শুভ জন্মদিন এলিটা করিম

মৌ সন্ধ্যা

দেশের সংগীত জগতের উজ্জ্বল নাম এলিটা করিম। গানে গানে মুগ্ধতা ছড়িয়ে চলেছেন তিনি। নাটক, চলচ্চিত্র, অডিও অ্যালবাম প্রায় সকল মাধ্যমের জন্যেই গান করেছেন তিনি। পেয়েছেন বেশকিছু পুরস্কারও। তার কণ্ঠ আলাদাভাবে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে দেয়। এলিটা করিম শুধু কণ্ঠশিল্পীই নন, তিনি একজন সাংবাদিকও। সেপ্টেম্বর মাসে এই পৃথিবীর আলোয় এসেছিলেন এলিটা। রঙবেরঙের পক্ষ থেকে তার জন্য রইলো জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

চট্টগ্রামে জন্ম মধ্যপ্রাচ্যে বেড়ে ওঠা

এলিটার পুরো নাম দিলশাদ করিম এলিটা। ১৯৮২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম শহরের হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। চট্টগ্রাম শহরে জন্ম নিলেও এই শহরে বেড়ে ওঠা হয়নি তার। মাত্র দুই মাস বয়সে মা-বাবার সাথে পাড়ি দিতে হয় মধ্যপ্রাচ্যে। বাবা মোহাম্মদ নুরুল করিমের চাকরির সুবাদে সপরিবারে সৌদি আরব চলে যান তারা। এলিটার বেড়ে ওঠা সৌদি আরবে। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল দাম্মামে প্রাথমিক এবং ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ান স্কুল দাম্মামে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন।

উচ্চশিক্ষা নিতে দেশে ফেরা

এলিটা প্রায় ১৯ বছর পরে ২০০১ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে এলিটা সবার বড়। দুই ভাইয়ের একজন এমিলও গানের সাথে যুক্ত। তিনি শূন্য ব্যান্ডের কণ্ঠশিল্পী। আরেক ভাই এলিন দ্য ডেইলি স্টারের ক্রীড়া প্রতিবেদক। ছোটবোন ইলোরা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।

সংগীতের সঙ্গে

ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি ভালোবাসা ছিল এলিটার। চর্চাও করতেন নিজের মতো করে। দেশে ফিরে আবারও পুরোদমে সংগীত চর্চা শুরু হয়। যোগ দেন ব্ল্যাক ব্যান্ডে। ২০০৯ সালে প্রকাশ হয় তাদের প্রথম মিশ্র অ্যালবাম ‘আমার পৃথিবী’। অ্যালবামটির ‘মিথ্যা’ শিরোনামে একটি গানে ব্যান্ডের ভোকালিস্ট জনের সঙ্গে কণ্ঠ দেন এলিটা। গানটি জনপ্রিয়তা পায়। ভিন্ন ধরনের কণ্ঠের কারণে প্রশংসিত হন এলিটা। পরবর্তীতে এলিটা করিম গড়ে তোলেন তার নিজের ব্যান্ড ‘রাগা’। ব্যান্ডের নামেই একটি অ্যালবামও প্রকাশ করেন। সেই ব্যান্ড এখন আর নেই।

আলোচনায়

এলিটা করিম ‘অন্তহীন’ গানটি গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। গানটি গেয়েছিলেন আরেক জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মাহাদীর সাথে। তার গানের পরিধি বাড়তে থাকে। এরপর অনেক মিক্সড অ্যালবামে কণ্ঠ দিয়েছেন,  চলচ্চিত্র, মিশ্র অ্যালবাম, নাটক ও টেলিফিল্মে গান গেয়েছেন।

