মহাকাশে কাঠের তৈরি স্যাটেলাইট

আশফাক আহমেদ

অবিশ্বাস্য মনে হলেও, কাঠ দিয়ে তৈরি স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়েছে জাপান। এমন কোনো ঘটনা এবারই প্রথম। বিশ্বের প্রথম কাঠের তৈরি স্যাটেলাইটটির নাম ‘লিগনোস্যাট’। জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় ও গৃহনির্মাণ প্রতিষ্ঠান সুমিতোমো ফরেস্ট্রি যৌথভাবে স্যাটেলাইটটি তৈরি করেছে। ভবিষ্যতে চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহের বিভিন্ন অনুসন্ধানে কাঠ ব্যবহারের সম্ভাব্যতা পরীক্ষার অংশ হিসেবে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে পাঠানোর কথা জানানো হয়েছে।

লিগনোস্যাট স্যাটেলাইট ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ওপরে পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থান করে মহাকাশে থাকা পুনর্বিকিরণযোগ্য উপাদানের খোঁজ করবে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে কাঠের ঘর তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে বিজ্ঞানীদের। আর এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই মহাকাশে কাঠের তৈরি স্যাটেলাইট পাঠিয়েছেন জাপানের বিজ্ঞানীরা।

এ বিষয়ে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী কোজি মুরাতা বলেন, উনিশ শতকের প্রথম দিকে কাঠ দিয়ে উড়োজাহাজ তৈরি করা হতো। আর তাই কাঠের তৈরি স্যাটেলাইটেরও সম্ভাবনা আছে। কাঠ পৃথিবীর তুলনায় মহাকাশে বেশি টেকসই; কারণ, সেখানে কোনো পানি বা অক্সিজেন নেই। ফলে মহাকাশে কাঠের পচন বা স্ফীত হওয়ার সুযোগ কম। কাঠের স্যাটেলাইটের পরিবেশগত প্রভাবও কম। প্রচলিত ধাতব স্যাটেলাইটের নানা ঝুঁকি রয়েছে। কাজ শেষে এগুলো বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড কণা তৈরি করে। তবে কাঠের তৈরি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দূষণ কম হবে। ধাতব স্যাটেলাইট ভবিষ্যতে নিষিদ্ধ হতে পারে।

জাপানে হোনোকি ম্যাগনোলিয়া গাছ আছে, যা ঐতিহ্যগতভাবে তরবারির খাপের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই গাছ মহাকাশযানের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। লিগনোস্যাট স্যাটেলাইটটি প্রায় ছয় মাস পৃথিবীর কক্ষপথে থাকবে। মহাকাশের চরম পরিবেশে কাঠ কীভাবে টিকে থাকবে, তা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করা হবে।

সুমিটোমো ফরেস্ট্রির সুকুবা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী কেনজি কারিয়া বলেন, লিগনোস্যাট সেমিকন্ডাক্টরের ওপর বিকিরণের প্রভাব কমাতে কাঠের ক্ষমতা নিয়ে পরিমাপ করবে। ডেটা সেন্টার নির্মাণের মতো অ্যাপ্লিকেশনে ব্যবহারের সুযোগ বের করা হবে। এই বিষয়টি পুরোনো বলে মনে হতে পারে, কিন্তু চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহের দিকে সভ্যতা নির্মাণের জন্য কাঠ আসলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। মহাকাশ শিল্পকে সম্প্রসারণে কাঠ নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে।

ইতিহাস গড়ল স্পেসএক্স

বিশ্বে এবারই প্রথম উৎক্ষেপণ করা রকেটের একটি অংশ লঞ্চ প্যাডে ফিরে এলো। অবাক হওয়ার মতো এই ঘটনা ঘটিয়েছে ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের স্টারশিপ। পাঁচবার চেষ্টার পর সফল হয় স্পেসএক্স। বিশ্বে তৈরি হওয়া এ যাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট স্টারশিপের দুটি অংশ। একটি হচ্ছে ‘সুপার হেভি বুস্টার’ নামের তরল গ্যাসের জ্বালানি চালিত রকেট। আরেকটি অংশটি হলো ‘স্টারশিপ’ নামের মহাকাশযান, যা এই সুপার হেভি বুস্টারের ওপর বসানো আছে। স্টারশিপ রকেট ১০০ টনের বেশি যন্ত্রপাতি বা ১০০ জন আরোহী বহন করতে পারে। আর সুপার হেভি বুস্টারে আছে ৩৩টি ইঞ্জিন, যা মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার আর্টিমেস রকেটের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী।

টেক্সাসের বোকা চিকা মহাকাশ কেন্দ্র থেকে রকেটটির প্রথম-ধাপের সুপার হেভি বুস্টারটি উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি আকাশে উড়ে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে এর দ্বিতীয়-ধাপের স্টারশিপ রকেটটি আলাদা হয়ে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমে ভারত মহাসাগরে পড়ে। আর সুপার হেভি বুস্টারটি ফিরে আসে স্পেস এক্সের সেই টাওয়ারে যেখান থেকে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। উৎক্ষেপণ টাওয়ারের রোবোটিক শাখা ‘চপস্টিক’ তখন বুস্টারটিকে ধরে ফেলে। আনন্দ প্রকাশ করে নিজের সামাজিকমাধ্যম এক্সে ইলন মাস্ক লিখেন ‘টাওয়ার রকেটটিকে ধরে ফেলেছে!’

