নাটক মঞ্চায়নের শুরুতেই অনেক মানুষের বাক্যালাপ শোনা যায় অডিওতে। মনে হচ্ছিল, ভুলে মাইক্রোফোনটা অফ করা হয়নি, তাই গ্রিনরুম থেকে শিল্পীদের অস্পষ্ট বাক্যালাপ শোনা যাচ্ছে। পরে বোঝা গেল, মিলনায়তনে অনেক মানুষের যে মুখরতা, তা বোঝাতেই এই অডিও বাজানো হচ্ছিল।
একজন মেকআপ আর্টিস্ট প্রবেশ করে মঞ্চে। সে চিন্তিত; কারণ, মঞ্চমহারাজ নামে খ্যাতিমান এই অভিনেতা এখনো হলে আসেনি, অথচ একটু পরেই তার অভিনীত নাটকের প্রদর্শনী। এরই মাঝে মঞ্চে প্রবেশ করে একজন অভিনেতা, সে নবাব সিরাজ উদ্দৌলা নাটকের অংশবিশেষ পরিবেশন শেষে প্রস্থান করে। এরপর মঞ্চে আসে একজন সাংবাদিক। সে জানায়, মঞ্চমহারাজ নিখোঁজ হয়েছে, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ইতিমধ্যে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে সে খবরে সয়লাব হয়েছে।
মেকআপ আর্টিস্ট আর সাংবাদিকের কথোপকথনে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে নাটকের গল্প। মঞ্চমহারাজ একজন নিবেদিতপ্রাণ অভিনেতা। চারদিকে তার জনপ্রিয়তা যেমন, খ্যাতিও। পরিবার-পরিজনকে প্রবাসে রেখে শিল্পচর্চা নিয়ে একা দেশে পড়ে আছে। প্রেম করে বিয়ে করেছে। স্ত্রী-সন্তান এখন বিদেশ থাকলেও বছরে একবার দেশে আসে, সবাই একসঙ্গে ভালো সময় কাটায়। এরপর স্ত্রী-সন্তান ফিরে যায় প্রবাসে, মঞ্চমহারাজ রয়ে যায় এখানে, এই দেশে—একা।
দুদিন আগে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শোতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনার মুখোমুখি হয় মঞ্চমহারাজ। প্রদর্শনীটি সে শেষ করেছে, কিন্তু পরদিন থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মেকআপ আর্টিস্ট ও সাংবাদিকের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে মঞ্চমহারাজ নামে খ্যাত অভিনেতার আদ্যোপান্ত যখন জানা হয়ে যায়, তখনই খবর আসে, মঞ্চমহারাজকে পাওয়া গেছে। সে আসছে মিলনায়তনে। এখানেই সংবাদ সম্মেলন করবে, জানাবে কেন এবং কীভাবে সে নিখোঁজ হয়েছে। এবং সে কথাই নাটকের মূল বক্তব্য। কী সেই বক্তব্য? সেটা জানা যাবে, তার আগে চলুন, নাটকটির কিছু ভালোমন্দ দিকের সন্ধান করা যাক।
অভিনেতার গল্পভাবনা এবং বিষয়বস্তু সমসাময়িক। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া একটি স্বাধীন দেশে শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে নাট্যকর্মীদের যে সংগ্রাম আজও চলমান, সেই সংগ্রামের এক অনবদ্য চিত্র ফুটে উঠেছে। চরিত্রের আধিক্য নেই, তবু সুন্দর এক গল্পের উপস্থাপন হয়েছে। পুরো মিলনায়তনকে নাটকের অংশ করে নেওয়ার যে চেষ্টা, সেটা নির্দেশনার এক অনন্য দিক। বর্ণনাত্মক রীতিতে উঠে এসেছে অভিনেতার ব্যক্তিগত জীবন। আবার ফ্ল্যাশব্যাকে ‘সিরাজ উদ্দৌলা’, ‘রক্তকরবী’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এর মতো নাটকগুলো দিয়ে অভিনেতার অভিনয়শিল্পী হয়ে ওঠার গল্পটা যেমন স্পষ্ট, তেমনি বাংলা নাটকের সমৃদ্ধি আর গৌরবের কথাও ফুটে উঠেছে।
অভিনেতার নামভূমিকায় আছেন অনন্ত হিরা। অভিনয়ে তিনি বরাবরই পারদর্শী। তবে নাটকের শুরুর সিরাজ উদ্দৌলা থেকে শুরু করে রক্তকরবীর রাজা, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-এর বাবা, কিংবা শেষ দৃশ্যে ব্যক্তিগত চরিত্রে মঞ্চমহারাজের সংলাপ প্রক্ষেপণ প্রায় একই রকম মনে হয়েছে।