প্রথম অ্যালবাম

সংগীত ক্যারিয়ার শুরু করার প্রায় এক যুগ পরে নিজের প্রথম অ্যালবাম নিয়ে হাজির হন এলিটা করিম। ২০১৫ সালের মে মাসে নিজ নামে প্রকাশ পায় এলিটার প্রথম একক অ্যালবাম ‘এলিটা’। অ্যালবামটি যৌথভাবে প্রকাশ করে জিরোনা বাংলাদেশ এবং মাল্টি সোর্সিং লিমিটেড। এলিটা অনেক সময় নিয়ে অ্যালবামটির কাজ করেছেন। শিল্পী জানান ২০০৯ সালে ‘এলিটা’ অ্যালবামটির কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। এতে রয়েছে আটটি গান। গানগুলোর কথা লিখেছেন অনিক খান, রবিউল ইসলাম জীবন, আবদার রহমান, সন্ধি ও ফুয়াদ। সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন অদিত, সন্ধি, শাকের, পলাশ ও ফুয়াদ। গানগুলোর শিরোনাম ‘উড়ে যেতে চাই’, ‘ল্যান্ডফোনের দিনগুলোতে প্রেম’, ‘মায়া’, ‘ভেঙে গেল জড়তা,’ ‘গোধূলি’, ‘অপেক্ষা’ এবং ‘এমন কেন হলো’। অ্যালবামের মোড়ক উন্মোচনের পর সবার উদ্দেশ্যে এলিটা বলেছিলেন, ‘আমি অনেক অলস। তাই অ্যালবামটি করতে দেরি হয়ে গেল। সাধারণত যে ধরনের গান করি এই অ্যালবামে সে ধরনের গানই করেছি। বেশির ভাগই মেলোডি ধাঁচের। গানের কথা আর সুরে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেছি। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্য।’

চার ছক্কা হৈ হৈ

আইসিসি বিশ্বকাপ টি২০ প্রতিযোগিতার সূচনা সংগীত ‘চার ছক্কা হৈ হৈ…’ গানটির কথা মনে আছে! তুমুল জনপ্রিয় এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন এলিটা করিম। ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে আজব রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর কথা ও পিলু খানের সুরে রেনেসাঁ ব্যান্ডের সাথে ‘সাদা কালো নয়, নয় বাদামি’ গানে কণ্ঠ দেন।

সিনেমার গানে

সিনেমার বেশকিছু গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এলিটা। ২০১৫ সালে ‘পদ্ম পাতার জল’ চলচ্চিত্রের ‘একাকিনী তারা’ গানে কণ্ঠ দিয়ে শ্রেষ্ঠ গায়িকা বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। এরপর অনিমেষ আইচ পরিচালিত  ‘ভয়ংকর সুন্দর’ সিনেমায় তাহসানের সঙ্গে একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। এলিটা বলেন, ‘সিনেমায় আমার খুব একটা বেশি গান করা হয়নি। আমি সংগীতশিল্পী। সব মাধ্যমেই আমাকে কাজ করতে হবে। সিনেমার গানেও প্রবল আগ্রহ আছে। তবে সবাই তো সব ধরনের গান করতে পারেন না। আমার কণ্ঠে যায়, আমার টাইপের এমন গানের প্রস্তাব এলে অবশ্যই করব।’

সাংবাদিক রেডিও জকি অভিনেত্রী

অনেকেই জানেন একজন গণমাধ্যম কর্মী এলিটা করিম। ২০০১ সালে দেশে ফেরার পর ২০০৩ সালে বিনোদন প্রতিবেদক হিসেবে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সাথে যুক্ত হন তিনি। এরপর স্টার ম্যাগাজিনের সিনিয়র রিপোর্টার এবং স্টার ক্যাম্পাস ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন বহুদিন। বর্তমানে তিনি ইংরেজি দৈনিকটির ফিচার সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে মিলেছে অ্যাওয়ার্ডও। কিশোরী ও নারী পাচারের উপর একটি স্টোরির জন্য রেডক্রস ইন্টারন্যাশনাল এই অ্যাওয়ার্ড প্রদানের মাধ্যমে ২০০৯ সালে তাকে সম্মানিত করে। তার আর একটি পরিচয় তিনি একজন রেডিও জকি। গান, সাংবাদিকতা ও রেডিও জকি হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি তিনি ভাবেন সমাজ নিয়ে। সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য তিনি যুক্ত আছেন ‘জাগো ফাউন্ডেশনের’ সঙ্গে। গান ও সাংবাদিকতার বাইরে এলিটা বেশকিছু নাটকে অভিনয় করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে ‘মুকিম ব্রাদার্স’ এবং ক্লোজ আপ ‘কাছে আসার গল্প’।

