শিল্পনির্দেশক শিহাব নূরুন নবী

শিহাব নূরুন নবী বর্তমানে দেশের প্রথম সারির শিল্পনির্দেশকদের মধ্যে একজন। নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বর্তমান সময়ে ওটিটি প্লাটফর্মে নিজের প্রতিভার জানান দিচ্ছেন তিনি। দীর্ঘ এক যুগের ক্যারিয়ারে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২১’ আসরে শ্রেষ্ঠ শিল্পনির্দেশক হিসেবে পেয়েছেন স্বীকৃতি। ‘কোক স্টুডিও বাংলা’ দ্বিতীয় সিজনে যুক্ত আছেন শিল্পনির্দেশক হিসেবে। পর্দার অন্তরালের এই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানাচ্ছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত।

চলচ্চিত্রের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম শিল্পনির্দেশনা। একটা নাটক, সিনেমায় কিংবা বিজ্ঞাপনে একজন শিল্পনির্দেশক মেজর রোল প্লে করেন তা অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। সম্পূর্ণ সেটে কি ধরনের আর্টের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা যায় তা নিয়ে কাজ করেন একজন শিল্পনির্দেশক।

নিজের গল্প

যেকোনো শিল্পের চর্চা শুরু হয় পরিবার থেকেই সেখানে শিহাব নূরুন নবীর শুরুটা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেই। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন রকম শিল্পচর্চার সাথে জড়িত ছিল। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ভীষণ ঝোঁক ছিল। ১৯৯৫ সালের শিশু একাডেমির চিত্রাংকন বিভাগের ছাত্র ছিলেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ডেভলপমেন্ট অল্টারনেটিভ থেকে চারুকলা বিভাগে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। পড়াশোনা শেষ করার পর শিল্পের সাথে সম্পৃক্ততা বেড়ে চলে প্রতিনিয়ত। ২০০৯ সালে প্রথম কাজ করেন তিনি। সামির আহমেদের নির্মিত ‘বাংলালিংক রেমিট্যান্স আমার’ শিরোনামের একটি বিজ্ঞাপনে প্রথম কাজ করেন তিনি।

পাঁচ শতাধিক বিজ্ঞাপন

নিজের ক্যারিয়ারে পাঁচ শতাধিক বিজ্ঞাপনে শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। দেশের প্রথম সারির প্রায় সকল কোম্পানির সঙ্গে কাজ করা হয়েছে এই ভদ্রলোকের। গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, জুঁই, গ্লো অ্যান্ড লাভলি, লাক্স, আকিজ সিমেন্ট, মেরিল, আনপেনলিভে, বাটা উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ এক যুগের ক্যারিয়ারে প্রায় সকল নির্মাতার সঙ্গে কমবেশি কাজ করার সুযোগ হয়েছে তার।

কাদের সঙ্গে কাজ করে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন তা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক নির্মাতার সাথেই কাজের সুযোগ হয়েছে, কারও কারও সঙ্গে একাধিক কাজ করেছি। সবার সাথেই স্বচ্ছন্দে কাজ করার চেষ্টা করেছি। কারণ কাজটা আমি আনন্দ নিয়ে করি। ফলে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে নিতে হয় প্রতিটি কাজেই। কাজের ক্ষেত্রে সবার সাথে সবসময় একমত হতে না পারাটাই হয়ত স্বাভাবিক, তবে তা কখনো কাজটির ছন্দপতন ঘটাতে পারেনি। রানআউট ফিল্মস, ছবিয়াল ও অ্যাপেল বক্স ফিল্মসের সাথে তুলনামূলক একটু বেশি কাজ করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমান সময়ে প্রতি মাসেই বিজ্ঞাপনের কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

