শুভ জন্মদিন বাপ্পা মজুমদার

মাসুম আওয়াল: বাংলা সংগীতের এক উজ্জ্বল নাম বাপ্পা মজুমদার। সেই ক্যাসেটের যুগ থেকে শুরু। এরপর সিডির যুগও পেরিয়ে এসেছে অনলাইন, ইউটিউব বা ডিজিটাল মাধ্যম। মিউজিক ভিডিওর যুগেও সবাই যখন নানা উপায়ে গানের ভিউ বাড়াতে ব্যস্ত তখনও বাপ্পা মজুমদার গুরুত্ব দিয়েছেন গানের কথা, সুর, সংগীতেই। গানের মান ঠিক রেখেই বারবার নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন। নিজের গানের ভিডিও নির্মাণ করেছেন, তবে সেটাও ছিল রুচিসম্মত। রুচিশীল, মানসম্মত গান শুনতে ইচ্ছে করলে শ্রোতারা ছুটে যান বাপ্পা মজুমদারের গানের জগতে। তার গাওয়া বেশকিছু গান এখনো ঘোরে ফিরে শ্রোতাদের মুখে মুখে। তরুণ প্রজন্মেরও একটা বড় অংশ বাপ্পা মজুমদারের গানের ভক্ত। সব মিলিয়ে এখনো সমান তালে নতুন গান তৈরি করে চলেছেন বাপ্পা। এই ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে পৃথিবীর আলোয় এসেছিলেন প্রিয় এই শিল্পী। রঙবেরঙ এর পক্ষ থেকে রইলো জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

যেমন বাবা-মা তেমন ছেলে

প্রত্যেক বাবা-মা তাদের নিজেদের স্বপ্নগুলো বুনে দিতে চান সন্তানের মাঝে। কিন্তু সব সময় চাওয়া পাওয়া সমান নাও হতে পারে। তবে সবার ক্ষেত্রে কী ঘটছে সেটা এখানে বড় কথা নয়, বাপ্পা মজুমদারে ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে সেটা হলো শিল্পীর ঘরে শিল্পী হয়ে জন্মেছেন তিনি। ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাপ্পা মজুমদার জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঢাকায়। তার পুরো নাম শুভাশিস মজুমদার বাপ্পা। তিনি একই সঙ্গে সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার এবং সংগীত পরিচালক। তরুণ ভক্তদের তিনি বাপ্পা দা নামে পরিচিত। তার বাবা ছিলেন সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ বারীণ মজুমদার এবং মা ইলা মজুমদার। বাবা-মা দুজনই শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী হওয়ায় বাপ্পা মজুমদারকে বাড়ির বাইরে গান শিখতে যেতে হয়নি। হাতেখড়ি হয় বাবা-মার কাছেই। পরবর্তীতে ওস্তাদ বারীন মজুমদারের সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মণিহার সংগীত একাডেমীত তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতের ওপর পাঁচ বছরের কোর্স সমাপ্ত করেন।

যেভাবে ক্যারিয়ার শুরু

বাপ্পা মজুমদার তার সংগীত ক্যারিয়ার শুরু করেন গিটারিস্ট হিসেবে। এরপর বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে সহশিল্পী হিসেবে গান করেছেন তিনি। একক সংগীতশিল্পী হিসেবে বাপ্পা মজুমদার আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৯৫ সালে। সে বছর তার প্রথম অ্যালবাম তখন ভোর বেলাপ্রকাশিত হয়। বাপ্পা মজুমদার একজন ব্যান্ড মিউজিশিয়ান। ১৯৯৬ সালে তিনি ও সঞ্জীব চৌধুরী মিলে গঠন করেছিলেন দলছুটব্যান্ড। দলটি এখনো শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়।

বাপ্পার যত অ্যালবাম

এ পর্যন্ত বাপ্পা মজুমদার দশটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। এগুলো হলো: তখন ভোর বেলা’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘রাতের ট্রেন’, ‘ধুলো পড়া চিঠি’, ‘দিন পরে ছুটি’, ‘দিন বাড়ি যায়’, ‘বেঁচে থাক সবুজ’, ‘সূর্যস্নানে চল। বাপ্পার একক অ্যালবাম সূর্যস্নানে চল২০০৮ সালে প্রকাশ হয়। সপ্তম একক অ্যালবাম দিন বাড়ি যায়প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এক মুঠো গান ২, বের হয় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে।

২০১৪ সালের ১৬ জুলাই প্রকাশিত হয় তার দশম একক অ্যালবাম জানি না কোন মন্তরে। তিনি সমসাময়িক অন্যান্য সংগীতশিল্পীদের সাথেও কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন, সামিনা চৌধুরীফুয়াদ আল মুকতাদির, শায়ান চৌধুরী অর্ণব, মিলা ইসলাম, দিলশাদ নাহার কনা, এলিটা করিম। বাপ্পা মজুমদারের গাওয়া বহু গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: দিন বাড়ি যায়’, ‘পরী’, ‘সূর্যস্নানে চল’, ‘তাও কেন দেখছো না’, ‘জানালার গ্লাস’, ‘তুমি আমার বায়ান্ন তাস’, ‘জানি না কোন মন্তরেইত্যাদি।

