শরতে মেঘের ভেলায় আবারও এলেন দুর্গা

শবনম শিউলি

বলা হয়, দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এটা ভেবেই এই দেবীকে স্মরণ করেন। আর এই পূজা বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বী মানষা পালন করে দুর্গার আগমনের সময় ধরে। মহালয়া বা সর্বপিতৃ অমাবস্যা পালিত হওয়ার পর সেদিন থেকেই পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে সূচনা হবে দেবীপক্ষের। ভোরবেলা রেডিও থেকে ভেসে আসবে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তব। শিউলি কুড়ানোর সকালে উঠে বাঙালি অপেক্ষা করে মহালয়ার স্তোত্রপাঠ শোনার। আবাঙালি সম্প্রদায় সেদিন থেকে শুরু করবে শারদীয়া নবরাত্রির পূজা।  শাস্ত্র মতে, বলা হয় সপ্তমিতে দেবী দুর্গার আগমন এবং দশমিতে গমন হয়। প্যান্ডেল বাঁধার চেনা ছবি, তারপর ঠাকুর আসা, এদিকে কাশের বনে দোলা লেগে গেছে সাদা কাশফুলের। বিজয়া দশমির দিন দুর্গা পুত্র-কন্যা নিয়ে কৈলাশে ফিরে যাবেন।

দেবীর আগমন ও বাহন

পঞ্জিকা অনুসারে পুজোর সপ্তমিতে দেবীর আগমন হয়, আর গমন হয় দশমিতে। এই দুই দিন সপ্তাহের কোন কোন বারে পড়ছে, তার উপরেই নির্ভর করে স্থির হয় দেবীর আসা যাওয়ার বাহন। শাস্ত্র অনুযায়ী সপ্তমি রবি বা সোমবার হলে দেবীর বাহন হবে গজ বা হাতি। সপ্তমি শনি বা মঙ্গলবার হলে দেবীর বাহন ঘোটক বা ঘোড়া। সপ্তমি বৃহস্পতি বা শুক্রবার হলে দেবীর বাহন দোলা বা পালকি। সপ্তমি বুধবার হলে দেবীর বাহন নৌকা। একই ভাবে, দশমি রবি বা সোমবার হলে দেবীর বাহন গজ। দশমি শনি বা মঙ্গলবার হলে দেবী বিদায় নেবেন ঘোড়ায় চড়ে। দশমি বৃহস্পতি বা শুক্রবার হলে দেবীর গমন হবে দোলা বা পালকিতে। আর দশমি বুধবার হলে নৌকায় করে কৈলাশে ফিরবেন দেবী। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, দেবী দুর্গার মর্তে আগমন ও গমন যে বাহনে, তার ওপর নির্ভর করে গোটা বছরটা পৃথিবীবাসির কেমন কাটবে। এই বছর দেবী দুর্গার আগমন দোলায়, যার ফল মড়ক। আর এবারের গমন ঘোটকে, যার ফল ছত্রভঙ্গ।  ২০২৩ সালে দেবীর আগমন ও গমন দুটোই হয়েছিল ঘটকে।

এই বছর ১০ অক্টোবর সপ্তমি পড়েছে বৃহস্পতিবার তাই দুর্গার আগমন দোলা বা পালকিতে। আগামী ১৩ অক্টোবর রবিবার পড়েছে বিজয়া দশমি। দুর্গা কৈলাশে ফিরে যাবেন গজ বা হাতির পিঠে আসীন হয়ে। শাস্ত্রমতে, দুর্গা যদি পালকিতে করে আসেন, তাহলে ফল ‘দোলায়াং মকরং ভবেৎ’ অর্থাৎ মহামারি, ভূমিকম্প, খরা, যুদ্ধ ও অতিমৃত্যু। যাতে বিপুল প্রাণহানি অনিবার্য। দেবী ফিরবেন গজ বা হাতিতে, শাস্ত্র মতে যা দেবীর উৎকৃষ্টতম বাহন। দেবীর আগমন বা গমন হাতিতে হলে মর্ত্যলোক ভরে ওঠে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধিতে। পরিশ্রমের সুফল পায় মর্তলোকের অধিবাসীগণ। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি নয়, ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটা বর্ষণ। অন্যদিকে দেবীর যাওয়া হবে নৌকায়। এর ফল ‘শস্য বুদ্ধিস্তথাজলম’ অর্থাৎ প্রবল বন্যা ও খরা দেখা যায়। এতে মনোকামনা পূর্ণ হওয়া বোঝায়। পৃথিবী হয়ে ওঠে শস্য শ্যামলা। কিন্তু সেইসঙ্গে অতি বর্ষণ বা প্লাবনের আশঙ্কাও দেখা যায়।

