রোমাঞ্চকর শহর ভেনিস

তানভীর অপু: অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ৩ ঘণ্টার ফ্লাইটে মাত্র ৩ হাজার টাকায় যাচ্ছি ভেনিস। এর আগে ২০০৯ সালে গিয়েছিলাম চমৎকার এই শহরটিতে। এটি পৃথিবীর একমাত্র শহর যেখানে নেই কোনো যানবাহন, পায়ে হেঁটে চলতে হয় সব জায়গায়। রোমাঞ্চকর এই শহরটিতে আবারো যাওয়ার সুযোগ পেলাম। ধন্যবাদ রায়নএয়ার, এমন সুন্দর একটি অফার দেওয়ার জন্য। তবে এই টিকিটের কিছু শর্ত আছে। যেমন আপনি লাগেজ নিতে পারবেন না। শুধু একটা ব্যাগ সাথে নিতে পারবেন। যদি লাগেজ নেন তাহলে অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে। আবার যদি আপনি সিট আপনার পছন্দমতো নিতে চান; তাহলে তার জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে। এমনকি আপনি যদি বিমানবন্দরে গিয়ে চেক ইন করার কথা ভাবেন, তাহলেও আপনাকে গুনতে হবে অতিরিক্ত টাকা। তাই একটু বুদ্ধি করে এই টিকিট কাটতে হয়। আশা করি আপনাদের চমৎকার সব ছবি এবং ভিডিও উপহার দিতে পারবো। ততক্ষণ পর্যন্ত সাথে থাকুন, ধন্যবাদ।

চলে আসলাম ইতিহাস বিখ্যাত পর্যটক এবং আমাদের ভ্রমণগুরু মার্কোপোলোর জন্মস্থান ভেনিসে। পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য একটি শহর ভেনিস। ছোটবেলা থেকে মার্কোপোলোকে নিয়ে অনেক বই পড়েছি এবং মুগ্ধ হয়েছি যিনি পায়ে হেঁটে জয় করেছেন পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ। এখন সেই ভ্রমণগুরুর জন্মস্থানে দাঁড়িয়ে বারবার মনে হচ্ছে, তিনি যেন শহরেরই কোথাও থেকে আমাকে উঁকি দিয়ে দেখছেন। এই ভেবে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে আবারও। ভেনিস এমন একটি শহর যেখানে শতবার আসলেও মনের তৃষ্ণা মিটবে না। তাই ঘুরে বেড়াবো এই শহরের আনাচে-কানাচে, অলিতে গলিতে। ততক্ষণ পর্যন্ত সাথেই থাকুন, ধন্যবাদ।

এটিই পৃথিবীতে একমাত্র শহর যেখানে রাস্তা দিয়ে কোনো যানবাহন চলে না। ট্রেন কিংবা বাস কিছুই নেই এখানে, এমনকি একটা সাইকেলও নেই। সব যাতায়াতই হয় ছোট ছোট নৌকায় চড়ে অথবা পায়ে হেঁটে! ৩ লাখ নাগরিক বুকে ধারণ করা ভেনিসে আছে ১১৮টি ছোট-বড় দ্বীপ। গোটা ভেনিস জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ১৭৭টির মতো খাল। এদের যুক্ত করেছে প্রায় ৪০০ ব্রিজ, ভাবতে পারেন! বর্তমান যে ভেনিস শহর আমরা দেখি, তা একদিনে গড়ে উঠেনি। সেখানে ভবন নির্মাণ ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। কয়েক শতক ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠেছে আজকের ভেনিস। চতুর্থ শতকে জলদস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ দলে দলে এখানে পালিয়ে আসে। জলমগ্ন এই এলাকায় গড়ে তুলে আস্ত একটি শহর। এরপর ক্রমেই নগরটির লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে। গাড়ি চালানোর জন্য ভেনিসে স্থলপথ নেই বললেই চলে। এখান বাসিন্দাদের একমাত্র বাহন ‘গন্ডোলা’ নামের বিশেষ নৌযান। ভেনিস সংস্কৃতির অঙ্গ এই ‘গন্ডোলা’ ঐতিহ্যবাহী পর্যটকের দৃষ্টি কাড়ে। যদি কেউ নৌকায় না চড়েন তবে খালের পাশেই রয়েছে হাঁটার জন্য পথ। যেখান দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। কিছু পরপরই দেখা মিলবে প্রাচীন ও সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থাপনার। ভেনিসের বাড়িগুলো আজও ঠিক তেমনি আছে, যেমনটা ছিল পাঁচশ থেকে হাজার বছর আগে। আছে পুরোনো বন্দর, নানা কাজে ব্যবহৃত বড় অফিস ও বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। বাড়িগুলোর কারুকার্য আর স্থাপত্যশৈলী দেখলে যে কারও নজর জুড়িয়ে যেতে বাধ্য।

