শিশুর ক্লাবফুট

মুহাম্মদ ফয়সুল আলম: সুমন ও সোনিয়া (ছদ্মনাম) দম্পতির সন্তান আছওয়াদ নাফ, দেখতে বেশ সুন্দর। কিন্তু সে যখন জন্ম নেয় তখন তার পায়ের সমস্যা ধরা পড়ে। সোনিয়া তার বাচ্চার এ অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে ডাক্তাররা তাকে আশ্বস্ত করলেন, এটা কোনো সমস্যা নয়, অর্থোপেডিক ডাক্তার দেখালেই বাচ্চার পায়ের সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে। পরে ওই দম্পতি তাদের সন্তানকে নিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে যান এবং সেখানকার একজন অর্থোপেডিক ডাক্তার দেখান। ডাক্তার বলেন, প্রতি সপ্তাহে প্লাস্টার করাতে হবে এবং পা ঠিক হতে কিছুটা সময় লাগবে। বাংলাদেশে কম বেশি ৫ হাজার শিশু ক্লাবফুট বা মুগুর পা অর্থাৎ বাঁকা পা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সবশিশুর দুই পায়ে ক্লাবফুট হয়না। মেয়ে শিশুদের থেকে ছেলে শিশুদের এ জন্মগত সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। বিশ্বে এধরনের সমস্যা নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর হার প্রতি হাজারে ১.২ জন।

ক্লাবফুট বা মুগুর পা একটি জন্মগত সমস্যা যেখানে নবজাত শিশু জন্মের সময় এক অথবা উভয় পায়ের পাতা ভেতরের দিকে বাঁকা অবস্থায় নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় কনজেনিটাল ট্যালিপ্স ইকুইনোভ্যারাস (সংক্ষেপে সিটিইভি)। অজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষই একে চিকিৎসার অযোগ্য একটি সমস্যা ভাগ্যের পরিহাস বলে মনে করে। ফলে অনেক শিশুরই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। সচেতনতার অভাবে চিকিৎসা বঞ্চিত শিশু সারা জীবন নিদারুণ কষ্টে ভোগে। উন্নত বিশ্বের কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে মুগুর পা নিয়ে হাঁটতে দেখা যায় না। কারণ তারা শৈশবেই শিশুদের চিকিৎসা করিয়ে ফেলে।

প্রতিবছরই আমাদের দেশে ক্লাবফুট বাচ্চা জন্মগ্রহণ করছে এবং মা-বাবারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ছেন। সামাজিক কুসংস্কারের ফলে এ অবস্থাকে অভিশাপ ভাবা হলেও এটা কোনো অভিশাপ বা পাপের কারণে হয় না। আমাদের মা-বাবা ক্লাবফুট বাচ্চাদের সমাজ থেকে আড়াল করে রাখেন সচেতনতার অভাবে। অথচ এসবের আধুনিক চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই সম্ভব। সরকার বিনামূল্যে এ চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করছে।

শিশু ক্লাবফুট নিয়ে জন্মগ্রহণ করলে তার একটি বা উভয় পা ভেতরের দিকে বা নিচের দিকে বাঁকানো থাকে। হাড়ের সঙ্গে মাংসের সংযোগ ঠিকঠাক রাখতে টেন্ডন নামক এক ধরনের টিস্যু কাজ করে। টেন্ডনের দৈর্ঘ্য স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে পায়ের এ ধরনের বিকৃতি দেখা যায়। এ ছাড়াও শিশুর পায়ের হাড়, জোড়ার হাড় কিংবা মাংসের কোনো সমস্যার কারণেও ক্লাবফুট হতে পারে। স্বল্প বা উচ্চমাত্রায় শিশুদের ক্লাবফুট ত্রুটি হয়ে থাকে। তবে এতে শরীরে কোনো ব্যথা হয় না, শিশু দাঁড়ানো কিংবা হাঁটতে শুরু করার আগ পর্যন্ত সে তেমন কোনো সমস্যারও সম্মুখীন হয় না। তবে সময়মতো চিকিৎসা না করানো হলে শিশুর হাঁটতে সমস্যা হয়। যথাসময়ে ক্লাবফুট চিকিৎসা না করা হলে আর্থ্রাইটিস হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। এতে শরীরে জোড়ায় জোড়ায় স্বল্প ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, শক্ত হয়ে যাওয়া, ফুলে যাওয়া প্রভৃতি লক্ষণ দেখা যায়। তাই চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু করা যায়, ততই শিশুর জন্যে মঙ্গল। হতে পারে সেটা শিশুর ১ সপ্তাহ বয়স থেকেই। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হলে, এ রোগ নিরাময় সম্ভব।

