রুনা’র হেয়ার স্প্রিং

নাহিন আশরাফ

হাজারো ব্যস্ততার মাঝে নিজের যত্ন নিতে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। দাদী নানীদের রূপচর্চার ইতিহাস শুনলে জানতে পারি তারা ব্যবহার করতেন হলুদ, চন্দন, নিমপাতা ইত্যাদি। কিন্তু এতো ব্যস্ততায় এইসব আয়োজন করার সময় কোথায়? তাই নিজের ত্বক ও চুল পরিচর্যার জন্য অনেক ব্র্যান্ড অনেক ধরনের পণ্য তৈরি করছে। কেমন হয় যদি সেই দাদী নানীদের ব্যবহার করা উপাদান দিয়ে আমরা ঘরে বসে চটজলদি নিজের যত্ন নিতে পারি? তাই সবার কাছে হারবাল উপাদান পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নিয়েছেন কানিজ ফাতেমা রুনা।

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ফেসবুকে খুলেন ‘হেয়ার স্প্রিং’ নামের একটি পেইজ। যার মাধ্যমে তিনি গ্রাহকদের হাতে তুলে দেন হারবাল তেল, ফেসপ্যাক ও হেয়ার টনিক। এতে উপকৃত হচ্ছেন অনেক মানুষ। প্রশংসা কুড়াচ্ছেন কানিজ ফাতেমা রুনা।

খুলনা শহরের মেয়ে রুনা, সেখানেই বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছা ছিল কোনো সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে। সব সময় চাইতেন ভিন্নধর্মী কিছু করবেন। এমন স্বপ্ন নিয়ে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলেন। কিন্তু চলার পথে উপলব্ধি করতে পারলেন যে নারীদের জন্য জীবন খুব সহজ নয়। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রায় সব নারীদের নানা বাধা বিপত্তি পার হতে হয়। তার বেলাতেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। অন্য দশটা নারীর মতো তারও সব জায়গায় ছিল বাধা। প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকেই। পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও ভিন্নধর্মী কিছু করবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছিল না। নানা রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও অস্থিরতার মধ্যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে রুনার প্রায়ই মনে হতো তিনি নিজের স্বপ্ন কী আসলেই পূরণ করতে পারবেন? পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষকতা করার সুযোগ পান। কিন্তু সে সুযোগ তিনি গ্রহণ করেননি। কারণ ঐ যে ইচ্ছা ছিল নিজের কিছু করতে হবে, ভিন্নধর্মী কিছুর সাথে নিজেকে জড়িত করতে হবে। পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে শুরু করেন ব্লক বাটিকের কাজ। তাকে সহযোগিতা করেছিলেন তার খালা। খালার বাসাতেই সমস্ত কাজ হতো। কিন্তু বাবার কাছে আচমকা ধরা পড়ে যান। ব্যস ব্লক বাটিকের কাজের সেখানেই ইতি। এর কিছুদিন পরেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর কোলে আসে প্রথম সন্তান।

বিয়ে, সন্তান ও সংসার। শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়, নতুন ব্যস্ততা। এতোকিছুর মধ্যেও নিজের স্বপ্নের কথা ভুলে যাননি তিনি। হারবাল পণ্যের প্রতি তার আগ্রহ অনেক আগে থেকেই। তিনি হারবাল উপাদান নিয়ে নানারকম বই পড়তেন ও এক্সপেরিমেন্ট করতে তার ভালো লাগত। রুনা তার বোন ও আশেপাশের সবার কাছেই প্রায় একটি কথা শুনতেন যে চুল পড়ে যাচ্ছে। প্রায় সবার মধ্যেই এই চুল পড়ে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা। তিনি ভাবলেন, হারবাল উপাদান দিয়ে এমন কিছু তৈরি করবেন যাতে প্রাকৃতিক উপায়ে এ সমস্যার সমাধান হবে। তিনি শুরু করেন এক্সপেরিমেন্ট। প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি করা শুরু করেন তেল। সেই তেল শুধুমাত্র পরিবারের লোকদের দিতেন ব্যবহারের জন্য। শুরুতে তার ব্যবসা করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। পরিবার ও বন্ধু মহলে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। সবাই তার বানানো পণ্যের প্রশংসা করতে থাকেন। কারণ এই তেল ব্যবহারে সবার চুল পড়া কমছিল ও নানা ধরনের উপকার পাচ্ছিলেন। এতে তার আগ্রহ ও উদ্দীপনা বেড়ে যায়। ২০২০ সালের শুরুতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন পেইজের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছে দিবেন তার বানানো হারবাল পণ্য।