বড় পর্দায়

বিজ্ঞাপন, নাটক, ওটিটি প্লাটফর্মে কাজ করার পাশাপাশি কাজ করেছেন বড় পর্দায়। খুলনা অঞ্চলের মানুষের জীবনের গল্প নিয়ে ‘নোনা পানি’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সৈয়দা নিগার বানু। এই সিনেমার মাধ্যমেই চলচ্চিত্রে শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন শিহাব নূরুন নবী। মঈন হাসান ধ্রুব নির্মাণ করছেন ‘দাহকাল’ নামের সিনেমা। এই সিনেমার শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা দুটি সিনেমা অমিতাভ রেজা চৌধুরী পরিচালিত ‘রিকশা গার্ল’ ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমারও শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

শ্রেষ্ঠ শিল্পনির্দেশক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এনে দিয়েছে রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত পরিচালিত ‘নোনা জলের কাব্য’ সিনেমায় কাজ করার মাধ্যমে। এছাড়াও বেশ কিছু কাহিনিচিত্র এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য ধারাবাহিকে কাজ করেছেন তিনি। বড় পর্দায় কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিজ্ঞতার ব্যাপারে যদি বলেন তাহলে আসলে মিশ্র কিছু অভিজ্ঞতা আছে। কারণ একেকটা কাজ তার গল্পের প্রয়োজনে একেক রকম, একেক জন পরিচালক কিংবা কলাকুশলীর কাজের ধারা একেক রকম। তবে বিজ্ঞাপনচিত্র, চলচ্চিত্র কিংবা হালের ওটিটি প্লাটফর্ম ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন ক্যানভাসে কাজ করতে গিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে পারছি যে মাধ্যম ও গল্পের পরিসর-প্রেক্ষাপট ভেদে কীভাবে শিল্পনির্দেশনার ব্যাপ্তি ও আয়োজন বদলে যায়, পরিমিতি ভিন্ন হয়। অনেকটা কোন ক্যানভাসে কতটুকু রঙ দিতে হবে কিংবা জলরঙ নাকি তেলরঙ প্রযোজ্য সেটা আবিষ্কার করতে পারার একটা আনন্দ আছে। এই অভিজ্ঞতাগুলো ভীষণ উপভোগ করছি।

আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে অজস্র নির্মাতা রয়েছে। একজন নির্মাতার কি কি থাকা প্রয়োজন আপনার সাথে কাজ করার জন্য? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, একজন নির্মাতা একটি গল্পের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। তিনি কী দেখতে চান আর কীভাবে দেখাতে চান, এটা বুঝতে পারা আমার জন্য জরুরি। বাদ বাকিটুকু সমন্বয় করে নেওয়া যায়। ফলে কমিউনিকেশন এবং চাওয়া অনুযায়ী প্রাপ্তির মধ্যে সমন্বয় থাকলেই নির্মাতা বা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে আমি আমার সেরাটা দিতে বদ্ধপরিকর। এখন অব্দি ৬টি সিনেমায় শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে বেশ কিছু কাজের পরিকল্পনা চলমান রয়েছে।

কোক স্টুডিও বাংলা

বিশ্বখ্যাত মিউজিক্যাল ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘কোক স্টুডিও’ ২০২২ সালে বাংলাদেশে পর্দা উন্মোচন করে। ইতিমধ্যে সিজন ১ শেষ হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় সিজনের বেশকিছু গানও রিলিজ হয়ে গিয়েছে। ‘কোক স্টুডিও বাংলা’ দ্বিতীয় সিজনের চারটি গানে শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, এবারের সিজনে প্রতিটি গানের আলাদা ভিজ্যুয়াল থিম ছিল। সেহেতু প্রতিটি কাজ করা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জিং। চারটি গান চারটি ভিন্ন থিম নির্ভর ছিল। যেহেতু আমাদের মূল জায়গাটা ছিল গানকে কমপ্লিমেন্ট করা। তাই গানের মূল আবেদনকে ছাপিয়ে না গিয়ে যেন ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনাটা গানের বক্তব্যের সম্পূরক অংশ হয়ে ওঠে সেটা নিশ্চিত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমি মনে করি ডিওপি কামরুল হাসান খসরু ভাইয়ের চিত্র ও আলোকনির্দেশনাও আমাকে সেই পরিমিতিবোধে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা ছিল। মেঘদলের ‘বনবিবি’ শিরোনামের গানটির শিল্পনির্দেশক হিসেবে যুক্ত ছিলেন শিহাব নূরুন নবী। কোক স্টুডিও বাংলার দ্বিতীয় সিজনে শোনা যায় হাজং ভাষার গান ‘নাহুবো’। গানটির শিল্পনির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। ‘দাঁড়ালে দুয়ারে’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী মুকুল মজুমদার ইশান ও সানজিদা মাহমুদ নন্দিতা। ফিউশনধর্মী গানটির শিল্পনির্দেশক হিসেবেও শ্রোতাদের মাঝে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে তিনি।

