রেকর্ডময় সেমি ফাইনালে ব্লাকক্যাপসদের উড়িয়ে শিরোপা জয়ের দুয়ারে ভারত

সালেক সুফী

কাল ভারতের বলিউড নগরী মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বসেছিল তারার মেলা। খেলার মাঠে যেমন নীল গ্যালারিও ছিল তারার দীপ্তিতে উজ্জ্বল। ব্যাটিং বোলিং সব কিছুতেই ছিল রেকর্ডের ছড়াছড়ি। প্রথম ব্যাটিং করে ভারত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে নক আউট পর্যায়ে সর্বোচ্চ স্কোর ৩৯৭/৪ করেছিল বিরাট কোহলির চারটি রেকর্ডস ভর করে। রান তাড়ায় নিউ জিল্যান্ড এক সময় কক্ষপথে আগুয়ান ছিল। কিন্তু মোহাম্মদ সামীর আগুনে বোলিং (৭/৫৭) জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করলো ব্ল্যাকক্যাপসদের।  ৪৮.৫ ওভার খেলে ৩২৭ রানে থেমে গেলো ব্ল্যাকক্যাপস প্রতিরোধ।  ভারত ৭০ রানে জিতে পৌঁছে গেলো তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের দুয়ার প্রান্তে।

কাল ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ৬ নম্বর উইকেটে খেলা হয়েছিল। সাধারণত নক আউট ম্যাচগুলো অব্যবহৃত নতুন উইকেটে হয়ে থাকে। কথা ছিল ম্যাচটি হবে ৭ নম্বর উইকেটে যেখানে এবারের বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ হয়নি। কিন্তু ভারত দলের অনুরোধে খেলা হলো ৬ নম্বর উইকেটে যেখানে এই বিশ্বকাপে এর আগে দুটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখানেই দক্ষিণ আফ্রিকা ইংল্যান্ডকে ২২৯ রানে হারিয়েছিল। ভারত ৩০২ রানের বিশাল ব্যাবধানে উড়িয়ে দিয়েছিলো শ্রীলংকাকে।  উইকেটের এই পরিবর্তন নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন ম্যাচের আগে আইসিসি নিয়োজিত উইকেট তত্ত্বাবধায়ক এন্ডি আটকিন্সন।

যাহোক সেই কথা। টস জয়ী রোহিত বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। দেখে মনে হয়েছে যেন নাটকের পর্বগুলো পুর্ব নির্ধারিত ছিল। সূচনায় খুনে মেজাজে থাকা রোহিত ২৯ বলে ৪৭ রানের আগুনে সূচনা করে ভারতের রান মেশিন চালু করে সুবমান গিল, বিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আয়ারদের জন্য শক্ত প্লাটফর্ম গড়ে দিলো। এবারের বিশ্বকাপে রোহিত কিন্তু ইতিমধ্যেই বিশ্বকাপে প্রথম পাওয়ার প্লেতে সর্বোচ্চ রান, সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট, সর্বোচ্চ গড়, সবচেয়ে বেশি চার ,ছক্কার রেকর্ড গড়েছে।

কাল ভারত ক্রিকেটের গণ দেবতা  শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের নিজের মাঠে, তার উপস্থিতিতে ভারত কিংবদন্তি তার ক্রিকেট জীবনের ৫০ম সেঞ্চুরি ১১৭ রান করে সচিনের ৪৯ম শতরানের রেকর্ড ম্লান করে দিলো। একই সঙ্গে স্থাপিত হলো আরো তিনটি মাইলফলক। একই বিশ্বকাপে ৮টি ৫০+ রান করে বিরাট, ২০০৩ বিশ্বকাপে শচীনের ৭টি ৫০+ স্কোরের রেকর্ড অতিক্রম করে। এই বিশ্বকাপে বিরাট ইতিমধ্যেই ৭১১ রান সংগ্রহ করেছে। এতদিন শচীনের ২০০৩ বিশ্বকাপে করা ৬৭৩ ছিল এক বিশ্বকাপে করা সর্বোচ্চ সংগ্রহ।

ফাইনালে উন্নীত ভারত।  কোহলির সুযোগ আছে সংগৃহীত রান আরো উন্নত করার। ভারত ইনিংসে কাল সবাইকে ছাড়িয়ে যায় মেধাবী প্রস্ফুটিত হতে থাকা শ্রেয়াস আয়ারের ৭০ বলে করা ১০৫ রানের ইনিংস। এই বিশ্বকাপে এটি ছিল তিনটি দ্রুততম শত রানের একটি। দক্ষিণ আফ্রিকার এইডেন মারকরাম আর ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা করেছেন আরো দ্রুত দুটি শতরান।

