মিথেন প্যাক্টে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি: শামসুদ্দোহা

আফরোজা আখতার পারভীন

কপ২৭-এ  মিথেন প্যাক্টে যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার আগে কৃষি বিভাগ এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করা উচিৎ ছিলো। কারণ মিথেনের বড় অংশ আসবে লাইভ স্টক থেকে।তিনি বলেন, যদিও আমরা যান্ত্রিক কৃষিতে যাইনি। কিন্তু বাংলাদেশে লাইভ স্টক ফার্মিং মোটামুটি একটা বাণিজ্যিকায়নের পর্যায়ে চলে গেছে। এখান থেকে যদি আমরা মিথেন দূষণ কমাতে চাই, তবে তা আমাদের মাংসের যোগানে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বা মাংসের মূল্য বাড়াবে। এ চুক্তিতে স্বাক্ষরের আগে আমাদের মিথেন দূষণ কমানোর কৌশল বিবেচনা করা উচিৎ ছিলো। এ চুক্তি বাস্তবায়ন করতে গেলে কৃষি এবং মাংস উৎপাদনে যে প্রভাব পড়বে তা বাংলাদেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে কিনা, তা যাচাই বাছাই করা উচিৎ ছিলো।

বিসিপিসিএল-ইপি ক্লাইমেট টকস-এ কাঠমান্ডু থেকে যোগ দিয়ে এসব কথা বলেন, সেন্টার ফর পাটিসিপেটরি রির্সাস অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের নির্বাহী প্রধান মো. শামসুদ্দোহা। ২৭তম কপের সফলতা, প্রাপ্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে কোপেনহেগেন কপের পরে এটাকে ব্যর্থ কপ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, কপ২৭ কৌশলগত বিতর্ক তৈরি করেছে যে, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় কে বা কারা টাকা দিবে? ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সরাসরি বলেছে, পৃথিবীর উষ্ণতা যদি ১.৫°সেন্টিগ্রেডে রাখতে না পারি, তাহলে লস অ্যান্ড ড্যামেজের জন্য যে টাকার দরকার হবে তা কেউ দিতে পারবে না। গত কপে যে ধরনের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আমরা দেখেছিলাম, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে যে ধরনের প্রত্যয় আমরা দেখেছিলাম, এবার কিন্তু তা দেখা যায়নি। গত কপে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে গোটা বিশ্বই প্রায় একমত হয়েছিলো। এবার কিন্তু কেউ টু শব্দটিও করেনি।

তিনি বলেন, বরং এবার সবাই গুরুত্ব দিয়েছে লস অ্যান্ড ড্যামেজ বিষয়ে। কিন্তু লস অ্যান্ড ড্যামেজের টেক্সটের (সিদ্ধান্ত) মারপ্যাচ অতিক্রম করে সেখান থেকে টাকা পাওয়াটা খুবই কষ্টসাধ্য হবে। এখানে যেসব কৌশলগত শর্তাবলী যুক্ত করা হয়েছে তা অত্যন্ত জটিল। লস অ্যান্ড ড্যামেজের মিথ্যে বিজয় অর্জন করেছি আমরা। উন্নত দেশগুলো আমাদেরকে ঠকিয়েছে।

মো. শামসুদ্দোহা বলেন, এবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যে প্রস্তাবনাগুলো দিয়েছে, তাতে বৈশ্বিক জলবায়ু ক্ষতিপূরণের দায় উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপরও চাপিয়েছে বা ক্ষতিপূরণে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অংশ নিতে বলেছে। সেক্ষেত্রে এ মুহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে বড় উন্নয়নশীল দেশ চীনকে নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হবে এবং উন্নত দেশগুলো ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে নানা টালবাহানা করবে।

এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার আয়োজিত অনুষ্ঠানে মো. শামসুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনে দূষণ কমানোর খরচের হিসেবেও ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে।  পরিকল্পনায় দূষণ কমানোর টাকার অংক দেখানো হয়েছে ট্রিলিয়ন ডলার হিসাবে। আসলে তা হবে বিলিয়ন ডলার। আসলে এখানে একটা আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। উপরন্তু এই টাকাটা একবারে লাগবে না। বিশ্ব নেতৃত্ব যদি উদ্যোগী হন ও দায়িত্ব গ্রহণ করেন তবে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ সেন্টিগ্রেড লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, আমরা যে জি৭ এবং চায়না গ্রুপ সাথে নিয়ে নেগোসিয়েশন করছি তাদের মধ্যেও বিভেদ আছে। কারণ তারা জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর অর্থনীতির দেশ। তারা মনে করছে যে, গ্যাসের এখনও একটা বড় মার্কেট আছে। এবারের টেক্সটেও বলা হয়েছে যে, আগামীর প্রধান জ্বালানি হবে গ্যাস।

মো. শামসুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন যেমন দরিদ্র দেশগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে, পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোকে সুযোগ করে দিয়েছে তাদের অর্থ বিনিয়োগের। একই সাথে আবার এটা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে তাদের ফিনান্সিয়াল রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন পরিবর্তন করার। বাংলাদেশে ৪৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের ক্ষেত্রে এডিবি যেসব আমাদের ফাইনান্সিয়াল পলিসিগুলো পরিবর্তনের যে পরামর্শ দিচ্ছে, এগুলো তারই অংশ।

তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন টাকা লেনদেনের একটা মাধ্যম হয়ে যাচ্ছে। এটাকে অনেক দেশ তাদের অন্যান্য সংকট নিরসনের উপায় মনে করছে। যা নতুন ধরনের সমস্যা তৈরি করবে। যেমন পাকিস্তান তাদের সাম্প্রতিক বন্যাকে কাপ২৭-এ বড় করে দেখিয়েছে। তারা আকাঙ্ক্ষা করছে বন্যার ক্ষয়ক্ষতিকে এজেন্ডা হিসেবে দাঁড় করিয়ে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার। তার মানে জলবায়ু পরিবর্তন একটা লেভেল হয়ে যাচ্ছে।

মো. শামসুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু দূষণ রোধে সিভিল সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মুশকিল হচ্ছে সুশীল সমাজ শুধুমাত্র জনমত তৈরি করতে পারে, কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে না। যারা রাষ্ট্র চালান তাদের মধ্যে যদি গুণগত পরিবর্তন না হয়, তবে জলবায়ু পরিবর্তন অসম্ভব। প্রত্যেক দেশকে তাদের জাতীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে বৈশ্বিক বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।

জলবায়ু ইস্যুতে তহবিল পাওয়া বা ঋণ পাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে  বাংলাদেশের দক্ষতার ঘাটতি আছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষ ও মেধাবী জনবল গড়ে তোলা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের এখন উচিৎ হবে, পরিবেশ অধিদপ্তর বা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে  ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ডিপ্লোমেসি’ নামে আলাদা সেল তৈরি করা। যে সেল সারা বছর জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে কাজ করবে। তাদেরকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 × two =