মাছ-ভাত বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য

সালেক সুফী: চলে গেলো বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ। বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বাংলাদেশে এবং প্রবাসে নানা আয়োজন আর উৎসবে মেতে দিনটি প্রানভরে মনভরে উপভোগ করেছে।কিছু ক্ষেত্রে  কিছু কাজ আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা দৃষ্টিকটূ মনে হলেও সাধারণভাবে নির্মল বিনোদনের  আনন্দ আয়োজনগুলো ধর্মীয় অনুভূতির পরিপন্থী মনে করার কারণ নেই। ডাক ঢোল বাজালেই সেটি ইসলাম ঐতিহ্যের পরিপন্থী বলা যাবে না। আমি ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এমনি আনন্দ আয়োজন করতে দেখেছি। পহেলা বৈশাখ আনন্দ উৎসব আয়োজনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে সর্বজনীন ভেবে নেওয়াতে কুণ্ঠিত হবার কারণ নেই। কিন্তু এই সময় রোজার মাস থাকায় কোনো আয়োজন যেন ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের  প্রতি বাধ্য সৃষ্টি না করে।

সেই শিশুকাল থেকে প্রাণের শহর ফরিদপুরে থাকা অবস্থায় পহেলা বৈশাখের জন্য অপেক্ষা করতাম। হালখাতা আর বৈশাখী মেলা থেকে মুড়ি মুড়কি, মন্ডা খাবার অপেক্ষায়। বৈশাখী মেলায় নানা ধরনের দেশি মাছ পাওয়া যেত। পিঠা পুলি, নানা বর্ণের ঘুড়ি  কিনতাম।  তখনও কিন্তু ইলিশ পান্তা সংস্কৃতি শুরু হয়নি। পাবদা, টেংরা, কৈ, সিং, মাগুর, সরপুঁটি, বাইন মাছ তখন ছিল সবার প্রিয় মাছ।  ফরিদপুর শহরের নদী-খাল-বিল-পুকুরে বছরের সব সময় নানাভাবে মাছ ধরতাম। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আমাদের অঞ্চলে দুটি প্রতিযোগিতা হতো। মাছ ধরা, ঘুড়ি উড়ানো, হাডুডু খেলা হতো। করতাম সব কিছু।

পরবর্তী জীবনে চাকরি করার সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে এই আয়োজনগুলো আরো সমন্বিতভাবে দেখেছি। চট্টগ্রাম অঞ্চলে জব্বরের বলি খেলা দেখেছি। ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই দেখেছি। ঢাকায় থাকার সময় প্রতিবার রমনার বটমূলে কাকডাকা ভোরে উপস্থিত হয়ে বর্ষবরণে উপস্থিত থেকেছি। বাংলাদেশে থাকার সময় ঝাঁকি জাল দিয়ে, বড়শি দিয়ে, পোলো দিয়ে, কাদায় হাত দিয়ে নানাভাবে মাছ ধরেছি। সেই মধুর সুখস্মৃতি এখনো আপ্লুত করে।

প্রসঙ্গে ফিরে আসি বাঙালির বিশেষ ঐতিহ্য দেশি মাছ। জানি ডাল, ভাত, মাছ বাংলাদেশিদের পুষ্টি দিয়ে থাকে। বিদেশে থেকেও কিন্তু আমরা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে অস্থির থাকি। তবে অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাইল্যান্ড, মায়ানমার, ভিয়েতনাম  থেকে নিয়মিত মাছ আসলেও বাংলাদেশের মাছ পাওয়া যায় তুলনামূলক কম। চিংড়ি মাছ বাংলাদেশের একমাত্র ঐতিহ্য নয়। অথবা শুধু ইলিশ মাছ নয়, অন্যান্য দেশি মাছ রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আয় হবে।

জানিনা অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে যদি খাল বিলে এখন দেশি মাছ সেইভাবে পাওয়া যায় কিনা। ১৭ বছর দেশে থাকি না।  শুনি দেশি মাছ ক্রমাগত বিলুপ্ত হবার মুখে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিছু প্রতিষ্ঠান বিশেষ ব্যবস্থায় দেশি মাছ ফিরিয়ে আনছে। থাইল্যান্ড বা অন্যান্য দেশ থেকে মাছের জাত আমদানি করায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু চাষের দেশি মাছের বিভিন্ন জাত যেন দেশি মাছকে বিল্পুত করে না ফেলে সেদিকে সবার সবার দৃষ্টি দিতে হবে। পহেলা বৈশাখে এবার মাছ ধরার স্মৃতি বিশেষভাবে স্মরণে এসেছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × 4 =