দুর্গার বিভিন্ন নাম

দুর্গা পৌরাণিক দেবী। দুর্গ বা দুর্গম নামক দৈত্যকে বধ করেন বলে তার নাম হয় দুর্গা। এছাড়া জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেও তাকে দুর্গা বলা হয়। তাকে অভিহিত করা হয় আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, সিংহবাহনা ইত্যাদি নামেও। ব্রহ্মার বরে পুরুষের অবধ্য মহিষাসুর নামে এক দানব স্বর্গরাজ্য দখল করলে রাজ্যহারা দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে যে দেবীর জন্ম হয় তিনিই দুর্গা। দেবতাদের শক্তিতে শক্তিময়ী এবং বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে এ দেবী যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করেন। তাই দেবীর আর এক নাম মহিষমর্দিনী। কালীবিলাসতন্ত্র, কালিকাপুরাণ, দেবীভাগবত, মহাভাগবত, বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী, দুর্গোৎসববিবেক, দুর্গোৎসবতত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থে দেবী দুর্গা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে।

দুর্গার ১০ হাতে ৯ অস্ত্র

দশভূজা দেবী দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী। তার দশ হাতে ধরা দশ রকমের অস্ত্র। মহিষাসুরের অত্যাচারে যখন দেবতারা স্বর্গলোক ত্যাগ করতে বাধ্য হন, তখন এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে দেবী দুর্গার স্মরণাপন্ন হন সবাই। সব দেবতারা নিজেদের সেরা অস্ত্র তার হাতে তুলে দিয়ে তাকে সংহাররূপীনি হিসেবে সজ্জিত করেন। নানা অস্ত্রে সজ্জিতা দেবী অশুভকে সংহার করতে মর্ত্যে আসেন।

মহিষাসুরকে বধ করতে নিজের চক্র থেকে একটি চক্র সৃষ্টি করে দুর্গাকে দান করেন বিষ্ণু। দুর্গার হাতে চক্র থাকার অর্থ সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রে অবস্থান করছেন তিনি। এই অস্ত্র দৃঢতা এবং সংহতির প্রতীক। মানুষের তিন গুণ – সত্য, তমঃ, রজঃ-র প্রতীক ত্রিশূলের তিন ফলা।  মহাদেবের কাছে পাওয়া এই ত্রিশূল দিয়েই মহিষাসুরকে বধ করেন দুর্গা। তাকে শঙ্খ দিয়েছিলেন বরুণ দেব। শঙ্খের আওয়াজে স্বর্গ, মর্ত্য ও নরকের সব অশুভ শক্তি ভীত ও দুর্বল হয়ে পড়ে।  দেবীর হাতে বজ্র তুলে দেন দেবরাজ ইন্দ্র। নিজের বজ্রের থেকে আরও একটি বজ্র সৃষ্টি করে তা দান করেন তিনি। এই বজ্র দৃঢ়তা এবং সংহতির প্রতীক। দুর্গাকে গদা দিয়েছিলেন যমরাজ, যা কালদণ্ড নামেও পরিচিত। এটি শক্তি, আনুগত্য, ভালোবাসা এবং ভক্তির প্রতীক। পবন দেব দুর্গাকে দেন তীর ধনুক। এই দুটিই ইতিবাচক শক্তির প্রতীক। অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় এই তীর ধনুক ব্যবহার করেন দেবী ভবানী। তলোয়ার হল মানুষের বুদ্ধির প্রতীক। যার জোরে সমস্ত বৈষম্য এবং অন্ধকারকে ছিন্ন করা যায়। বুদ্ধির ধার দিয়ে সমাজের সমস্ত বৈষম্য ও অশুভকে বিনাশ করার বার্তা দেয় মা দুর্গার হাতের খড়্গ বা তলোয়ার। বিভিন্ন অস্ত্রের সঙ্গে দেবীর হাতে থাকে একটি ঘণ্টা। পুরাণ অনুসারে দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত দুর্গাকে এই ঘণ্টা দিয়েছিল। ঘণ্টা ধ্বনি অসুরদের তেজকে দুর্বল করে। প্রজাপতি ব্রহ্মা দেবীর হাতে পদ্ম তুলে দেন। দেবীর আশীর্বাদে অন্ধকার কেটে আলোর সঞ্চার হয়, সেই শুভশক্তির বার্তা নিয়ে আসে পদ্মফুল। শেষনাগ মা দুর্গাকে দিয়েছিলেন নাগপাশ। এই সাপ হল শুদ্ধ চেতনার প্রতীক।

