লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল গঠনে সম্মত হয়ে উন্নত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নৈতিক দায় মেনে নেওয়া বড় অর্জন: হাফিজুল ইসলাম খান

আফরোজা আখতার পারভীন

কপে আমরা শুধু টাকা পাওয়ার আশায় যাই না। আমরা যাই জলবায়ু দূষণ রোধে নতুন পলিসি তৈরি করার জন্য। যাতে গোটা পৃথিবী উপকৃত হয়। এবারের কপে আমরা লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল গঠনের -এর সিদ্ধান্ত পেয়েছি। এখন প্রতিষ্ঠান হবে, বাস্তবায়নের জন্য নীতিমালা হবে। অনেক দেরিতে হলেও এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখা গেছে। এখন দেখার বিষয় হলো ট্রানজিশনাল কমিটি কতটা সফলতার সাথে ক্ষয়-ক্ষতির পরিসংখ্যান নির্ধারনের কৌশল, অর্থায়নের উত্‌স ও পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে সুপারিশ উপস্থাপন করতে পারে।

বিসিপিসিএল-ইপি ক্লাইমেন্ট টকস-এ অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন, এলডিসি গ্রুপের সমন্বয়ক এম হাফিজুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, লস অ্যান্ড ড্যামেজ-এর দুটো দিক আছে। একটি হলো জলবায়ু দূষণের জন্য উন্নত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, অন্যটি হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সতর্কবার্তা যে, তোমরা দূষণ কমাও, নইলে তোমাদেরকেও অর্থ দিতে হবে। একই সাথে এটা সবাইকে অভিযোজন প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে বলছে।

তিনি বলেন, আমাদের মূল ইস্যু গ্রিন হাউজ বা কার্বন দূষণ হ্রাস করা। যারা দূষণ কমাবে না বা ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে অভিযোজনের জন্য টাকা দেবে না, তাদেরকে ভবিষ্যতে অনেক বেশি ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সেদিক থেকে লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল বিষয়টা জলবায়ু দূষণ ইস্যুতে সবচেয়ে সেরা উদ্যোগ। কারণ এটা নিয়ে গত তিরিশ বছর ধরে কথা বলতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত উন্নত দেশগুলো এ প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।

স্বল্পন্নোত দেশগুলোর গ্রুপ এলভিসির সমন্বয়কারী আরও বলেন, আমি লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে আশাবাদী। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি দূষণ হ্রাসের পক্ষে। কারণ ওটাই একটা স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে। দূষণ কমানোর জন্য রাষ্ট্রগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে।

অ্যানার্জি অ্যান্ড পাওয়ার ম্যাগাজিন আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাফিজুল ইসলাম বলেন, প্যারিস সম্মেলনে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছিলো। নিশ্চয়ই বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরকে সহায়ক সহায়ক শক্তি হিসাবে স্বাগত জানানো যেতে পারে যেতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, জলবায়ু দূষণ বা পরিবর্তন একটা বৈশ্বিক বিষয়। এখানে দায়ী এবং ক্ষতিগ্রস্ত হলো রাষ্ট্র। এখানে প্রয়োজন পাবলিক ফাইনান্স এবং  ভর্তুকি বা অনুদান। ঋণ নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আসবে মুনাফা করতে। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, হলো ব্যাংক। ব্যাংক সব সময়ই ঋণের নীতিমালা তৈরি করবে এবং মুনাফা খুঁজবে। কিন্তু জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর জন্য প্রয়োজন অনুদান।

তিনি বলেন, আমরা যে এনডিসি পেশ করেছি, অভিযোজনের জন্য আমাদের অনেক টাকা দরকার। এখানে আমরা পাবলিক ফান্ড প্রত্যাশা করি। এখানে যদি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের যুক্ত করতে হয়, তবে খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন আবার রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ না করে।

হাফিজুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের হার শতকরা ৪৫ বা ৪৩ শতাংশ কমানো যাবে কি না। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর উষ্ণায়ন ১.৫ সেন্টিগ্রেডে রাখা যাবে কিনা তাও সংশয়ের মধ্যে পড়েছে। যুদ্ধাবস্থার কারণে গোটা বিশ্বে নতুন করে জ্বালানি সংকট দেখা দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে আগামী দিনের জ্বালানি আবার কয়লা হতে পারে।

তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বটে, কিন্তু বাস্তবে তাদের কাছ থেকে কার্যকর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। উন্নত দেশগুলো চাইছে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো: যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, চীন ও সৌদি আরবের অংশগ্রহণ। একই সাথে অন্য যাদের সামর্থ্য আছে, তারাও যেন এগিয়ে আসে। আগামী কপে আর যা-ই হোক অন্তত উন্নত দেশগুলো কত অর্থ দিয়েছে তার একটা সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে। এখানে মুসকিল হচ্ছে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু তহবিলের সংজ্ঞা নিয়ে ধোয়াশা তৈরি করে রেখেছে।

হাফিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের এখন উচিৎ জলবায়ু দূষণ বা পরিবর্তনের বিষয়ে একটা আলাদা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। আমাদের নিজস্ব একটা জলবায়ু তহবিল প্রতিষ্ঠা করা উচিৎ। যে তহবিল যে কোন জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্যোগে তড়িৎ কাজ করতে পারবে। একই তহবিল পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলের সাথে যুক্ত হবে।

দ্রুত আমাদেরকে লস অ্যান্ড ড্যামেজ পর্যালোচনা করতে হবে। জলবায়ু দূষণের ফলে বাংলাদেশের মানুষ কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে তার একটা পরিসংখ্যান তৈরি করে ফেলা দরকার। আমাদের যেহেতু প্রায়ই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়, সুতরাং এটা করা আমাদের জন্য খুব বেশি কঠিন কাজ নয়।

তিনি বলেন, প্রযুক্তি হস্তান্তরের বেলাতে আমাদের ক্যাপাসিটি গ্যাপ আছে। গ্রিন ক্লাইমেট  ফান্ডের সবকিছুই প্রজেক্ট বেইজ। এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে কনসালটেন্ট নিয়োগ করতে হয়। আমাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয় চাইলে এক্ষেত্রে বিশেষায়িত দল গঠন করতে পারে। যারা সারা বছরব্যাপী নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে পারে। লক্ষণীয় বিষয় শুরু হলো আমাদের মধ্যস্ততাকারী দলে তরুণ নেগোসিয়েটরদের সংখ্যা খুব কম। এখানে বিজ্ঞানমনস্ক, প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন তরুণের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। দক্ষ আইনজীবী ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদেরকে যুক্ত করতে হবে।

পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পানি, পরিবহন, জ্বালানি ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের দক্ষ মানুষদের যুক্ত করে সমন্বিত দল করতে হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × 2 =