মুগুর পা চিকিৎসার বিভিন্ন উপায় রয়েছে। ট্রেচিং পদ্ধতি, পনসেটি পদ্ধতি, ফরাসি পদ্ধতি এবং সার্জারি।  তবে মুগুর পায়ের সবচেয়ে ভালো, নিশ্চিত, সর্বস্বীকৃত, সস্তা ও পুরোপুরি স্থায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছে পনসেটি মেথড। গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থোপেডিক ফিজিশিয়ান ডাক্তার ইগ্নাসিও পনসেটি এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। পরবর্তীতে ডাক্তার জন হের্জেনবার্গ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এবং যুক্তরাজ্যের পনসেটি সার্জন ডাক্তার স্টিভ ম্যানিয়ন আফ্রিকায় এই পদ্ধতি বিপুলভাবে প্রচলন করেন। ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই পনসেটি পদ্ধতিতে মুগুর পা-এর চিকিৎসা করা হয় এবং এতে রিল্যাপসের কোনো ঝুঁকি থাকে না। যার ফলে সমগ্র বিশ্বে জন্ম নেওয়া এমন হাজার হাজার বিকলাঙ্গ শিশু মাত্র কয়েক মাসের চিকিৎসায় সারা জীবনের জন্য সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সুযোগ পায়। তবে একথা সত্য যে  মুগুর পায়ের কোন ধরনের সমস্যার জন্য কোন পদ্ধতির চিকিৎসা প্রয়োজন তা একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নির্ধারণ করবেন। জন্মের পর বাচ্চার এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত একজন শিশু বিশেষজ্ঞ ও একজন অর্থোপেডিক সার্জনের পরামর্শ নিতে হবে।

ঠিক কি কারণে শিশুদের ক্লাবফুট নিয়ে জন্ম নেয় তা সঠিকভাবে জানা সম্ভব না হলেও ধারণা করা হয় শিশু জন্মে সময় মায়ের পেটে পানি কমে গেলে এই রোগ হতে পারে। একটি শিশু জন্মের সময় শারীরিক গঠন, কার্যকারিতা বা কোনো অস্বাভাবিকতার জন্য জন্মগত সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে। তবে কিছু বিষয় অনাগত শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে আর তা হলো গর্ভকালীন সংক্রমণ, বিশেষ করে রুবেলা বা জার্মান মিজলস, সাইটোমেগালো ভাইরাস, টক্সোপ্লাজমা ইত্যাদি জীবাণুর সংক্রমণ। এমনকি সাধারণ জলবসন্তও বাড়িয়ে দিতে পারে এ ঝুঁকি। এছাড়াও  ৪০ বছরের বেশি বয়সি গর্ভবর্তী মহিলাদের ক্লাবফুটসহ শিশু জন্ম দেওয়া সম্ভাবনা বেশি থাকে। শুধু তাই নয়, মায়ের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা বা কোনো জটিল রোগ, মায়ের অপুষ্টি, বিশেষ করে ফলিক এসিড বা আয়োডিনের অভাব, পরিবারে জিনগত রোগ, যা রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়ের মধ্য বিয়ে হলে দেখা দিতে পারে এবং মা-বাবার ক্লাবফুট থাকলে শিশুরও তা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। গর্ভকালীন নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ক্লাবফুট নির্ণয় করা যায়। ক্লাবফুট বাচ্চাদের যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করা উচিত। যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে সফলতার হার তত বেশি। জন্মের প্রথম সপ্তাহ থেকেই চিকিৎসা শুরু করলে ভালো ফল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

