সালেক সুফী: নানা রকম মাছ শিকার চিরদিনের লালিত শখ। শিশুকালে কবে প্রথম মাছ ধরেছিলাম আমার মা শুধু বলতে পারবেন। তবে মনে আছে ১৯৬১ সালে যখন আমাদের ফরিদপুর “ইফাত মনজিলে” বানের জল এসেছিল বড়শি দিয়ে ঘরের কোণায় বসেই পুঁটি, টেংরা, এমনকি ছোট কৈ, শিং মাছ ধরেছিলাম। মনে আছে একটু একটু, বড় ভাই ঘরের পেছনে বড়শিতে টাকি মাছ গেঁথে বোয়াল-গজার মাছ ধরতেন। মাছ ধরাটা আমাদের অনেকটা পারিবারিক ধারাবাহিকতা। বাবা কিন্তু মাছ ধরতেন, আর পাখি শিকার করতেন। আমাদের সব ভাই বোনেরা ছিল শখের মৎস শিকারি।
আমাদের ছেলেবেলায় ফরিদপুর শহরটির যে অংশে আমাদের বাসা সেটি ফি বছর বন্যার সময় ডুবে যেত। আমাদের ঘর ছুঁই ছুঁই পানি হতো। ঘরে বসেই বড়শি দিয়ে মাছ ধরা যেত। সকালে নামাজ, কোরান শরীফ পড়ার পর প্রাতরাশ সেরে দুই ঘণ্টা পড়তাম। মা আটা গুলিয়ে দিতেন। ছোট বড়শি দিয়ে অনেক পুঁটি মাছ ধরতাম। মাঝে মাঝে টেংরা, কৈ মাছ পেতাম। স্কুলে যাবার আগে মা মাছ ভেজে দিতেন, কী যে মজা ছিল।
বাসার পেছনে বেশ কয়েকটি পুকুর ছিল। বন্যার জল যখন মাঠ উঁচিয়ে পুকুরে নামতো তখন পুকুরের মাছগুলো উপরে উঠতে চাইতো। বড় ভাই বোনদের সাথে মিলে নানা ভাবে মাছ ধরতাম। এগুলো ছিল ভীষণ মজার। শিশু বেলার সেই ঘটনাগুলো এখনো মনে আছে। বড় ভাই-বোন এখন পরপারে। মা-বাবাও বেঁচে নেই। বেঁচে আছেন আমার এক বোন। এক ভাই ঢাকায়। আমি আজ মেলবোর্ন পরবাসী।
ইদানিং আমার ফেসবুক বন্ধুরা বাংলাদেশের তরতাজা মাছের ছবি শেয়ার করে। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখি। একমাত্র ঝাঁকি জাল ছাড়া সব ধরনের কৌশল ব্যবহার করেই মাছ ধরেছি। আমাদের অঞ্চলটাই ছিল খাল, বিল আর নিচু অঞ্চল। রাস্তার পাশের খাল থেকে সারা বছর মাছ ধরা যেত। আমাদের সামনে পাবলিসিটি অফিসের পেছনে ছিল বিশাল খাল। সেখানে কৈ, শিং, শোল, গজার থেকে শুরু করে রুই কাতলা মৃগেল সব মাছ ছিল। যখন বয়স ১০-১২ কত যে মাছ ধরেছি হিসাব নেই। স্কুল ছুটির দিন মাছ ধরা, ঘুড়ি ওড়ানো, বাগান করা ছিল হবি। কোনটা সবচেয়ে প্ৰিয় ছিল বলতে পারবো না। আমাদের সুন্দর ফুলের বাগান ছিল। পাটকাঠির মাথায় গোল করে বিছার শোল গেঁথে মাকড়সার জাল দিয়ে প্রজাপতি ধরে মেরে খাতার পাতায় আঠা দিয়ে আটকে রাখতাম।
ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলাম বলে একটু বাড়তি আদর ছিল। পাড়ার সবাই আদর করতো। সবার পুকুরেই মাছ ধরার অনুমতি ছিল। মাঝে মাঝে চিংড়ি মাছ দিয়ে মাছ ধরতাম। বড় বড় দেশি কৈ। স্বাদ ছিল অনেক মজার। মাঝে মাঝে পুকুরের কচুরি পানা পরিষ্কার করা হলে কৈ শিং মাগুর মিলতো। মাঝে মাঝে বাইন মাছ পেয়েছি।
শীতের শুরুতে খাল বিল শুকাতে থাকলে বড়শিতে কেঁচো গেঁথে ফেলে আসতাম বিকেলে। সকলে শিং, মাগুর, কৈ, টাকি মাছ পেতাম অনেক। আবার পানি শুকিয়ে গেলে কাদায় হাতড়ে মাছ ধরতাম। চ্যাপ্টা তারা বাইন মাছ ধরার কথা মনে আছে। একবার জনশূন্য বিলে একাকী মাছ ধরে রাতে ঘুমের ভেতর অনেক ভয় পেয়েছিলাম। অনেকে বলেছিলেন জিনে ধরেছে। এমনকি আমার জিনে ধরার চিকিৎসাও করা হয়েছিল। পুকুরের পানি কমে গেলে পোলো দিয়েও মাছ ধরতাম। মোট কথা ঝাঁকি জাল ছাড়া সব ধরনের মাছ ধরায় পটু ছিলাম। আমার মা’কে অনেক মাছ ধরে দিয়েছি। মা’কে এখন অনেক মিস করছি।
১৯৭১ যুদ্ধের সময় যখন খুলনা থেকে নদীতে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, হুলারহাট, গোপালগঞ্জ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ঘুরেছি। সময় সুযোগ পেলেই মাছ ধরেছি। কিছুদিন যখন ফরিদপুর ছিলাম মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ছেলেবেলার বন্ধু কাজী সালাহউদ্দিনের সঙ্গেও বড়শি দিয়ে মাছ ধরেছি। আজ বন্ধুকেও মনে পড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যখন মায়ের কাছে যেতাম অবশ্যই পিছনের পুকুরে মাছ ধরতাম। ওই সময় বড়শি ফেলেছি কিন্তু মাছ পাইনি এমন দিন নাই। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে গেলে মাছ ধরতাম। আমার বড় ভাইরা ফিরোজ ভাই ছিলেন আরেক শখের মৎস শিকারী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারে পুকুর থেকে প্রচুর মাছ ধরেছি। কুমিল্লা, চাঁদপুরেও ধরেছি মাছ। ফারুক ভাই ছিলেন সঙ্গী। আমার জিপের পেছনে বড়শি আর কুলবক্স থাকতো। সাইট ভিজিটে গেলে অবসরে মাছ ধরতাম। অনেকেই বলেছে আমার নাকি মাছের জিন আছে।
অস্ট্রেলিয়ায় তেমন একটা সুযোগ হয় না। যেহেতু ড্রাইভ করি না তাই মাছ ধরতে যাওয়া হয় না। ভেবেছি করোনা শেষে বাংলাদেশে গেলে সুযোগ পেলে মাছ ধরবো। শুনেছি এখন নাকি খাল বিল ভরাট হয়ে গেছে। দেশি মাছ আর খুব একটা নেই। সব চাষের মাছ। পোলাও কোর্মা মাংস যা কিছু থাক, মাছ পেলে কিছু চাই না। ছোট মাছ, কাঁটা ছাড়া মাছ এবং ইলিশ হলে সাত খুন মাপ। মাছে-ভাতে বাঙালি যাকে বলে।