রাজনীতি: যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির ঘূর্ণিপাকে

মাহবুব আলম

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সবচাইতে আলোচিত বিষয় হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধা দেওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত করার সঙ্গে জড়িত বা দায়ী ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবে না। অর্থাৎ নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্থকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে ১. সুষ্ঠু ভোটে বাধা দানকারী ও ভোট চুরিতে জড়িত ব্যক্তি ও তাদের স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা। ২. ভোটে জালিয়াতিতে সহযোগিতাকারী সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিচারক। ৩. স্বাধীন মত প্রকাশ ও সভা সমাবেশে বাধাদানকারী ব্যক্তিবর্গ। ৪. ভোট কারচুপির জন্য যারা নির্দেশ দেবে এবং যারা সে নির্দেশ পালন করবে। ৫. সুষ্ঠু ভোটে বাধাদানকারী যাদের ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা আছে বা সে দেশে অবস্থান করছে তাদের ভিসাও বাতিল করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণার পর জাতীয় রাজনীতিতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এটা একটা বড় চাপ। এই চাপ সরকারি ও বিরোধী উভয় পক্ষের উপর। এর ফলে নির্বাচন প্রতিহত করার যে চেষ্টা করা হয়, তা করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। যে বা যারা নির্বাচন প্রতিরোধ করার কথা বলেন, তাদের অনেকেই মার্কিন ভিসা আছে। না থাকলেও মার্কিন ভিসা তাদের ও তাদের পরিবারের জন্য প্রয়োজন। আর এই কারণেই সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, মার্কিন ভিসা নীতি বিএনপির ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী তো সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন এখন আর নির্বাচন প্রতিরোধ করবো বলার সুযোগ নেই বিএনপির। তাই তাদের নির্বাচনে আসতেই হবে।

অন্যদিকে বিএনপি একে তাদের আন্দোলন যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। বিএনপির অন্যতম শীর্ষ নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির মধ্যে এই সরকার চাপেটাঘাত খেয়েছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর সরকারের সুর নরম হয়েছে।

এই সরকারের শরিক দলের নেতারাও সরাসরি নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। জোট সরকারের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন বলেছেন, মার্কিন ভিসা নীতির সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্পর্ক আছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি একে ষড়যন্ত্রমূলক খেলা বলে বর্ণনা করেছেন। ১৪ দলের আরেক নেতা হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননের মতোই বলেছেন, ঘোষিত মার্কিন ভিসা নীতি হচ্ছে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ। এর সাথে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক মহলের মতামত হচ্ছে, মার্কিন ভিসা নীতির ফলে সরকারের উপর যে চাপ তৈরি হয়েছে এর ফলে সরকারের কাছে ১৪ দলের গুরুত্ব বাড়বে। আওয়ামী লীগ ১৪ দলের শরীকদের আরো কাছে টানবে।
মার্কিন ভিসা নীতি শুধু রাজনৈতিক মহল নয় অন্যান্য সকল মহলসহ রাজনৈতিক সচেতন সকল মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। এমনকি একশ্রেণির আমলা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। কারণ আমাদের দেশের আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের অনেকের স্ত্রী পুত্র কন্যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। এবং তারা নিজেরা র‌্যান্ডম যাতায়াত করেন। শুধু তাই নয়, তাদের অনেকের সম্পদও রয়েছে সে দেশে। অবশ্য কোত্থেকে এই অর্থ সম্পদ এসেছে বা আসে সেই প্রশ্ন নাইবা তুললাম।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ১৭ কোটি মানুষের দেশে কতজন মার্কিন ভিসার জন্য আবেদন করেন, আর কতজন সেই দেশে স্ত্রী পুত্র কন্যাদের রাখেন? এ সংখ্যা খুব বেশি না। জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। কয়েক হাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বড়জোর এই সংখ্যা ১০ থেকে ২০ হাজার। সংখ্যা খুবই নগণ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই সামান্য বা নগণ্য সংখ্যক ব্যক্তিরা কার্যত দেশের ভাগ্যবিধাতা হয়ে বসেছে। এদের কর্মফলের উপর নির্ভর করে দেশের মানুষের ভাগ্য। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন ভিসা নীতি সকল মহলে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কিছু সংখ্যক অসৎ আমলা রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ীর দায়-দায়িত্ব নেবে কেন দেশ? উপায় নেই। ওরাই সব। ওরাই আইন। ওরাই আদালত। যাহোক এ নিয়ে সব থেকে বড় যে প্রশ্ন তা হলো, এর বাস্তবায়ন হবে কিভাবে? মার্কিন সরকার কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় ভিসা নীতি কার্যকর করবে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের রাজনীতিকরা কূটকৌশলে সব সময় বেশ পারদর্শী। একটা কথা আছে, রাজনীতিকরা কি না পারে। যেখানে নদী নেই সেখানেও সেতু বানাতে পারে। এটা শুধু কথার কথা নয়, বাংলাদেশে এটা প্রমাণিত সত্য। তাই আমাদের রাজনীতিকদের কূটকৌশলের কোনো অভাব হবে বলে মনে হয় না। শেষ পর্যন্ত কাদের উপর কিভাবে ঘোষিত ভিসা নীতি কার্যকর করবে যুক্তরাষ্ট্র তা দেখার জন্য আপাতত আমাদের অপেক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

তবে এখানে একটা কথা বলার দরকার, যে কোনো একটা দেশ কাকে ভিসা দেবে আর তা দেবে না এটা তাদের নিজস্ব বিষয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার জন্য অনেকেই ভিসার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু আবেদনকারীদের সকলের ভিসা পান না। আবার অনেকেই ভিসা পান। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নয়, এটা সব দেশের ভিসার ক্ষেত্রেও হয়। এমনকি প্রতিবেশী মিত্র দেশ ভারতের ক্ষেত্রেও হয়। ভারতীয় ভিসার জন্য যারা আবেদন করেন তাদের বড় অংশ ভিসা পেলেও অনেকেই ভিসা পান না। এটাই স্বাভাবিক। কারণ এটা প্রতিটা দেশের একেবারে নিজস্ব বিষয়। কিন্তু সদ্য ঘোষিত মার্কিন ভিসা নিতে কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে বিশেষ নীতি। ইতিমধ্যে বিষয়টি উল্লেখ করেছি। তাহলে এই ভিসা নীতি হচ্ছে বাংলাদেশের গঠনমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ বা ক্ষতিগ্রস্ত করার সঙ্গে জড়িত বা দায়ী ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে। তাই এ নিয়ে একদিকে যেমন ব্যাপক আলোচিনা হচ্ছে, অন্যদিকে এ নিয়ে কোনো কোনো মহলে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। এই প্রশ্ন হলো হঠাৎ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠল। এর পিছনে অন্য কোনো মতলব নেই তো। বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক বিষয়। এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক। কারণ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়া সব সময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বললেও আমরা দেখেছি বিশ্বের দেশে দেশে অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের মদদ যোগাতে। তাই এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে এটা যদি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অব্যাহত রাখতে ভূমিকা রাখতে চায় বা ভূমিকা রাখে তাহলে নিঃসন্দেহে দল মত নির্বিশেষে সকল মানুষ তাকে স্বাগত জানাবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × four =