লাল রঙ

শিশির রহমান

লাল রঙের মতো এত রকম অনুভূতি জাগানোর ক্ষমতা মনে হয় তো কোনো রঙেই নেই। বিপদ সংকেতের জন্য কিংবা বিয়ের শাড়িতে লাল রঙ বেশি প্রাধান্য পায়। আমাদের জাতীয় পতাকায় লাল রঙ রয়েছে। লাল রঙ নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।

লাল পোকা থেকে লাল রঙ

লাল রঙকে পোশাকে তুলে ধরতে আদিকাল হতেই তুর্কিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য ও  উপমহাদেশে ম্যাডার বা রুবিয়া গাছের শিকড় শুকিয়ে তা দিয়ে কাপড়ে লাল রঙ করা হতো। তবে তা ছিল দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু একচেটিয়াভাবে লাল রঙের আধিপত্য ধরে রেখেছিল আদিবাসী আমেরিকান ও মেক্সিকানরা। তারা কোচিনিল নামের এক অদ্ভুতুড়ে পোকা থেকে এই রক্তলাল রঙ সংগ্রহ করত। তখন এই অঞ্চলগুলোতে এই রঙ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৫০০ শতাব্দীতে স্প্যানিশরা এই রঙের সন্ধান পায় ও ইউরোপীয় দেশগুলোয় রপ্তানি শুরু করে। পোকাগুলো শুকিয়ে যাওয়ার পর যখন বস্তাবন্দী করা হতো। তখন কারও বোঝার উপায় ছিল না যে এগুলো কোনো গাছের বীজ, নাকি খনিজ পদার্থ, নাকি পোকা।

লাল পোষাক নিষিদ্ধ

তখনকার সময় লাল রঙ দুষ্প্রাপ্য হওয়ার কারণে লাল রঙের কাপড়কে আভিজাত ও উচ্চশ্রেণির মানুষের পরিধেয় কাপড় হিসেবে ধরা হতো। যার কারণে ফ্রান্সে সাধারণ জনগণের লাল পোষাক পরা নিষিদ্ধ ছিল। তবে ১৮৬৫ সালের দিকে বাণিজ্যিকভাবে কৃত্রিম রঙ তৈরি ও ব্যবহার শুরু হলে বস্ত্রশিল্পের দৃশ্যপট পাল্টে যায়।

ভালোবাসার রঙ লাল

লাল রঙকে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। দেশে বিয়েতে নববধূর জন্য প্রচলন হয় লাল শাড়ি পরার। শুধু আমাদের দেশেই না চীন এবং জাপানেও বিয়েতে নববধূ লাল রঙের পোশাক পরে।

ধর্মীয় ও ত্যাগের রঙ লাল

লাল শুধুমাত্র ভালোবাসা প্রকাশ করে তা কিন্তু নয়। দেশপ্রেমের প্রতীক এই লাল রঙ। লাল রঙ আমাদের দেশের লাখো শহীদের আত্মত্যাগের কথা বলে। আবার লাল রঙ বিশেষ ধর্মীয় তাৎপর্য আছে। উপমহাদেশীয় অনেক সাধু ও ধর্মগুরু লাল বর্ণের সেলাইবিহীন কাপড় পরেন। এছাড়াও চীনে নববর্ষে লাল কাপড় পরা হয়। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের ক্যাথলিক চার্চে বিশেষ দিনে পাদরিরা লাল পোশাক পরেন।

লাল কাপড় দেখলে ষাঁড় কী রেগে যায়

বলা হয়, ষাঁড় লাল রঙ দেখলে রেগে যায়। এ নিয়ে কিছু পরীক্ষা করা হয়। প্রথম পরীক্ষায় লাল, নীল ও সাদা রঙের তিনটি পতাকা রাখা হয়েছিল। ষাঁড় পর্যায়ক্রমে সব পতাকাকে আক্রমণ করে। দ্বিতীয় পরীক্ষায় তিনটি পুতুলকে লাল, নীল ও সাদা রঙের জামা পরিয়ে রাখা হয়। ষাঁড় সব কটিকেই আক্রমণ করে। তবে ষাঁড়গুলো লাল জামা পরা পুতুলটিকে সবার শেষে আক্রমণ করে। আর তৃতীয় পরীক্ষায় তিন ম্যাটাডোরকে তিন রঙের জামা পরিয়ে ষাঁড়ের সামনে দাঁড় করানো হয়। লাল জামা পরা ব্যক্তিটি স্থির দাঁড়িয়ে ছিলেন, অন্য দুজন নড়াচড়া করছিলেন। দেখা যায়, অন্য দুই ম্যাটাডোরকে আক্রমণ করতে ষাঁড় তেড়ে গেলেও লাল জামা পরা ব্যক্তির দিকে ঘুরেও তাকায় না! এ পরীক্ষা থেকেই বোঝা যায়, ষাঁড় আসলে লাল রঙের জন্য রেগে যায় না; বরং কাপড়ের নড়াচড়া ওদের রাগিয়ে তোলে, সেটা যে রঙের কাপড়ই হোক না কেন।

