যমুনা নদীর প্লাবনভূমিতে ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্ক

মুশফিকুর রহমান

গত ১৪ জুলাই যমুনা নদী সংলগ্ন সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে ৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। যমুনা বহুমুখী সেতুর অদূরে নদীর প্লাবনভূমিতে নির্মিত এই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি সঞ্চালিত হচ্ছে জাতীয় গ্রিড লাইনে। দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপদিত বিদ্যুতের মতোই মানুষ তার দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে এই বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর সপ্তাহ তিন পর সুযোগ এলো সিরাজগঞ্জের ৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ঘুরে দেখার।

দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্য সচরাচর জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তির কথাই আমরা জেনে এসেছি। যমুনা সেতুর পশ্চিম প্রান্তে প্রাকৃতিক গ্যাসচালিত প্রতিটি ২২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনও চালু রয়েছে। গ্যাস সঙ্কটে কেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় সারাক্ষণ চালু রাখা সম্ভব হয় না। এই গ্যাস (অথবা জ্বালানি তেল) চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অদূরে ‘যমুনা সেতু পশ্চিম’ রেল স্টেশনের কাছাকাছি সদ্য চালু হয়েছে সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছালে সচল টারবাইনের শব্দ টের পাওয়া যায়। কিন্তু, সৌর বিদু্যুৎকেন্দ্রের ভেতরে দাঁড়ালেও শুনশান নীরবতা। বুঝবার কোনো উপায় নেই কীভাবে সূর্যের আলো বিদ্যুৎ শক্তিতে নীরবে রূপান্তরিত হয়ে গ্রিড লাইনে সঞ্চালিত হচ্ছে।

জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস) পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে আবহাওয়ামণ্ডলীতে কার্বনসহ ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান ইন্ধন বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব বিশ্বজুড়েই ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত বিভিন্ন সংকট তীব্র হয়ে উঠছে। উপকূলীয় জনপদে লবণাক্ততার বিস্তার, সুপেয় মিঠাপানির সংকট, চাষের জমি তলিয়ে যাওয়া, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা বেড়ে যাওয়া, বিভিন্ন রকম রোগবালাই বেড়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন সঙ্কটে পরিবেশগত বিপন্নতায় মানুষ পরিবেশ শরণার্থী হতে বাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া, সারা দেশে আবহাওয়ার শৃঙ্খলা ভেঙে যাওয়া, অসময়ের বন্যা, খরা, তীব্র তাপদাহে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপন্ন হয়ে উঠছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশের মানুষের জীবন জীবিকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জলবায়ু পরিবর্তনের ইন্ধন নিয়ন্ত্রণের তাগিদ বাড়ছে।

আমদানি করা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ক্রমশই ব্যয়বহুল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিকর ইন্ধন হিসেবে পৃথিবীজুড়ে সমালোচিত হচ্ছে। তাছাড়া আমাদের দেশে বাণিজ্যিক জ্বালানির যোগান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সুলভে দেশে উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করা হয়ে আসছিল। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ দ্রুত সঙ্কুচিত হয়ে আসায়, বিকল্প জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাহিদা বাড়ছে। তাছাড়া, আমদানিনির্ভর উচ্চমূল্যের তেল, তরলীকৃত গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতির উপর চাপ বাড়িয়ে চলেছে। জ্বালানিনিরাপত্তার জন্যও তা বড় চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তির উন্নয়নে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ বিকল্প হিসেবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সরকার নীতিগতভাবে নবায়নযোগ্য উৎসকে কাজে লাগিয়ে পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনকে উৎসাহিত করছে। সৌর শক্তি, বায়ুপ্রবাহের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কারিগরি ও বাণিজ্যিকভাবে উপযোগী জায়গায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করছে।

