স্মরণীয় ম্যাচ হেরেও কিন্তু হরে নি আফগানিস্তান। পরাজয়ে ডরে না বীর। অনেকটাই চিন্তামুক্ত। অস্ট্রেলিয়া পারবে এবারের বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।
সালেক সুফী: আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক