শাড়ি পরিয়ে লাখ টাকা আয় ডলির

নাহিন আশরাফ

যেকোনো উৎসব পার্বণে নারীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। তবে নারীরা শাড়ি পরতে যেমন ভালোবাসে আবার অনেকের কাছে শাড়ি পরা মানে বিশাল ঝামেলার কাজ। আবার অনেকে অল্প সময়ে বেশ গুছিয়ে শাড়ি পরে ফেলেন। কেমন হয় যদি শাড়ি পরানো হয় কারো পেশা? আবার শাড়ি পরিয়ে যদি কেউ আয় করে লাখ লাখ টাকা? শুনতে কিছুটা অবাক লাগলেও এ পেশায় নিয়োজিত আছেন ভারতের ডলি জৈন। অনেকে তাকে ‘শাড়ি ড্রেপার’ হিসেবেও চিনে থাকেন। শুধু শাড়ি পরিয়েই তিনি হয়ে গেছেন তারকা ও বলিউডের সদস্য।

বাবার চাকরির সূত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান ডলি জৈন। তাই কোনো বিশেষ পোশাকের প্রতি তার ছোটবেলা থেকে আগ্রহ ছিল না। যখন যে পোশাক ইচ্ছা তিনি পরিধান করতেন। কিন্তু মাত্র ২০ বছর বয়সে বিয়ে হয় এমন এক পরিবারের যেখানে শাড়ি পরা ছিল বাধ্যতামূলক। শাড়ি পরতে তিনি একদম পছন্দ করতেন না। কারণ শুরুর দিকে শাড়ি পরা তার জন্য বেশ ঝামেলার কাজ ছিল। প্রতিদিন সকালে শাড়ি পরতে তার সময় লাগতো ৪০ মিনিট। কিন্তু শাশুড়ির আদেশ ছিল শাড়ি পরার, তাই না মেনে উপায় ছিল না। ধীরে ধীরে তিনি শাড়ি পরা আয়ত্ত করে ফেলেন। কিন্তু তিনি ভাবতেন রোজকার মতো শাড়ি না পরে কিভাবে ভিন্নভাবে শাড়ি পরে নিজেকে আরো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায়। ধীরে ধীরে তিনি বিভিন্ন উপায়ে শাড়ি পরা আয়ত্ত করে ফেলেন। তার কাছে মনে হয় গুছিয়ে শাড়ি পরাও আর্ট। কারণ শাড়ির প্রতিটি কুচি ও সুন্দর করে আঁচল গুছিয়ে রাখা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।

শাড়ি পরানোর পেশাতে আসার জন্য ডলিকে অনুপ্রেরণা দেন বলিউড তারকা শ্রীদেবী। ছোটবেলা থেকেই তিনি শ্রীদেবীর ভক্ত ছিলেন। তার মামা যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন সে একই এপার্টমেন্টে শ্রীদেবীও থাকতেন। এক অনুষ্ঠানে তার শ্রীদেবীর সাথে দেখা হয়। সেই অনুষ্ঠানে শ্রীদেবীর শাড়ি এলোমেলো হয়ে গেলে তিনি শাড়ি গুছিয়ে পরিয়ে দেন। তার শাড়ি পরানো দেখে শ্রীদেবী বলেন, ‘আমি এ জীবনে অনেকের কাছে শাড়ি পরেছি কিন্তু তোমার শাড়ি পরানোর ধরন ভিন্ন। তোমার হাতে জাদু আছে। তুমি এটিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারো।’ এত বড় তারকার মুখে এ কথা শুনে ডলি জৈন বেশ উৎসাহিত বোধ করেন এবং এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন।

কিন্তু এ ভিন্নধর্মী কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া এত সহজ ছিল না। তিনি যখন শাড়ি পরার আরো বিভিন্ন কৌশল শিখতে থাকেন এবং এটিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা চিন্তা করেন তখন তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব অনেকেই তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করেছিল। তারা মনে করতেন এটি অযথা সময় নষ্ট, কখনোই এমন পেশা হতে পারে না। কিন্তু ডলি এসব কথা কানে না নিয়ে তার কাজ চালিয়ে যান। তার প্রথম গ্রাহক ছিলেন প্রভা আগরওয়াল। রায়পুরের এক নামকরা শিল্পপতি পরিবারের সদস্য। শাড়ি পরানোর একটি কর্মশালায় তিনি তার কাজ দেখেছিলেন। তখন ডলি জৈন সারাদিনের জন্য ১০ হাজার রুপি নিয়েছিলেন। সেদিন তিনি প্রায় ৬০ জনকে শাড়ি পরিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে তার চাহিদা বাড়তে শুরু করে। তখন তিনি প্রতি শাড়ি পরাতে ৫০০ থেকে ৬০০ রুপি নিতে শুরু করেন।

বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার সন্দীপ খোসলা এক বিয়েবাড়িতে তার কাজ দেখেন ও বলিউড তারকাদের কাছে তার কথা বলতে থাকেন। ডলি সন্দীপকে বলেন তার ‘গডফাদার’। নিতা আম্বানির ৫০তম জন্মদিনের উৎসবে ডলি ডাক পান। এটি তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেখানে সবাইকে তিনি শাড়ি পরান। এটি তার জন্য বিশাল একটি অভিজ্ঞতা ছিল। এরপর সালমান খানের বোনের বিয়ের মধ্য দিয়ে তিনি বলিউডে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে যান। অর্পিতা খানকে বিয়ের শাড়ি পরাতে ডলিকে ভাড়া করা হয়েছিল। সে বিয়েতে বলিউড পাড়ার প্রায় সবাই এসেছেন এবং তার কাজ বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। পরবর্তীতে নিজেদের বিশেষ দিনে ডলি জৈনকে যারাই বেছে নিয়েছেন তিনি করে প্রমাণ দিয়েছেন তাকে বেছে নেওয়া তাদের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না। এছাড়া দীপিকা পাড়ুকোন, সোনম কাপুর, আলিয়া ভাট, কিয়ারা আদভানি, ক্যাটরিনা কাইফ এমন বলিউডের অনেক তারকাদের বিয়ে ও বিশেষ দিনে শাড়ি পরিয়েছেন তিনি।

শাড়ির পাশাপাশি তিনি লেহেঙ্গার ওড়নাও ড্রেপ করেন। তারকাদের শাড়ি পরানোর জন্য তিনি দুই লাখ রুপি করে নেন। কত টাকা নিবেন তা নির্ভর করছে কেমন ধরনের শাড়ি পরিধান করবে ও কিভাবে শাড়ি পরবে। শুধুমাত্র শাড়ি পরিয়ে এত টাকা নেওয়ার জন্য তিনি বেশ কয়েকবার সমালোচিত হয়েছেন। এর জবাবে তিনি বলেছেন, আজকে তিনি এ জায়গায় এমনি এমনি আসেননি। সতেরো বছর তিনি শুধু শাড়ি নিয়ে সাধনা করেছেন। তাই তাকে সমালোচনা করার আগে তার জায়গায় এসে দেখাতে হবে। ডলি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বিয়ের চাইতে তিনি ফটোশুটের শাড়ি পরাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ ফটোশুটে তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে বিভিন্ন ধরনের শাড়ি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার। বিয়ের ক্ষেত্রে কনের মতামত সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অনেক সময় কনেরা তার কাছে পরামর্শ চান, কিভাবে শাড়ি পরলে সুন্দর লাগবে। সেক্ষেত্রে তিনি নিজের মতামত দিয়ে থাকেন। যখন কেউ তাকে তার নিজের বিশেষ দিনের জন্য ভাড়া করে থাকে তিনি মনে করে তখন তার দায়িত্ব দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তিনি চেষ্টা করেন সবাইকে বিশেষ দিনে যাতে সুন্দর লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে।

২০১১ সালে ১৮ দশমিক ৫ সেকেন্ডে শাড়ি পরিয়ে তিনি বিশ্ব রেকর্ড করেন। শাড়ি পরানোর ৩২৫টি নিয়ম জানেন তিনি। ডলির সব সময় লক্ষ্য থাকে শাড়ি পরার মধ্যে ভিন্নতা নিয়ে আসতে, যাতে একঘেয়ে ভাব না থাকে। সব সময় তিনি শাড়ি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যান। সোশ্যাল মিডিয়াতে তার ১৫ লাখের বেশি ফলোয়ার রয়েছে। ফলোয়ারদের উদ্দেশ্যে তিনি শাড়ি নিয়ে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল টিপস দিয়ে থাকেন। শাড়ি পরার সহজ পদ্ধতি তিনি তার ফলোয়ারদের মাঝে শেয়ার করেন, যাতে সহজেই সবাই শাড়ি পরে ফেলতে পারে। অনেকে মনে করেন, তার শাড়ি পরানোর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে যা অনেকের মধ্যে নেই। তাই বলিউড তারকা ও আম্বানি পরিবারের মেয়েরা নিজেদের বিশেষ দিনে চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন ডলির উপর।

ডলি চান বিশ্ব দরবারে শাড়িকে সুন্দর করে তুলে ধরতে। শাড়ি যে কোনো বিরক্তকর পোশাক নয় বরং চাইলে বিভিন্ন উপায়ে অনেক স্টাইলিশভাবে পরিধান করা যায় তা সবার মাঝে তুলে ধরতে চান। সে চেষ্টাতেই তিনি কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, শাড়ি পরিধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিকভাবে পিন করা। অনেকেই জানেন না শাড়ির কোথায় ও কিভাবে পিন করা উচিত। সঠিকভাবে পিন করতে জানলে শাড়ি পরিধান সহজ হয়ে যায়। এ পেশায় নিয়োজিত হওয়ার আগে ডলির সময় কাটতো তার দুই সন্তানকে নিয়ে। রক্ষণশীল পরিবারের বউ হবার কারণে কখনো এ ধরনের পেশায় যুক্ত হতে পারবেন তা তিনি কল্পনাও করেননি। তবে তিনি যখন এটিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখন তার পুরো পরিবার তার পাশে থেকেছে বলে তিনি কৃতজ্ঞ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × one =