শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নার্গিস মোহাম্মদী

ইরানে নিপীড়িত নারীদের জন্য নার্গিস মোহাম্মদীর সংগ্রাম এবং সবার মানবাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য তার যে লড়াই, এরই স্বীকৃতিতে শুক্রবার নরওয়ের নোবেল ইন্সটিটিউট শান্তি পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করেছে। খবর বিডিনিউজ২৪.কম

 

মা-কে শেষবার বাড়িতে দেখার কথা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে ১৬ বছরের আলির। সে আর তার যমজ বোন কিয়ানার জন্য সকালের নাস্তা তৈরি করে দিয়েছিলেন মা। বলেছিলেন ভাল করে পড়াশুনা করতে। স্কুলে পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন বিদায়। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর আর দেখা মেলেনি মায়ের।

 

তখন দুই ভাই-বোনের বয়স ছিল ৮ বছর। আর তাদেরই মা নার্গিস মোহাম্মদী। এমন একজন নারী, ইরানে মানবাধিকারের জন্য লড়াই-ই হয়ে উঠেছিল যার অপর নাম- এ ছিল এমন এক লড়াই যার কারণে নার্গিসকে ব্যক্তিগতভাবে প্রায় সবকিছুরই মূল্য দিতে হয়েছে।

 

জাতিসংঘ নার্গিসের এই পুরস্কার জয়কে ইরানি নারীদের সাহস, দৃঢ়সংকল্প এবং বিশ্বের জন্য তাদের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে বর্ণনা করেছে।

 

কারাবন্দি মানবাধিকারকর্মী:

নোবেল কমিটির প্রধান বেরিত-রেইস অ্যান্ডারসন শান্তি পুরস্কারের জন্য যখন নার্গিসের নাম ঘোষণা করছিলেন, তখনও ইরানে কারাবন্দি এই নারী।

 

গত দুই দশকের বেশিরভাগ সময়ই মোহাম্মদী কাটিয়েছেন বন্দিজীবন। ইরান সরকার তাকে গ্রেপ্তার করেছে ১৩ বার, পাঁচবার তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। সব মিলিয়ে ৩১ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে এই সাহসী নারীকে। শরিয়া আইনে ১৫৪টি বেত্রাঘাতের মত শাস্তিও পেতে হয়েছে তাকে। বন্দি অবস্থা থেকে মেলেনি মুক্তি।

 

৫১ বছর বয়সী সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী নার্গিস মোহাম্মদী তেহরানের কুখ্যাত ইভিন কারাগারে বন্দি আছেন। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার চালানোসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা ও মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে কাজ করায় তাকে বারবার কারাগারে যেতে হয়েছে।

 

২০০৩ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী শিরিন এবাদির প্রতিষ্ঠা করা ‘ডিফেন্ডারস অফ হিউম্যান রাইটস সেন্টারের’ ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আছেন নার্গিস মোহাম্মদী। এবছর বিবিসি’র বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকাতেও আছে তার নাম।

 

সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা বিরোধী কর্মকাণ্ড এবং রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার চালানোর অভিযোগে ১০ বছর ৯ মাসের সাজা খাটছেন নার্গিস। তার ওপর ভ্রমণসহ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞাও আছে। কিন্তু এত সব বাধা-বিপত্তি এমনকী কুখ্যাত ইভিন কারাগারের অন্ধকারময় কারাকক্ষও নার্গিসের সোচ্চার কণ্ঠকে দমাতে পারেনি।

 

কারাগারের ভেতর থেকেই সিএনএন-কে দেওয়া এক অডিও রেকর্ডিংয়ে ইরানে গত বছর ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভে নারী, জীবন, স্বাধীনতা স্লোগানে সোচ্চার হতে শোনা গেছে নার্গিসকে। ইভিন কারাগার থেকে একটি ফোনকলে বাধাগ্রস্ত হয় তার সেই অডিও রেকর্ডিং।

 

হিজাব ঠিকঠাকমত না পরার অভিযোগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মাশা আমিনি নামের ২২ বছর বয়সী এক তরুণী নীতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া এবং পুলিশ হেফাজতেই তার মারা যাওয়ার ঘটনা নিয়ে গোটা ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। আরও স্বাধীনতার দাবি থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়ে তা ক্রমশই পরিণত হয় সরকারবিরোধী বিক্ষোভে।