কেন দুর্গা অশুভও শক্তি বিনাশের প্রতীক

দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।

উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।

রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।

ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।

‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং আ-কার শত্রু নাশ করে। একসঙ্গে করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে, ‘দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা’। অর্থাৎ, যিনি দুর্গ নামে অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দুর্গা নামে পরিচিত। দেবী দুর্গাকে নিয়ে বিষময়ের অন্যতম কারণতিনি দশভুজা বা দশ হাত বিশিষ্টা নারী এবং দেবীর দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র। হিন্দু দেবদেবীর মধ্যে এই ধরনের রূপ সহজে দেখা মিলে না। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, পৃথিবীর দশটি দিকের প্রতিভূ এই দশ হাত। পুরাণে বলা আছে, কুবের, যম, ইন্দ্র, বরুণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, ব্রহ্মা ও বিষ্ণু এই দশ দিক থেকে মহিষাসুরকে বধ করার উদ্দেশ্যে দেবী দুর্গার দশটি হাত সৃষ্টি। দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে হিরণ্যাক্ষ পুত্র রুরুর বংশধর দুর্গম সমুদ্র মন্থনকালীন অসুরদের বঞ্চনা তথা তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ কামনায় ব্রহ্মার তপস্যা করে। সেই কঠোর সাধনায় সন্তুষ্ট ব্রহ্মার কাছে দুর্গম এই বর প্রার্থনা করে যে তাকে এমন এক নারী বধ করবেন যিনি অনাবদ্ধকে আবদ্ধ করতে পটিয়সী। বরলাভের অহংকারে মত্ত দুর্গম এর পর শুরু করে চরম বিশৃঙ্খলা, মাৎস্যন্যায়। তার অত্যাচার আর ধ্বংসলীলায় ত্রিভুবন বিধ্বস্ত। ক্ষমতা আর বিজয়গর্বে মত্ত অসুর এবার চতুর্বেদকে হস্তগত করলে সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষায় দেবী মহামায়া এক দশভুজারূপী মঙ্গলময়ী দেবী রূপে আবির্ভূতা হন আর দুর্গমাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেন। দুর্গা মূলত শক্তি দেবী। ঋগ্বেদে দুর্গার বর্ণনা নেই, তবে ঋগ্বেদোক্ত দেবীসূক্তকে দেবী দুর্গার সূক্ত হিসেবেই মান্যতা দেওয়া হয়। দেবী দুর্গা নির্গুণ অবস্থায় এই জগৎসংসারে বিরাজ করেন। তার জন্ম হয় না, আবির্ভাব ঘটে। দেবী দুর্গা শাক্তমতে সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব মতে তাকে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয় এবং শৈবমতে দুর্গাকে শিবের অর্ধাঙ্গিনী পার্বতী । বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 + 12 =