সংসার জীবন

সাড়ে চার বছর প্রেম করার পর বিয়ের পর্ব সারেন কণ্ঠশিল্পী এলিটা করিম ও নির্মাতা আশফাক নিপুণ। ২০১৫ সালের ২৬ মে ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় দুজনের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এক সাক্ষাৎকারে নিপুণ বলেন, ‘শুরুর দিকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েও লাভ হয়নি। আমার মুকিম ব্রাদার্স সিরিয়ালের উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে আসে এলিটা। প্রথম দুই পর্ব দেখে মুগ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার ফোন নম্বর নেয়। পরদিন ফোন করে আর নিজেই আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। সেই থেকে বন্ধুত্ব শুরু। তারপর ভালোবাসা ও বিয়ে।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে নানা রকম এক্টিভিটির সঙ্গে দেখা গেছে এলিটা করিমকে। শিক্ষার্থীরা একতাবদ্ধ হয়ে যে সাহস নিয়ে এগিয়েছে, এটি তাকে খুবই অনুপ্রাণিত করেছে বলে জানান। একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে আবার এ গায়িকা মন খারাপ করে বলেন, বিজয় উদযাপনের মুহূর্তে গণভবন থেকে অনেকেই লুটপাট করছিলেন। সেসব ঘটনা তাকে মর্মাহত করেছে। এসব কাজ শিক্ষার্থীদের নয় বলে জানান এলিটা করিম। তিনি বলেন, ‘একটা সময় ছিল, আমরা ভাবতাম এখন মারধর করা হলো, এখন সবাই চুপচাপ হয়ে যাবেন। আগে তো এমন পরিস্থিতিই ছিল। এবারও যখন শিক্ষার্থীদের ওপর প্রথম হামলা হয়, তখন অনেকটা আতঙ্কে ছিলাম। কিন্তু এবার তাদের সাহস দেখতে পেলাম পদে পদে। রোববার যখন শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি আদায়ে সফল হলো, তখন মনে হলো আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি।’

এলিটা বলেন, ‘জানি, সবার মধ্যেই ক্ষোভ রয়েছে, এটিও বুঝতে পারছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যারা বিজয় এনে দেন, তাদের স্থান সবসময় অনেক ওপরে থাকে। এখন জাতীয় কোনো সম্পদ পোড়ানো, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভেঙে দেওয়া, এর বাইরে আরও অনেকের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে শুনলাম। সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত আনা হচ্ছে। এসব ঘটনা আমাকে মর্মাহত করেছে। অবশ্য সকাল থেকে ভালো লাগছে। শিক্ষার্থীদের দেখলাম সংসদ ভবন পরিষ্কারের দায়িত্ব নিয়েছে। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় সেই দায়িত্ব পালন করছে শিক্ষার্থীরা। আবার মানুষ যেগুলো গণভবন থেকে নিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো কেউ কেউ ফেরত দিয়ে যাচ্ছে। এগুলো যে জাতীয় সম্পদ, সেটা বোঝার উপলব্ধি হয়েছে, এটিও ভালো লেগেছে। একজন সংগীতের মানুষ হিসেবে, একটাই প্রত্যাশা নতুন বাংলাদেশ ভালোর দিকে যাবে।’

এ গায়িকা বলেন, ‘আমার মনে হয় এগুলো সুবিধাবাদী মানুষের কাজ। এটা কোনো শিক্ষার্থীর কাজ হতে পারে না। তারাই আবার সংসদ ভবনে প্রবেশ করে ধূমপান করছিলেন। আবার ৩২ নম্বরের যে বাড়ি, সেটি কিন্তু জাদুঘর। দেশের ঐতিহাসিক একটা জায়গা। সেটি নষ্ট করায় আমি মর্মাহত হয়েছি। কারণ আপনি যা-ই করুন না কেন, যে পক্ষেই থাকুন না কেন, আপনি ইতিহাসকে অস্বীকার করতে পারবেন না, যেটা হয়ে গেছে।’

শেষকথা

এক গণমাধ্যমে কেবল শ্রোতাপ্রিয়তার বিচারে নয়, গেয়ে নিজেও তৃপ্তি পেয়েছেন এমন পাঁচটি গান উল্লেখ করেছেন। গানগুলো হলো – জুবায়ের হোসেন ইমনের কথায় ব্ল্যাক ব্যান্ডের ‘মিথ্যা’, আশিকের কথায় রাগা ব্যান্ডের ‘কোথায়’, আহমেদ ইউসুফ সাবেরের কথা ও ফোয়াদ নাসের বাবুর সুরে রিমেক গান ‘যখনই নিবিড় করে’, তানভীর সজীবের কথায় ও অর্ণবের সুর-সংগীতে ‘মিনতি’, ফুয়াদ আল মুক্তাদিরের কথা ও সুরে ‘আমি উড়ে যেতে চাই’। আরো একটি গান ‘ল্যান্ডফোনের দিনগুলোতে প্রেম’ আশফাক নিপুণের একই নামের ফিকশনে গেয়েছিলেন এলিটা। গানটির গীতিকার অনিক খান। সুরকার  শাকের রাজা। সবশেষে আবারও জন্মদিনের শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন এলিটা করিম।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুছেচ্ছা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

19 − 14 =