রক্তের রঙ লাল

পৃথিবীতে অধিকাংশ প্রাণীর রক্ত লাল, তবে আমরা কী কখনো চিন্তা করেছি কেন প্রাণীর রক্তের রঙ লাল হয়। রক্ত মূলত রক্তরস ও রক্তকণিকা দিয়ে গঠিত। তবে রক্তকণিকা আবার তিন প্রকার। লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা এবং অনুচক্রিকা। এই লোহিত রক্তকণিকার কারণেই রক্ত লাল হয়। দেহের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো এই কণিকা করে থাকে। তবে এই লোহিত রক্তকণিকা লাল হওয়ার মূল কারণ এর মধ্যে থাকা হিমোগ্লোবিন নামের একধরনের প্রোটিন। এর রঙ উজ্জ্বল লাল, যার কারণে রক্তের রঙ লাল।

লাল রঙের শহর

উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কো। প্রাচীন স্থাপত্য এবং ইতিহাসে ঘেরা এই দেশটি। মরক্কোর একটি শহরের নাম মারাকেশ। মারাকেশ এই শহটির নাম হলেও ‘রেড সিটি’ বা লাল শহর হিসেবে এটি বেশি পরিচিত। এই শহরের সব ভবনই লাল রঙের। ১১২০ সালে তখনকার সময় মারাকেশ শহরের সব দেয়াল লাল রঙের করা হয় এবং দেয়ালের ভিতরকার ওল্ড সিটিও লাল রঙের করা হয়। সামঞ্জস্য রাখতে নতুন শহরও একই ধরনের লাল রঙ করা হয়।

লাল মসজিদ

লাল শহর, লাল বাড়ি সম্পর্কে তো আমরা সকলেই শুনেছি তবে লাল মসজিদ সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানিনা। এই মসজিদের দেখা পেতে হলে আমাদের যেতে হবে কেরানীগঞ্জে। দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদটি ‘লাল মসজিদ’ নামে পরিচিত। অসাধারণ মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে মসজিদটি মর্যদাপূর্ণ আব্দুল লতিফ আল ফোজান পুরস্কার অর্জন করে। সারা বিশ্ব থেকে সাতটি মসজিদকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়, তার মধ্যে কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বরের লাল মসজিদ স্থান করে নেয়। মসজিদটি নির্মিত হয় সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের পূর্ব পুরুষদের হাত ধরে। ১৮৬৮ সালে মসজিদটি নির্মিত হয়।

লাল পাহাড়

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এই দেশে আছে অনেক বিচিত্র স্থান, তার মধ্যে একটি হলো লাল মাটির পাহাড়। বিচিত্র এই পাহাড়টির দেখা পেতে হলে যেতে হবে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালীঘাট ইউনিয়নের ফুলছড়া এলাকায়। সমতল থেকে প্রায় ২০০ ফুট উঁচু এই পাহাড়টি সম্পূর্ণ লাল মাটিতে ঘেরা। লাল মাটির কারণে এই পাহাড়টির নাম লাল পাহাড়।

লাল রঙের চাল

লাল চালে প্রচুর অ্যানথোসায়ানিন নামের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে। এই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট লাল রঙের ফলমূল ও শাকসবজিতে পাওয়া যায়। সেজন্য চালের রঙ লাল। লাল চাল হলো প্রাকৃতিক অ্যান্থোসায়ানিন উপাদানের কারণে লাল রঙের চাল। এটি সাধারণত পালিশ না করে বা আংশিকভাবে পালিশ করে খাওয়া হয় এবং এটির একটি লাল তুষের স্তর থাকে। লাল চালে বাদামের স্বাদ আছে।

অ্যান্থোসায়ানিন শরীরে প্রদাহ কমায়। অ্যালার্জি কমায়। ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে। তাই যারা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন, তাদের জন্যও সাদা চালের চেয়ে লাল চাল ভালো। লাল চালে ভিটামিন বি১, বি৩, বি৬ ও ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস প্রভৃতি খনিজ পদার্থ বেশি মাত্রায় থাকে। শরীরের জন্য এগুলো খুব দরকার। সাদা চাল তৈরির প্রক্রিয়ায় চালের এসব উপাদান অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়। আঁশও কমে যায়। এসব বিবেচনায় লাল চাল নিঃসন্দেহে সাদা চালের চেয়ে ভালো। লাল চালে প্রচুর পরিমাণে থাকা ভিটামিন বি৬ শরীরের প্রয়োজনীয় লোহিত কণিকা ও সেরোটোনিন উৎপাদন করে। এতে বেশি পরিমাণে আয়রন থাকায় খেতে খুব সুস্বাদু নয়। কিন্তু রক্তাল্পতায় ভোগা মানুষের জন্য লাল চাল ওষুধের মতো কাজ করে। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে বলে লাল চাল ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও উপকারী। লাল চালে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম থাকে। উপাদান দুটি একসঙ্গে হাড় ও দাঁত ভালো রাখে। হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। ম্যাগনেশিয়াম মাইগ্রেন কমায়, রক্তচাপ কমায় ও হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। লাল চালের অ্যানথোসায়ানিন ত্বকের ভাঁজ কমায়, ত্বকে তারুণ্য ধরে রাখে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় সূর্যের আলোর ক্ষতিকর আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে।