ভেনিস শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে ছোট-বড় অসংখ্য খাল। যেখানে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম হলো গন্ডোলা বা ছোট ডিঙি নৌকা। যারা গন্ডোলা চালান, তাদের বলে গন্ডোলিয়ার। একাদশ শতাব্দী থেকে চলে আসছে এই পেশা। একটা সময় ছিল যখন ছই দেওয়া গন্ডোলা চলাচল করতো। যাতে চড়ে ধনীরা ভেনিসের খালপথে এখানে ওখানে যেতেন। মালপত্রও বহন করতেন এই গন্ডোলাতে করেই। তখন পুরো ভেনিসে দশ হাজারের মতো গন্ডোলা ছিল। আজ সেখানে বড়জোর পাঁচশর মতো গন্ডোলা টিকে আছে। তাও শুধুমাত্র টুরিস্টদের জন্য। অনেক ট্যুরিস্টের তো স্বপ্নই থাকে প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে গন্ডোলায় ঘোরার। গন্ডোলায় চড়ে ৪৫ মিনিট বেড়ানোর জন্য টুরিস্টদের গুনতে হয় ৮০ ইউরো। গন্ডোলার মাঝি হতে চাইলে মানতে হয় বেশকিছু নিয়ম কানুন। লাইসেন্স পেতে গন্ডোলিয়ারদের নিতে হয় একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ। আগত পর্যটকদের সঙ্গে ঠিকঠাক কথা বলতে শিখতে হয় বিদেশি ভাষা। জানতে হয় ভেনিস শহরের ইতিহাসের আদ্যোপান্ত। কেউ কেউ তো গান গেয়ে মুগ্ধ করেন গন্ডোলা যাত্রীদের। তাদের নিতে হয় বিশেষ ধরনের গেটআপ। গন্ডোলিয়ার অনেকটা শৌখিন পেশা। হাতেগোনা মাত্র ৪০০ গন্ডোলিয়ারের এই পারমিট আছে। তাইতো মাঝি হওয়ার স্বপ্নও দেখেন অনেক যুবক।

ভেনিসের ঐতিহ্যবাহী মুখোশ। বিভিন্ন রঙের-বর্ণের, পশুপাখি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মুখোশের দোকানের দেখা মিলবে ভেনিসের প্রতিটি অলিতে গলিতে। প্রতিবছর এই শহরে চমৎকার একটি উৎসব হয় এবং তারা বিভিন্ন ধরনের মুখোশ পরে এই উৎসবটি উদ্যাপন করেন। এজন্য এখনকার মুখোশ খুবই বিখ্যাত সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে।