২০০৯ সাল থেকে “ওয়াক ফর লাইফ” প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে ক্লাবফুট বা মুগুর পা নিয়ে জন্মানো শিশুদের পনসেটি পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়ে আসছে। অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টরা প্রতি সপ্তাহে একবার প্লাস্টারিং-এর মাধ্যমে ৫-৬ সপ্তাহের মধ্যেই শিশুদের মুগুর পা সঠিক অবস্থানে নিয়ে আসেন। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো শিশুর এ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপাচার করার প্রয়োজন হয়, তবে সেটির খরচও পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকার মধ্যেই। এরপর শিশুকে একটি বিশেষ জুতা বা ব্রেস পরতে দেওয়া হয়। ব্রেস না পরলে শিশুর পা আবার রিল্যাপসের ঝুঁকিতে থেকে যায়। প্রথম মাসে এটি দিনে ২৩ ঘন্টা পরতে হয়। এরপর ব্রেসটি শুধু  রাতে ঘুমানোর সময় শিশুকে পরাতে হয়।এই পুরো পদ্ধতিটি বাইরের দেশে অনেক ব্যয়বহুল। এর কারণ হচ্ছে বিশেষ জুতা বা ব্রেসগুলোর প্রত্যেকটির দাম ২৫০ থেকে ৪০০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে আর্থসামাজিক অবস্থা  বিবেচনা করে দ্যা গ্লেনকো ফাউন্ডেশন দেশীয় কর্মী ও স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে ব্রেস তৈরির জন্য যশোরে একটি কারখানা চালু করেছে। এতে প্রতি ব্রেসে খরচ পড়ে মাত্র ৪-৫ মার্কিন ডলার এবং এই ব্রেসটি সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের।

দেশের শিশুদের প্রতিবন্ধিতা দূরীকরণে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের  আওতায় পরিচালিত হয় ‘দ্য ন্যাশনাল ক্লাবফুট প্রোগ্রাম অব বাংলাদেশ’। এটি যৌথভাবে পরিচালনা করে দ্য গ্লেনকো ফাউন্ডেশন ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। দেশের ২৭টি সরকারি হাসপাতাল ও ছয়টি বেসরকারি ক্লিনিকে প্রকল্প চালু আছে। ২০১০ সাল থেকে BSMMU থেকে বিনামূল্যে শিশুদের ক্লাবফুটের চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয়। ইতিমধ্যে সারা দেশে ২৫ হাজারেরও বেশি শিশুকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

এত কিছুর পরও আমাদের সমাজে মুগুর পা নিয়ে জন্মানো শিশু এবং বয়ঃপ্রাপ্তরা সমাজে নানারকম বঞ্চনার শিকার হয়। শৈশব থেকেই তাদের ব্যাপারে সমাজে এক ধরনের পৃথকীকরণ শুরু হয় বন্ধুদের সঙ্গে ছোটাছুটি, খেলাধুলা বন্ধের মাধ্যমে। পায়ের ব্যথার কারণে বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না তারা। নারীদের জন্য এই পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর। একটি মেয়ের যত গুণই থাকুক, মুগুর পা তার বিয়ের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অথচ সচেতনতার অভাবে অনেক পরিবার তাদের শিশুদের চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেন এবং সারা জীবন এসব শিশু দুঃর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করে। এর মাধ্যমে সমাজের কাছে ঐ শিশুটি বোঝা হয়ে যায়। বাবা মা একটু সচেতন হলেই খুব সহজেই  এ চিকিৎসা সুবিধা নিয়ে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারেন। এজন্য তৃনমূল পর্যায়ের জনগণকে সচেতন করতে গ্রাম্য প্রতিনিধি, ডাক্তার, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মসজিদের ইমামসহ অন্যান্য ধর্মের গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গকে কাজে লাগানো যেতে পারে।

বর্তমান সরকার চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে বদ্ধপরিকর। ক্লাবফুট একটি বিরল জন্মগত অবস্থা এবং এটি চিকিৎসা ছাড়া নিরাময় সম্ভব নয়। তবে যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এধরনের চিকিৎসায় সফলতার হার সন্তোষজনক। মনে রাখা দরকার ক্লাবফুট সারা জীবনের অসুখ নয়। ক্লাবফুট একবার চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো হলে আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। চিকিৎসার মাধ্যমে ক্লাবফুট আক্রান্ত সকল শিশু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে তাদের হাসিমাখামুখ জাতীয় জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসবে এমন প্রত্যাশা সকল সচেতন নাগরিকের।

পিআইডি ফিচার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen + 18 =