দেশের স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের বর্তমানে মোট উৎপাদন সামর্থ প্রায় ২৭,৭৯১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে কয়লা, তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সামর্থ প্রায় ৯২.৬১%। এর সাথে ৪.১৭% আমদানি বিদ্যুৎ যোগ করলে প্রায় ৯৭% বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কাজে লাগাতে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করতে হয়। নবায়নযোগ্য উৎস থেকে দেশে ইতিমধ্যে প্রায় ১,৩৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে গ্রিডে সংযুক্ত ৭০৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ, ৬৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার বায়ুবিদ্যুৎ, ২৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার জলবিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নবায়নযোগ্য বিদুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে এবং সেসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলে দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের অংশ আরও বৃদ্ধি পাবে ।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গ্রিডে সংযুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে ‘সোলার হোম সিস্টেমস’ ব্যবহার করে গ্রিড বিদ্যুতের সরবরাহ বঞ্চিত এলাকার মানুষ তাদের বিদ্যুৎ চাহিদার ন্যূনতম প্রয়োজন মিটিয়েছে। পরবর্তীতে, ছোট ছোট সোলার প্যানেলগুলোকে একত্রিত করে ‘মিনি গ্রিড’ সুবিধা গড়ে তোলা হয়েছে এবং বেশি সংখ্যক মানুষ তা থেকে বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করেছে। সৌর বিদ্যুৎ কাজে লাগিয়ে সেচ পাম্প চালানো এবং উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ গ্রিড লাইনে সরবরাহ ব্যবস্থা গত কয়েক বছরে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সেইসঙ্গে কল-কারখানা ও বড় বড় ভবনের ছাদের জায়গাগুলো কাজে লাগিয়ে ‘রুফটপ সোলার’ সিস্টেম থেকে ব্যবহারকারী উপকৃত হয়েছেন। সরকারের ‘নেট মিটারিং পলিসি’র অধীনে ‘রুফটপ সোলার’ সিস্টেম একই সাথে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিড লাইনে সরবরাহ করবার সুযোগ পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বড় পরিসরে ‘সোলার পার্ক’ বা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গ্রিড লাইনে সংযুক্ত সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে এবং নির্ধারিত চুক্তির অধীনে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে নবায়নযোগ্য সৌর বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠান ‘নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড’  এবং চীনের ‘চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন’ এর যৌথ মালিকানায় ২০২০ সালে ১ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ চায়না রিনিউয়েবল এনার্র্জি কোম্পানি লিমিটেড’ (বিসিআরইসিএল) গড়ে তোলা হয়। ‘বিসিআরইসিএল’ এর উদ্যোগে সিরাজগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নে, যমুনা নদীর প্লাবন ভূমিতে ২১৪ একর জমি ইজারা নিয়ে ৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। যমুনা বহুমুখী সেতুর পশ্চিম পার্শে¦ এই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র গত ১৪ জুলাই ২০২৪ থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে এবং জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। যমুনা নদীর প্লাবন ভূমিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গা বছরের উল্লেখযোগ্য সময়জুড়ে জলমগ্ন থাকে এবং ভরা বর্ষায় ৮-১০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। সে কারণে সেখানে পাইলিং করে মজবুত ২৭,০০০টি পিলার বসিয়ে তার উপরে প্রতিটি ৫৪৫ ওয়াট ক্ষমতার ১৫৬,৫৭৬টি সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। স্থাপিত পিলারগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে, যেন সোলার প্যানেলগুলো মাটি থেকে ৪-৭ মিটার উঁচুতে অবস্থান করে এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন কোনো বাধার মুখে না পড়ে। আন্তঃসংযোজিত সোলার প্যানেলগুলো সূর্যের আলোকে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর করে এবং তা নির্ধারিত সংযোগ ও ট্রান্সফর্মারের মাধ্যমে ১৩২ কিলোভোল্ট সঞ্চালন লাইনের জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। সোলার প্যানেল ও সন্নিহিত কেবল, ইনভার্টারসমূহ এমন উচ্চতায় স্থাপন করা হয়েছে যেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্র নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারে। তাছাড়া সূর্যের আলো অবারিতভাবে মাটি স্পর্শ করবার সুযোগ পাওয়ায় সিরাজগঞ্জ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি মৌসুম উপযোগী সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি ও মাছ চাষের সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব। ৬৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার সিরাজগঞ্জের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নে প্রায় ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে হয়েছে এবং চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সরকারের কাছে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১০.২০ মার্কিন সেন্ট মূল্যে আগামী ২০ বছর ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।

আমার প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং বাংলাদেশ চায়না রিনিউয়েবল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম জানান, বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ জমির স্বল্পতা। সেকারণে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র্র নির্মাণের জন্য তিনি খুঁজে বের করেছেন যমুনা নদী পাড়ের এই অকৃষি জমি। তবে এখানেও অকৃষি জমিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সাথে গ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডের দূরত্ব যত বেশি হবে, সংযোগকারী সঞ্চালন লাইন স্থাপনের ব্যয় তত বাড়বে। তাছাড়া, সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তনশীল। ফলে দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ও সামর্থ বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদিত বিদ্যুতের ২০-৩০% শতাংশ ‘স্টোরেজ’ সুবিধা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এর সাথে বাড়তি বিনিয়োগের এবং প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। তবে প্রচলিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান ব্যয়, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পরিবেশগত বৈরী প্রভাব বিবেচনায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের জন্য ক্রমাগত বাড়তি বিনিয়োগের বিকল্প নেই। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সোলার প্যানেলের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। ফলে অল্প জায়গায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ সম্প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বাস্তবতা ও পরিবেশের জন্য সেটি নতুন সম্ভাবনার সুযোগ বরং আরও সম্প্রসারিত করবে।

লেখাটির পিডেএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nineteen − 6 =