শুরু হয় হেয়ার স্প্রিং-এর পথ চলা। কিভাবে তৈরি হয় হেয়ার স্প্রিং-এর পণ্য জানতে চাইলে রুনা জানান, হারবাল পণ্য তিনি নিজ হাতে তৈরি করেন। কোনো কেমিকেল ব্যবহার করা হয় না। হেয়ার স্প্রিং-এর পণ্য তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় ২০টির বেশি ভেষজ উপাদান। যেমন আমলকি, নিমপাতা, শিকাকাই, কালকেশি, রিঠা, হরিতকি, জবা, মেথি ইত্যাদি। আমলকি চুল ও ত্বক ভালো রাখতে সাহায্য করে এবং মাথা ব্যথা কমাতে সাহায্যে করে। নিমপাতা যেকোনো ফাংগাল ইনফেকশন সারিয়ে তোলে। মেথি চুল লম্বা করতে সাহায্য করে, চুল ঘন করে তোলে। চুল ও ত্বকের জন্য উপকারী এমন সব উপাদানের সংমিশ্রণে তৈরি হয় হেয়ার স্প্রিং-এর পণ্য।

হেয়ার স্প্রিং-এর প্রথম পণ্য হারবাল তেল। এটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। এই তেল ব্যবহার করে চুল পড়া রোধ করা সম্ভব। এছাড়া আগা ফাটা ও রুক্ষতা দূর করে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। খুশকির সমস্যা কমায়, চুল দ্রুত বৃদ্ধি পায়। স্কাল্পের যেকোনো ধরনের ইনফেকশন জনিত সমস্যা দূর হয়। এছাড়া এই তেল ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ। অনেকের ঘুমের সমস্যা থাকে। হারবাল তেল ব্যবহার করলে ঘুমের সমস্যা অনেকটা কমে যায়। এছাড়া হারবাল ফেইস প্যাকে দুই রকমের চন্দন ও ক্লে ব্যবহার করা হয়। এটি নিয়মিত ব্যবহার করলে মরা ত্বক উঠে আসে ও উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার হয় বলে ত্বকের ক্ষতি হওয়ার কোনো ভয় থাকে না।

কানিজ ফাতেমা রুনা জানান, হারবাল উপাদানের নির্যাস তার মন ভালো করে দেয়। তার একটি আলমারি আছে যা হারবাল উপাদানে ভর্তি। যখন তিনি বিষণ্ন্নতা অনুভব করেন তখন আলমারি খুলে ঘ্রাণ নেন। এতে তার মন অনেক হালকা হয়ে যায়। তিনি এই আলমারির নাম দিয়েছেন ‘জাদুর আলমারি’। আরো ভালো কিছু তৈরি করার ইচ্ছা থেকে তিনি এখনো হারবাল পণ্য নিয়ে প্রচুর পড়ালেখা করেন। আজকাল হারবাল উপাদানের অনেক চাহিদা, মানুষ চায় প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে রূপচর্চা করতে। তাই আরও অনেকের হারবাল পণ্য নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন রুনা।

হারবাল পণ্য তৈরির পাশাপাশি রুনার আরেকটি শখ ফ্যাশন ডিজাইনিং। এছাড়া তিনি নিজের ঘরকে নান্দনিকভাবে সাজাতে পছন্দ করেন। অবসরে নিজের ঘর সাজান ও হারবাল বিষয়ে পড়ালেখা করেন। তিনি প্রথমেই চান গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করতে। কারণ সবাই তাকে বিশ্বাস করে তার পণ্য কিনছে, রূপচর্চায় ব্যবহার করছে; তাই কারো যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে তিনি সবসময় লক্ষ্য রাখেন।

যারা ভবিষ্যতে হারবাল পণ্য নিয়ে কাজ করতে চান তাদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, প্রথমে প্রাকৃতিক উপাদান সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে। কারণ সব প্রাকৃতিক উপাদানই যে ত্বকের জন্য ভালো, এমন না। হারবাল উপাদান নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। বাজারে হারবাল উপাদান নিয়ে বইপত্র পাওয়া যায় তা ঘেঁটে দেখতে হবে। সবকিছু জেনে তারপর হারবাল পণ্য তৈরি করতে পরামর্শ দেন তিনি। সফলতা অর্জনের জন্য প্রতিটি মানুষকে কিছু শ্রম তো দিতেই হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × 1 =