ভারতের ইনিংসে বিরাট কোহিলি ১১৭, শ্রেয়াস আয়ার ১০৫, সুবমান গিল ৮০, রোহিত ৪৭, কে এল রাহুল ৩৯* রান সংগ্রহ করে বিশ্বকাপের নক আউট পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩৯৭/৪ সংগ‍ৃহীত হলো। ম্যাচ পরিস্থিতি বিবেচনায় কাল হয়তো ৩০-৪০ রান বেশি সংগ্রহ করেছিল ভারত। উইকেট মাঝে মাঝে চরিত্র পরিবর্তন করেছে। টিম সাউদি (৩/১০০) ছিল এদিনে সফল কিউই বোলার।  ভারতের ব্যাটিংতান্ডবে অন্য কেউ কিছু করতে পারেনি।

কাল কিন্তু শিশির পড়েনি।  তাই দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতীয় বোলিংয়ের সামনে কোনো প্রাকৃতিক বাধা ছিল না। বল হাতে কাল মোহাম্মদ সামি ছিল অপ্রতিরোদ্ধ।  সূচনায় পর পর ডেভন কোনওয়ে (১৩) এবং রাচীন রাভিন্দ্রের (১৩) উইকেট তুলে নিয়ে সামি কিউই বাটিংয়ে বাধার প্রাচীর তুলে দেয়। কিন্তু এরপর তৃতীয় উইকেটে অনবদ্য ১৮১ রানের জুটি গড়ে ড্যারিল মিচেল (১৩৪ ) এবং অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন (৬৯) ভারত শিবিরে কাঁপন তুলেছিল।

কিন্তু কালকের ম্যাচে সংহারী মূর্তি নিয়ে আবির্ভূত সামি অসামান্য দক্ষতায় সিম, সুইং মেশানো বোলিং (৭/৫৭) করে নিউ জিলল্যান্ড ইনিংসকে ৩২৭ রানে সীমিত রাখে। ৭০ রানের বিশাল ব্যাবধানে জয়ী ভারত এখন ফুরফুরে মেজাজে প্রস্তুতি নিতে পারবে ফাইনাল খেলার। প্রশংসা করতেই হবে ড্যারিল মিচেলের ১১৭ বলে ১৩৪ রানের ইনিংস, লেট্ মিডল অর্ডারে গ্লেন ফিলিপসের ৪১ রানের ইনিংসটি আরো কিছু বিস্তৃতি পেলে হয়তো আরো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তো ভারত।

পরিশেষে স্বীকার করতেই হবে দ্বিধাহীন চিত্তে সেরা দল হিসাবেই ফাইনালে পৌঁছেছে ভারত। একমাত্র অপরাজেয় দলটি এখন অপেক্ষা করবে আজকের খেলায় অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার  ম্যাচে বিজয়ী দলের। নানা উত্থান পতনের সাক্ষী হয়ে আরো একটি স্মরণীয় বিশ্বকাপ শেষ করলো নিউ জিল্যান্ড, শেষ বেলায় কেন উইলিয়ামসন, টিম সউদী, ট্রেন্ট বোল্ট রাঙ‍াতে পারলো না ব্ল্যাক ক্যাপসদের। বিশ্বক্রিকেট ওদের স্মরণে রাখবে সন্দেহ নেই।  রাচীন রাভিন্দ্রা, ড্যারিল মিচেল, ডেভন কোনওয়ে আগামী দিনের কান্ডারি হবে।

ভারত এবারের বিশকাপে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করেই ফাইনালে উত্তীর্ণ।  ওদের হারিয়ে জয় পেতে অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকাকে আউট অফ দি বক্স ক্রিকেট উপহার দিতে হবে। ৪-৫ জন ব্যাটসম্যান খুনে মেজাজ ছন্দে আছে।  ৫ জন বোলার আছে তুখোড় ছন্দে। আমার স্মরণে আসছে ১৯৭০ দশকের ক্লাইভ লয়েড নেতৃত্বের সর্বজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ  এবং ১৯৯০, ২০০০ দশকের স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিংয়ের অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়া দলকে। আকাশ এখন সীমানা রোহিত শর্মার ভারত দলের।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

thirteen − two =