লাল নদী

বিশ্বের সব দেশেই ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের নদী আছে। তবে কখনো কী আমরা নদীর পানির রঙ লাল দেখেছি? অবিশ্বাস্য ঘটনা হলেও সত্যিই, এমন এক নদীর দেখা আপনি পাবেন পেরুতে গেলে। কুসকো শহর থেকে আনুমানিক ১০০ কিলোমিটার দূরে এই নদীর অবস্থান, স্থানীয়দের কাছে স্থানটি ‘পালকুয়েলা পুকামায়ু’ নামে পরিচিত। তবে লাল নদীটির শুধুমাত্র ৫ কিলোমিটার লাল রঙ ধারণ করে এরপর নদীটির পানি স্বাভাবিক রঙের। নদীর পানি লাল হওয়ার কারণ বর্ষাকালে প্রচুর পরিমাণে আয়রন অক্সাইড সমৃদ্ধ মাটি পাহাড় থেকে নিচে প্রবাহিত হয়। যার কারণে পানির রঙ লালচে হয়।

উত্তর কোরিয়ার লাল লিপস্টিক নিষিদ্ধ

উত্তর কোরিয়ায় কিম জং উন প্রায়শই নানারকম উদ্ভট আইনের জন্য বিখ্যাত। তবে নানাবিধ উদ্ভট আইনের মধ্যে ফ্যাশন সম্পর্কিত আইনও রয়েছে। একটি আইন হচ্ছে লাল লিপস্টিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা। কিম জং উন মনে করেন  লাল রঙ প্রায়শই মুক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে, লাল লিপস্টিক পরা নারীদের আকর্ষণীয় দেখায় যা দেশে নৈতিক অবক্ষয় ঘটাতে পারে। যেহেতু উত্তর কোরিয়ার সরকার প্রধানত রক্ষণশীল মতাদর্শে চলে, তাই কিম জং উন এই সিদ্ধান্ত নেন।

কুষ্টিয়ার লালবাড়ি

কুষ্টিয়া শহরের কমলাপুর এলাকায় গড়াই নদের পাশে একটি লাল দালান দেখা যায়। দালানটিতে একসময় থাকতেন স্কটিশ ব্যবসায়ী ডব্লিউ বি রেনউইক। তিনি চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে, তবে এখনো অক্ষত রয়েছে তার নির্মিত একতলা বাড়িটি। গড়াই নদ ঘেঁষে চিনিকলের জন্য যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছিলেন রেনউইক। তাই স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য এই স্থানে বাড়িটি করেন তিনি। পুরো বাড়িটিতে রেনউইক লাল ইটের ব্যবহার করেছেন। ধারনা করা হয় বাড়িটির বয়স প্রায় ১৪০ বছর। তিনি পরলোকগমন করলেও তার নির্মিত কোম্পানিটি এখনও এ-দেশের চিনিকলগুলোর যন্ত্রাংশ তৈরি ও মেরামত করে।

লাল রঙের গোলাপ

সাধারণত সাদা, লাল ও হলুদ রঙের গোলাপ বেশি দেখা গেলেও গোলাপি, নীল, কমলা, কালো, এমনকি রংধনু রঙের গোলাপও আছে। একেক রঙের গোলাপের আবার একেক অর্থও আছে। প্রাচীনকাল থেকেই লাল গোলাপ ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। প্রেমের প্রস্তাব কিংবা প্রিয়জনের মান ভাঙাতে লাল গোলাপের চেয়ে অব্যর্থ উপহার আর হয় না। ঘরদোর সাজসজ্জায়, বিশেষ করে বিয়েবাড়ি, বাসর ঘর কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে মিলনায়তন সাজাতে লাল গোলাপ অনিবার্য উপকরণ। ভালোবাসা দিবসে লাল গোলাপের জনপ্রিয়তা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে এই রঙ প্রেম-ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রতীক। ভালোবাসা দিবসের উপহার হিসেবে লাল গোলাপ সবচেয়ে জনপ্রিয়। তবে নতুন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সঙ্গীকে লাল গোলাপ না দেওয়াই ভালো। কারণ, লাল গোলাপ গভীর রোমান্টিক অনুভূতির বার্তা বহন করে। তাই এটি আপনার স্বামী-স্ত্রী বা দীর্ঘমেয়াদী সঙ্গীর জন্য উপযুক্ত উপহার। প্রেমঘন মুহূর্তকে আরও আবেদনময় করে রাখে লাল গোলাপ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × 5 =