রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীন গুরুত্বপূর্ণ

হাবিব রহমান

মিয়ানমারের প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে অবস্থান করছে। প্রায় সাত বছর আগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। এর পাশাপাশি আগে থেকেই কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। এই দীর্ঘ সময়ে রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি সহায়তা কমেছে। ফিকে হয়ে আসছে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাও। এ অবস্থায় চীনের ভূমিকা মুখ্য হয়ে উঠছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও স্বল্পমাত্রায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আশার আলো দেখা গিয়েছিল কিন্তু সম্প্রতি মিয়ানমারের যুদ্ধপরিস্থিতির কারণে সেই সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তো প্রত্যাবাসনের আলোচনাও ঢাকা-নেপিদোর মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন রঙবেরঙকে বলেন, ‘যে পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গারা এদেশে আশ্রয় নিয়েছিল এখন তো মিয়ানমারে সে পরিস্থিতিই বিরাজ করছে। যুদ্ধের মধ্যে তাদের ঠেলে দেওয়া কিছুতেই সমীচীন হবে না। যুদ্ধ শেষ হতে হবে আগে। সেখানে প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি হবে। তারপর প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তেমন ভূমিকা নিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব রোহিঙ্গাদের অর্থসহায়তা দিয়েছে কিন্তু প্রত্যাবাসন নিয়ে মার্কিন ভূমিকায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি ঢাকা। মিয়ানমারের কয়েকজন জেনারেলকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ছাড়া তেমন উদ্যোগ নেই দেশটির।

এ অবস্থায় চীনের ভূমিকাকেই বড় করে দেখছেন কূটনীতিকরা। বর্তমানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চীন মধ্যস্থতা করছে। জান্তাদের সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চীনা মধ্যস্থতায় নিউ ইয়র্ক ও বেইজিংয়ে তিনটি বৈঠকও হয়েছে ঢাকা-নেপিদোর মধ্যে।

কূটনীতিকরা বলছেন, চীন একমাত্র দেশ যার সঙ্গে মিয়ানমার সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি-উভয়ের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই যুদ্ধের পর যে পক্ষই বিজয়ী হোক না কেন তাদের উপর চীনের প্রভাব থাকবে। এক কারণেই বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার সুসম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীন যে গুরুত্বপূর্ণ সেটি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালেও দেখা গেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ভারতের সহযোগিতা চাইলে নয়াদিল্লি ঢাকার কর্মকর্তাদের বেইজিংয়ের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। বিষয়টি তখন নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ নিজেই সাংবাদিকদের জানান। জবাবে নয়াদিল্লিকে ঢাকা বলেছে, বেইজিং সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন।

চীনে দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মুন্সি ফয়েজ আহমেদ রঙবেরঙকে বলেন, ‘চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এক্ষেত্রে বেইজিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো যেতে পারে। ভারতের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমাদের নিরাশ হওয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু চীন এখানে সংযুক্ত হয়েছে তাই তারা অবশ্যই চেষ্টা করবে যে এটা যেন একটি সফল পরিণতির দিকে যায়। পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর দেশ চীন। এখন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তাদের প্রচেষ্টা যদি সফল পরিণতির দিকে না যায়, তাহলে তাদেরও তো মুখ রক্ষা হবে না।’

এ অবস্থায় ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলছেন, রাখাইনে যুদ্ধবিরতিতে মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করছে চীন। অতীতেও রাখাইন রাজ্যে চীনা মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়েছিল বলে জানান তিনি।

সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘চীন রাখাইন রাজ্যে আরেকটি যুদ্ধবিরতি নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করছে, যাতে খুব দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রত্যাবাসন ইস্যুটি এমন একটি বিষয় যা আমরা বেশ গভীরভাবে আলোচনা করেছি। আমরা বুঝতে পারছি, এখন আমরা কঠিন দিনের মুখোমুখি। কিন্তু আমাদের আত্মবিশ্বাসী হওয়া দরকার।’ রাষ্ট্রদূত ইয়াও বলেন, ‘চীন তার ভূমিকা অব্যাহত রাখবে এবং আশা প্রকাশ করে যে রোহিঙ্গারা যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে সে ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার নিযুক্ত থাকবে।’

সম্প্রতি ঢাকা সফর করা চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানচাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতকালে জানান, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এই সংকট সমাধানে তারা কাজ করছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি জটিল। এমনকি মিয়ানমার সরকারও কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারবে সে রকম অবস্থা তাদের নেই। তাদের যে গৃহযুদ্ধ, সংঘাতময় পরিস্থিতি রোহিঙ্গা সংকট জটিল করে ফেলেছে।

এ অবস্থায় ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশন ক্রাইসিস গ্রুপও বলছে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুটি ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ২০২৩ সালের শুরুর দিকে নেপিদো এবং ঢাকা প্রত্যাবাসনের একটি পাইলট প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকা চীনের পাশাপাশি দুইপক্ষ (নেপিদো এবং ঢাকা) বিভিন্ন কারণে এ নিয়ে অগ্রগতি সাধনে আগ্রহী। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নভেম্বরে রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী এবং দেশটির অন্যতম শক্তিশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে নতুন করে লড়াই শুরু হয় যা নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনকে কার্যত অসম্ভব করে তুলেছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two + 10 =