ইলন মাস্কের স্বপ্ন হলো, অন্যগ্রহে মানুষের বসতি স্থাপন করতে যাওয়ার উপযোগী রকেট তৈরি করা। যা বার বার ব্যবহার করা যাবে এবং একেকবারে শ’খানেক মানুষকে মঙ্গলগ্রহ ও চাঁদে নিয়ে যাওয়া যাবে। তাই এর উপযোগী করেই বানানো হয়েছে স্টারশিপ রকেটকে।

স্যাটেলাইটের কারণে বিপাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা

পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট পাঠিয়ে সারা বিশ্বে মোবাইল ব্রডব্র্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে ইলন মাস্কের মালিকানাধীন স্টারলিংক। বর্তমানে মহাকাশে স্টারলিংকের সাড়ে ছয় হাজারের মতো স্যাটেলাইট রয়েছে। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে থাকা এসব স্যাটেলাইটের কারণে ঠিকমতো মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট ফর রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।

নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট ফর রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির তথ্যমতে, নতুন প্রজন্মের স্টারলিংক স্যাটেলাইটগুলো সারা বিশ্বে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা দিলেও এগুলো রেডিও টেলিস্কোপ ও জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনের সময় বিভ্রান্ত হচ্ছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।

এ বিষয়ে জ্যোতির্বিদ জেসিকা ডেম্পসি বলেন, এমন কৃত্রিম উপগ্রহ যত বেশি পাঠানো হচ্ছে, ততই আমরা আকাশ কম দেখতে পাচ্ছি। আমরা বর্তমানে কয়েক লাখ আলোকবর্ষ দূরের কিছু প্রাচীন ছায়াপথ পর্যবেক্ষণ করছি। এসব ক্ষেত্রে স্যাটেলাইটগুলোর রেডিয়েশন প্রভাব ফেলছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের ভি২ স্যাটেলাইট প্রথম প্রজন্মের তুলনায় ৩২ গুণ বেশি শক্তিশালী। এসব স্যাটেলাইট ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস ইউনিয়নের নির্ধারিত মাত্রার চেয়েও বেশি বিকিরণ করছে।

ছায়াপথ বা গ্রহসহ মহাকাশের অনেক বস্তু ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের মাধ্যমে আলো নির্গত করে। এসব বিকিরণের তরঙ্গ খালি চোখে দেখা না গেলেও রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। কিন্তু স্টারলিংকের পাঠানো হাজার হাজার স্যাটেলাইটের কারণে তরঙ্গগুলো ঠিকমতো শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

স্যাটেলাইটের কারণে আলোর দূষণ নিয়েও চিন্তিত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাদের আশঙ্কা, এসব স্যাটেলাইট অপটিক্যাল টেলিস্কোপের কাজের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করছে। বৈজ্ঞানিক কাজের বাধা কমাতে মহাকাশে স্যাটেলাইটগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মান নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তারা।

পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিশ্লেষণ না করেই স্টারলিংকসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। আর তাই মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশনের (এফসিসি) কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন এক হাজার বিজ্ঞানী। চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থাকে মহাকাশে নতুন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ সাময়িকভাবে না করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বিজ্ঞানীদের মতে, স্যাটেলাইটের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব এখনো অজানা। ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ৫৮ হাজার স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকারক গ্যাস ও ধাতুর উপস্থিতি বাড়বে। বিষয়টি বিবেচনা না করেই মার্কিন সরকার স্যাটেলাইট পাঠানোর অনুমতি দিচ্ছে।

পৃথিবীর তুলনায় ৬০ গুণ ভারী গ্রহের সন্ধান

ধাতব কেন্দ্রসমৃদ্ধ নতুন গ্রহ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। নতুন এই গ্রহ পৃথিবীর চেয়ে ৬০ গুণ ভারী। সূর্য থেকে ৬৯০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত নতুন এই গ্রহ। আবিষ্কৃত গ্রহটি নেপচুনিয়ান এলাকায় অবস্থিত। নতুন গ্রহটি এই এলাকার চতুর্থ এক্সো-গ্রহ। এই গ্রহের আকার নেপচুন গ্রহ ও শনি গ্রহের মাঝামাঝি। নেপচুনিয়ান অঞ্চলের তাপমাত্রা অনেক বেশি। নেপচুন আকারে পৃথিবীর ৪ গুণ বড় ও ১৭ গুণ ভারী। এ অঞ্চলে যেসব গ্রহের খোঁজ মিলেছে বা ভবিষ্যতে মিলবে, সেগুলো এমন প্রকৃতির হবে।

ভারতের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক দল সৌরজগতের বাইরে নতুন এই এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার করেছে। নতুন এই গ্রহ পৃথিবীর চেয়ে পাঁচ গুণ বড়। নতুন গ্রহটির নামকরণ করা হয়েছে টিওআই ৬৬৫১বি। পিএআরএএস ২ নামের একটি টেলিস্কোপের মাধ্যমে নতুন এই গ্রহের সন্ধান মিলেছে। ভারতের রাজস্থানের মাউন্ট আবুতে বসানো আছে টেলিস্কোপটি। জার্নাল অব অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকসে নতুন গ্রহের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, নতুন গ্রহটি তার কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের চারপাশে মাত্র পাঁচ দিনে প্রদক্ষিণ করছে। গ্রহটির মূল অংশ প্রায় ৮৭ শতাংশ লোহার মতো শক্ত ধাতু দ্বারা গঠিত। বাহ্যিকভাবে পাথুরে এই গ্রহে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের একটি কম ঘনত্বের মেরু আছে। নতুন এই এক্সোপ্ল্যানেটের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ১ হাজার ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপের কারণে এই গ্রহের বাসযোগ্যতা শূন্য। নেপচুনিয়ান অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত অন্য তিনটি এক্সোপ্ল্যানেট পৃথিবীর চেয়ে ১২ থেকে ১৩ গুণ বড়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: টেক ট্রেন্ড

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 + 1 =