নিঃসন্দেহে রোমিও-জুলিয়েটের প্রেম আজও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। যেন ভালোবাসার অপর নাম রোমিও-জুলিয়েট। যার উপর ভিত্তি করে উইলিয়াম শেক্সপিয়র রচনা করেন কালজয়ী ট্রাজেডি। যুগ যুগ ধরে পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে এই প্রেমকাহিনি। ইতালির ভেরোনা শহরে শেক্সপিয়র কোনদিনই যাননি। কিন্তু এই শহরকে উপজীব্য করে তিনি লিখেছেন তিন তিনটি নাটক। যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পায় ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’। এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে প্রায় শতবর্ষ ধরে সেটি অভিনীত হয়। সেই সময় ইতালির শহরগুলো ছিল স্বাধীন। যা পরিচালিত হতো প্রভাবশালী ও বিত্তশালী পরিবার দ্বারা। তখন পরিবারে পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ, হানাহানি ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। এমনই একটি আবহে ভেরোনা শহরকে ভিত্তি করে লেখা হয় রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট। রোমিও আর জুলিয়েটের পরিবারের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক ছিল। দুটি ভিন্ন পরিবারের পূর্ববর্তী রেষারেষি, অহংকার ভেদ করে দুজন তরুণ-তরুণী প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ে যায়। পরবর্তীতে পরিবারের শত বাধা উপেক্ষা করে নানা নাটকীয়তার মাঝে তারা বিয়ে করে। কিন্তু দুই পরিবারের শত্রুতার জেরে বিষপানে আত্মহত্যা করে তারা। পৃথিবীতে যখনই প্রেমের জন্য ত্যাগ- তিতিক্ষার কথা বলা হয়; সবার আগেই উঠে আসে এই তরুণ যুগলের নাম! ভালবাসার জন্য তাদের ত্যাগ আজো সবার হৃদয়ে নাড়া দেয়। অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় বন্ধু আজিম দেওয়ানকে এতো সুন্দর একটি জায়গায় আমাকে ভ্রমণ করানোর জন্য।

পৃথিবীবিখ্যাত সেন্ট মার্কস ক্যাথেড্রাল যার বয়স দুই হাজার বছর। বাইজেন্টাইন, রোমানেস্ক এবং রেনেসাঁ স্থাপত্যের মিশ্রণ দেখা যায় এখানে। ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীর অনন্য এক নিদর্শন সেন্ট মার্কস ক্যাথেড্রাল। স্বপ্ননগরী ভেনিসের বিখ্যাত স্থানগুলোর মধ্যে এটি একটি। হাজার বছরের পুরোনো ক্যাথেড্রালটি কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে। নবম শতাব্দীর গোড়ার দিকে সুন্দর এই গির্জাটি নির্মিত হয়। যদিও প্রথম দিকে তা ব্যবহার হতো শুধু মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য। ১৮০৭ সালে প্রথম চার্চে রূপান্তরিত হয়। গির্জার অনন্য নির্মাণ শৈলী দেখার মতো। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বহু শতাব্দী ধরে এটি পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার হয়ে আসছে। সিংহদ্বারে শোভা পাচ্ছে বিশাল আকৃতির চারটি ধাতব ঘোড়ার ভাস্কর্য। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ইস্তাম্বুল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে এগুলো। সেই থেকে ভেনিসই এদের শেষ ঠিকানা হয়ে উঠে। চমৎকার এই ক্যাথিড্রালটির চুড়ায় রয়েছে ব্যতিক্রমী পাঁচটি গম্বুজ। যার প্রতিটির অভ্যন্তরে রয়েছে ষোলটি করে জানালা। প্রধান গম্বুজটিকে বলা হয় অ্যাসেনশন ডোম। ৪ হাজারের বেশি সোনালি রঙের মোজাইক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রধান গম্বুজটি। আর এই কারণে একে গোল্ডেন চার্চ নামেও ডাকা হয়। গির্জার ভিতর থেকে সঠিক ভাবে, তিনটি সোনার গম্বুজ দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। সোনালি মোজাইক ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মার্বেল দিয়ে সজ্জিত। মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে অসংখ্য মার্বেল ও কাঁচের টুকরো। অল্প আলোতেও যা জ্বলজ্বল করতে থাকে। চার্চের মূল অংশে ব্যবহার করা হয়েছে ২৪ ক্যারেটের সোনার পাত। এছাড়া ২ হাজার রত্ন এবং মূল্যবান পাথর দিয়ে সজ্জিত গম্বুজের অভ্যন্তর ভাগ। বাহিরের দেয়ালে বাইবেলের নানা কাহিনি চিত্রকর্মের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেন্ট মার্কস ক্যাথেড্রালটি ভেনিসের গৌরব বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে।