সাংবাদিক চরিত্রে যে ব্যক্তিত্ব, কথাবার্তায় যে ধার বা বুদ্ধিমত্তা থাকা প্রয়োজন, সেটা এখানে পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট সাংবাদিকদের নিয়ে স্টাডি করে চরিত্রটি আরও ধারালো ও তীক্ষ্ণ করা যেত।
নাটকের যে দৃশ্যগুলোতে অডিওর মাধ্যমে দর্শকের উপস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল, তা না করে যদি দর্শকসারিতে অভিনয়শিল্পীরা অবস্থান নিয়ে সংলাপগুলো বা নাট্যক্রিয়াগুলো করে যেতেন, তাহলে আরও বাস্তবিক হতো। দর্শকও এই মিলনায়তনের ভেতরে নাটকের অংশ হয়ে উঠতেন।
পুরো নাটকটিতে মেকআপ আর্টিস্ট আর সাংবাদিককেই পাওয়া গেল, যারা অভিনেতার নিখোঁজ হওয়ার খবরে চিন্তিত। তারা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে? মঞ্চে, নাকি গ্রিনরুমে? যেখানেই হোক, দলের আর নাট্যকর্মী বা নির্দেশক কোথায়? মঞ্চমহারাজের নিখোঁজ সংবাদে তারা চিন্তিত নয়?
এবার আসা যাক গল্পের ধারাবাহিকতায়। নাটকের প্রথম অংশেই মঞ্চমহারাজকে নিয়ে দর্শকমনে আগ্রহের জন্ম দেওয়া গেছে। ধীরে ধীরে ক্রাইসিসটা জিইয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে, সেটা সম্ভবও হয়েছে। শেষ দৃশ্যে নাটকের মূল বক্তব্যটাও মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া গেছে। কিন্তু শুরু থেকে যে ডেস্টিনেশনের দিকে এগোচ্ছিল গল্পটা, তার মাঝে ভিন্ন নাটকের দীর্ঘ মঞ্চায়ন মূল নাটক বা গল্পে মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। দৃশ্যপটগুলো আরও সংক্ষিপ্ত হলে মূল গল্পে থাকা সহজ হতো।
এবার আসা যাক নাটকের মূল বক্তব্যে। তিন দিন আগের একটি প্রদর্শনীতে অভিনেতা এমন এক ঘটনার মুখোমুখি হয়, যাতে তার মনে হয়েছে, দেশের শিল্প-সংস্কৃতি আজ নিজস্ব সম্মান হারিয়েছে, চারদিকে প্রকট হয়েছে রুচির দুর্ভিক্ষ। সেই ঘটনা তাকে খুবই অসম্মানিত করেছে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শিল্পচর্চা ছেড়ে দেবে। মহান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে দেশের শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে যে সংগ্রাম সে করেছে, সেখানে সে যেন আজ পরাজিত। কিন্তু অনেকে যখন তাকে বোঝাতে সক্ষম হলো, এই যে সংগ্রাম, এটা শেষ হওয়ার নয়। শেষ হলেই বরং শূন্য স্থানটুকু দখল করে নেবে মন্দেরা। তখন মত বদলায় মঞ্চমহারাজ, ব্রত নেয় শিল্প-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার। শেষ দৃশ্যটি দর্শককে উজ্জীবিত করে। তবে দর্শক হিসেবে একটু খটকা লাগে, আরাম-আয়েশের জীবন বিসর্জন দিয়ে, স্ত্রী-সন্তান, সংসার বিসর্জন দিয়ে শিল্প-সংগ্রামে নিমগ্ন ব্যক্তিটি এত সহজে সংগ্রাম থেকে সরে গেল? আবার নিজের পরিবারকেও কি সে জয় করতে পারল? সংসারেও তো সে পরাজিত! নিজের সন্তানকে বড় করেছে কোন আদর্শে? যেখানে তারা দেশ ছেড়ে প্রবাসে ছুটেছে সুখের আশায়! অভিনেতার কণ্ঠেও তাই ঝরে পড়ে সেই পরাজয়ের ক্লেদ আর ক্ষোভ, ‘তুমি তো অকৃতজ্ঞ, বেইমান। তুমি পড়েছ এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার মানে এ দেশের জনগণের টাকায়। অথচ তুমি এ দেশকে সার্ভ না করে সার্ভ করছ অন্য দেশকে, অন্য দেশের মানুষকে। নিজের দেশকে না, নিজের দেশের মানুষকেও না।’