 

সেই বিক্ষোভের একবছরেরও বেশি সময়ের পর ইরানে নারীদের জন্য লড়াইয়ের স্বীকৃতিতে এবছর শান্তিতে নোবেল পেলেন নার্গিস। তবে এই সময়ের মধ্যে ইরান কর্তৃপক্ষের নির্মম দমন-পীড়নে আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলন-সংগ্রাম অনেকটাই স্তিমিত হয়ে  এসেছে।

 

গত জুলাই থেকে আবার নারীরা ঠিকমত হিজাব পরছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে শুরু করেছে নীতি পুলিশ। ইরানের অধিকারকর্মীরা এখনও হিজাব ঠিকমত না পরার কারণে কিশোরীদের ওপর নিপীড়ন এবং আহত অবস্থায় তাদের হাসপাতালে পাঠানোর অভিযোগও করছেন।

 

ওদিকে, ইরান কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে যাওয়ার কারণ হিসাবে রক্তচাপ কম থাকার কথা বলছে। সরকারের আচরণ আবারও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে বলে সিএনএন কে জানিয়েছেন নার্গিস।

 

কারাগারেও থেমে থাকেনি নার্গিসের কন্ঠ:

প্রকাশ্যে কথা বলার কী মূল্য দিতে হতে পারে তা ভালই জানেন নার্গিস। তারপরও মুখ বন্ধ রাখতে নারাজ তিনি। জেলে থেকেও সেখানকার নিমর্ম নির্যাতন, নারীদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন নিয়ে কথা বলেছেন। গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। এজন্য গত অগাস্টে তাকে বাড়তি জেলে থাকার সাজাও পেতে হয়েছে।

 

গতবছর ইরানের কারাগারের নির্মম সব নির্যাতন পদ্ধতি নিয়ে ‘হোয়াইট টর্চার: ইন্টারভিউজ উইথ ইরানিয়ান উইমেন প্রিজোনারস’ শীর্ষক বই প্রকাশ এবং নির্জন কারাকক্ষে থাকা বন্দিদের কাহিনী নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্রের কারণে তিনি এরই মধ্যে সাজা খাটছেন।

 

নির্জন কারাকক্ষে থাকার শাস্তি খোদ নার্গিসকেও সহ্য করতে হয়েছে। তবে এতকিছুর পরও মুষড়ে পড়েননি তিনি। সম্প্রতি নার্গিস সিএনএন- কে পাঠিয়েছেন একটি দীর্ঘ চিঠি। তাতে ইরানে চার দশকের বাধ্যতামূলক হিজাব পরিধান নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তিনি।

 

এই হিজাব নীতিকে নারী বন্দিদের ওপর যৌন সহিংসতা চালানো একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রের ভন্ডামি বলে অভিহিত করেছেন নার্গিস। তার মতে, ইরানের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের প্রভাবশালী ভাবমূর্তি এবং সমাজকে নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসাবে নারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ জাহির করতেই বাধ্যতামূলক হিজাব পরিধানের নীতি নিয়েছে।

 

নারী বন্দিদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার:

সিএনএন-কে লেখা চিঠিতে নার্গেস সেই ১৯৯৯ সাল থেকে তার এবং বিভন্ন কারাগারে অন্যান্য নারী বন্দিদের ওপর যৌন সহিংসতার একাধিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। বলেছেন, অপরাধের অভিযোগে আটক রাজনৈতিক বন্দি এবং নারীরা নিরাপত্তা বাহিনী,কারা কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসাকর্মীদেরও নিপীড়নের শিকার হয়েছে।

 

নার্গিসের কথায়, ইরানে গত বছরের বাঁধভাঙা বিক্ষোভের পর থেকে কারাগারে নারীদের ওপর যৌন সহিংসতা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এই ধরনের নির্যাতন এখন ‘নৈমিত্যিক’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