গারদা লেক। এই লেকের জল যেন কারো চোখের মতো টলমল। যেন বিষাদ ছড়ানো আকাশনীল, কিংবা কেবলই ভালোবাসার নীল স্বপ্নজাল। লেকটি ১৫ লক্ষ বছরের পুরাতন। বরফযুগে পাহাড়ে জমা বরফ জল জমে এমন সুন্দর লেকটির সৃষ্টি। লেক ঘিরে গড়ে উঠেছে অনেক স্থাপনা। লেকের জলের আলাদা আহ্বান আছে বা থাকে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে অসংখ্য পর্যটকের ভিড় হয় এই এলাকায়। কথিত আছে, পরিবেশ ও ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে এই লেকটির আবহাওয়া বেশ স্বাস্থ্যকর। অনেক রোগ থেকে মুক্তি কিংবা মন ভালো করার জন্য ডাক্তারের পরামর্শে হাওয়া বদল করতে অনেকে এখানে আসেন। আমি যখন লেকের চারপাশ ঘুরছিলাম তখন মনে মনে ভাবছিলাম…
‘এই লেকের হাওয়া
হাজার টাকার দাওয়া’

গাদ্দা লেকের পাশে গড়ে ওটা শহরটির নাম হলো গাদ্দা। একটি ভেরোনা জেলার ভিতরে অবস্থিত। এটি ছিল আমার ভ্রমণ করা পৃথিবীর ৮৬৬তম শহর। কী চমৎকার ছিমছাম গোছানো পাহাড়ের পাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় অনেক পুরোনো একটি শহর। ইতালির অন্যতম টুরিস্ট স্পট এই শহরটিতে প্রত্যেক বছর কয়েক লক্ষ ভ্রমণ পিপাসু মানুষ আসে। কারণ এই লেকটির পানি এতো স্বচ্ছ এবং এখানকার আবহাওয়া এতই বিশুদ্ধ যে ডাক্তাররা এখানে আসতে রেফার করে সব সময়। এখানে জার্মান এবং স্পেনের ভ্রমণ পিপাসু মানুষ অনেক বেশি আসে। বন্ধু আজিম দেওয়ানের জোরাজুরিতেই এই শহরটিতে আমার আসা। ভালো লেগেছে এখানকার সবকিছু। বেশ কিছু বাঙালির বসবাস রয়েছে এখানে। আমি সবসময় চেষ্টা করি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় জায়গাগুলোতে গিয়ে জীবনের যত কষ্ট ক্লান্তি আছে সেগুলো ভুলে সময়টুকু উপভোগ করার। এবং ফেসবুকের বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করি যাতে করে আপনারাও এই সুন্দর চমৎকার জায়গাগুলোতে যেতে পারেন। পাহাড়ের উপর থেকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে বিদায় বলতে হলো প্রিয় শহর গাদ্দাকে। তবে আবারো ফিরতে চাই এ শহরে কোনো একদিন। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই ১৫ লক্ষ বছরের পরোনো এই লেকের পাশে। বন্ধু, আছেন কি? অসংখ্য ধন্যবাদ আবারও।

রোমান্টিক রাতের ভেনিসকে বাই বাই বলে চমৎকার একটি ভ্রমণ শেষ করলাম। রাতের ভেনিসটা ছিল অনেক অন্যরকম। আপনাদের মাঝে শেয়ার করলাম।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ঘুরে বেড়ানো

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × five =