ওটিটি প্লাটফর্ম

দেশের নির্মাতারা সবাই ওটিটিমুখী হচ্ছে। ভিন্নধর্মী কনটেন্ট তৈরি করছে সকলে। এবারের ঈদে আশফাক নিপুণের নির্মিত ‘মহানগর ২’ ওয়েব সিরিজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শিহাব নূরুন নবী। ওয়েব সিরিজের শিল্পনিদের্শনা দিয়েছেন তিনি। ওয়েব সিরিজে আর্টের কাজ ছিল চোখে লাগার মতোই। শিহাব নূরুন নবীর এটাই ছিল প্রথম ওয়েব সিরিজ যেখানে তিনি শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন। তিন সময়কার তিন বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মিলে তৈরি করেন ‘এই মুহূর্তে’ অ্যান্থলজি ফিল্ম। সেই ফিল্মে পিপলু আর খান নির্মাণ করেছিলেন ‘কল্পনা’ নামের ফিকশন। সেটিতে শিল্পনির্দেশক হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। এছাড়া বিজ্ঞাপন নির্মাতা আদনান আল রাজীবের নির্মিত ‘ইউটিউমার’ ওয়েব ফিল্মে শিল্পনির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। ওটিটিতে বেশ কিছু নতুন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তিনি। যেসকল কাজগুলো খুব শীঘ্রই দেশি-বিদেশি ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তি পাবে।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২১’-এ সাতটি বিভাগে পুরষ্কার অর্জন করেছে রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত পরিচালিত ‘নোনা জলের কাব্য’ সিনেমাটি। শ্রেষ্ঠ শিল্পনির্দেশক হিসেবে পুরস্কার অর্জন করেছেন শিহাব নূরুন নবী। কাজের স্বীকৃতি পেয়ে উচ্ছসিত। তার কাছে জানতে চাইলাম, আপনি তো আরো সিনেমায় কাজ করছেন কেন এই সিনেমার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন বলে আপনি মনে করেন। তিনি উত্তরে জানান, ‘নোনা জলের কাব্য’ সিনেমাটি আমার ক্যারিয়ারের ৩য় সিনেমা। এর আগে আরো ২টি সিনেমায় আমি কাজ করেছি ‘নোনা পানি’ ও ‘শনিবার বিকাল’। রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের ‘নোনা জলের কাব্য’ চলচ্চিত্রের শিল্পনির্দেশনায় বড় চ্যালেঞ্জটি ছিল লোকেশন গুলোতে শিল্প নির্দেশনাকে ব্লেন্ড করতে পারা। তাও আবার নানান প্রাকৃতিক প্রতিকুলতার মধ্য দিয়েই। চেষ্টা করেছি। আমার হিসেবে হয়ত সেটা গল্পকে কমপ্লিমেন্ট করেছে। আর তাছাড়া যে বছরে সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে সে বছর মুক্তিপ্রাপ্ত অন্যান্য সিনেমাগুলোর শিল্পনির্দেশনার চেয়ে এই সিনেমার শিল্পনির্দেশনা একটু আলাদা ছিল। এসব নানান কারণেই হয়তো বিজ্ঞ বিচারকগণ এই সিনেমার শিল্পনির্দেশনাকে জাতীয় পুরস্কার পাবার যোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

6 − one =