বছরের পর বছর ধরেই রক্ষণশীল ইরানে ট্যাবু ভেঙে বন্দিদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা নিয়ে সোচ্চার থেকেছেন নার্গিস। ২০২১ সালে ক্লাবহাউজ স্যোশাল মিডিয়া অ্যাপ এর মাধ্যমে তিনি একটি আলোচনা আয়োজন করেন। সেই আলোচনায় নার্গিসসহ অন্যান্য নারীরা ১৯৮০’র দশক থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তাদের ওপর সরকারি এজেন্টদের নিপীড়নের কাহিনী শুনিয়েছেন।

 

এই আলোচনা আয়োজনের জন্যও শাস্তি পেতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন নার্গিস এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো।

 

সয়েছেন সব কষ্ট:

 

কারাবন্দি হয়েও চুপ না থাকায় নার্গিসের ওপর নেমে এসেছে খড়গ। গত ১৮ মাস ধরে তাকে তার স্বামী এমনকী সন্তানদের সঙ্গেও সরাসরি কথা বলতে দেওয়া হয়নি।

 

নার্গিসের স্বামী তাঘি রাহমানি বর্তমানে নির্বাসনে সন্তানদের নিয়ে থাকছেন ফ্রান্সে। নার্গিস ২০১৫ সালে কারাবন্দি হওয়ার পরই তিনি ফ্রান্সে চলে যান। সেখান থেকে সম্প্রতি সিএনএন কে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। নার্গিস কে নিয়ে প্রতিদিনই উদ্বেগে থাকার কথা জানিয়েছেন তাঘি।

 

গতবছর নার্গিসের হার্ট অ্যাটাক হয় এবং অস্ত্রোপচারও করতে হয়েছিল। সেই থেকেই তার স্বামী এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো নার্গেসের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন।

 

তাঘি রাহমানি নিজেও রাজবন্দি হিসাবে ১৪ বছর কারাগারে ছিলেন। আর নার্গিস কারাগারে যাওয়ার পর গত ৮ বছর ধরে তিনিই তার সন্তানদের মা এবং বাবা উভয়ের ভূমিকাই পালন করছেন।

 

তাঘি বলেন, “কিয়ানা (মেয়ে) সবসময়ই বলে, মা যখন থাকেন,তখন বাবা থাকেন না। এটি ভাল নয়,” কিন্তু তিনি বলেন,  “কেউ যখন কোনও একটি পথ বেছে নেয়,তখন তাদেরকে সব কষ্টই সয়ে নিতে হয়।”

 

আলিও (ছেলে) তার বাবার মতোই দৃঢ়। সিএনএন কে আলি বলেন, “মায়ের লড়ে যাওয়া উচিত ইরানের জন্য,ভবিষ্যতের জন্য। আমি মা কে নিয়ে গর্বিত।” তবে কিয়ানা চায় মা সবসময় তার পাশে থাকুক।

 

নার্গিসকে ছাড়া তার পরিবার যেমন কষ্টে আছে তেমনি নার্গিস মোহাম্মদীও পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণা প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তেই ভোগ করে চলেছেন। তিনি যে পথ বেছে নিয়েছেন, তারই মূল্য চোকাতে হচ্ছে তাকে।

 

এ প্রসঙ্গে নার্গিস বলেন, “আমি আমার সন্তানদের না দেখা এমনকী তাদের কণ্ঠও না শোনার পথ বেছে নিয়েছি। এর বদলে আমি হয়েছি আমার ভূখণ্ডের নিপীড়িত মানুষ, নারী এবং সন্তানদের কণ্ঠ।”

 

পুরস্কার নিতে যেতে পারবেন নার্গিস?

আজ নার্গিস যে শান্তিতে নোবেল পেলেন তা ইরান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে খুবই জোরাল এক বার্তাই দিচ্ছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হল, এই পুরস্কার হাতে নিতে যেতে পারবেন কিনা নার্গিস।

 

এমন সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, তেহরানের ইভিন কারাগারে ১০ বছরের জেল খাটছেন নার্গিস।

 

যদিও নরওয়ের নোবেল কমিটির আশা, ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় নোবেল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে যেতে দেওয়ার জন্য ইরান নার্গিস মোহাম্মদীকে মুক্তি দেবে।

 

নোবেল কমিটি প্রধান অ্যান্ডারসন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “ইরান কর্তৃপক্ষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে তাকে মুক্তি দেবে, যাতে তিনি পুরস্কার নিতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেন। আমরা আপাতত এটুকুই আশা করতে পারি।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

6 − five =