চলচ্চিত্রের গান ও আবহ সংগীতে

কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবেই বাপ্পা মজুমদারের পরিচিতি। তবে কয়েক বছর ধরে চলচ্চিত্রের আবহ সংগীতের কাজও করছেন তিনি। ২০১৭ সালে হাসিবুর রেজা কল্লোল পরিচালিত সত্তাসিনেমায় প্রথমবারের মতো আবহ সংগীত করেন বাপ্পা। সিনেমাটির সব গানের সংগীত পরিচালনাও করেছিলেন তিনি। তার সুর ও সংগীতে গান গেয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন জেমস ও মমতাজ। একই ছবির সুরকার হিসেবে প্রথমবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন বাপ্পা মজুমদার। এরপর শাকিব খান অভিনীত লিডার: আমিই বাংলাদেশসিনেমার সঙ্গে যুক্ত হন বাপ্পা। এই সিনেমার আবহ সংগীত করেছেন এবং সিনেমাটির জন্য একটি গানও গেয়েছেন তিনি। গানটির সংগীত পরিচালকও বাপ্পা মজুমদার। এ ছাড়া বাপ্পা মজুমদার করেছেন ভালোবাসা প্রীতিলতাসিনেমার আবহ সংগীতের কাজ।

প্রতিবাদি বাপ্পা

কবর কিংবা চিতা/ সেই তো সাড়ে তিন হাত/ তবুও কেন বলো বন্ধু/ বাছো এতো জাত-পাত/ তোমার ধর্ম, তোমার বর্ম/ মানুষের চেয়েও দামি/ এরই নাম যদি সভ্যতা হয়/ নিকুচি করি আমি!এমনই কথার একটি গান গেয়েছিলেন বাপ্পা মজুমদার। গানটি নিয়ে তার ভাষ্য, ‘কেউ যদি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গানটিকে স্বীকৃতি দিতে চান, তিনি পারবেন। কারণ গানটির কথাগুলোর অনুভূতি শাশ্বত। যেকোনো অমানবিক, সাম্প্রদায়িক ও ধ্বংসের বিরুদ্ধে গানটি।গত বছর অক্টোবর মাসে ইউটিউবে প্রকাশ হয় হে পাথরশিরোনামের গানটি।

কথাগুলো লিখেছেন মহসীন মেহেদী। হে পাথরগানটির মিউজিক ভিডিওতেও ছিলেন বাপ্পা মজুমদার। ভিডিওটিতে দেশ-বিদেশে ঘটে যাওয়া যুদ্ধ ও অমানবিক অনেক ঘটনার ভিডিও ব্যবহার করা হয়। গানটি তৈরির গল্প শুনিয়ে বাপ্পা মজুমদার বলেছিলেন, ‘কথাগুলো হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সুর করার কাজ ধরি। সারা পৃথিবীতে যে অমানবিক কর্মকাণ্ড ঘটছে, তারই প্রতিবাদ হিসেবে গানটি করা। শুধু সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নয়, যেকোনো অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবেই গানটিকে শ্রোতারা চাইলে স্বীকৃতি দিলে আপত্তি থাকবে না।

জন্মদিনে যাদের মিস করেন

সময় যেন এক দস্যি ঘোড়া, নদীর স্রোত। খুব দ্রুত বয়ে যায়। চোখের পলকেই ফুরিয়ে যায় একেকটা বছর। আর মৃত্যুর দিকে হাঁটতে থাকি আমরা। তবুও জন্মদিনকে ঘিরে নানা আয়োজন হয়। প্রিয়জনরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান, নানা রকমের উপহার দেন। অনেক আয়োজনের মধ্যেও কখনো কখনো মন ভার হয়ে ওঠে। এমন কিছু মানুষের কথা মনে পড়ে, যাদের আর কখনোও ফিরে পাওয়া সম্ভব না। অথচ তাদের ছাড়া সবকিছু কেমন অসম্পূর্ণ মনে হয়। বাপ্পা মজুমদারও জন্মদিনে মিস করেন তার প্রিয় মানুষদের। জনপ্রিয় এই শিল্পী ও সংগীত পরিচালক জানান, যাদের জন্য পৃথিবীর আলো দেখা, জন্মদিনে সেই বাবা ও মাকে ভীষণ মিস করেন তিনি। জন্মদিনের অনুভূতি জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আসলে একটা সময় ছিল যখন জন্মদিন আসলে খুব আনন্দ হতো। এখনও আনন্দ হয়, তবে এখন অনুভব করি যে, বয়সটা বাড়ছে। অনুভব করি অনেক কিছু করার আছে এখনও। অনেক কিছু শেখার আছে। চেষ্টা করছি নিজেকে সমৃদ্ধ করতে।

ব্যক্তিগত জীবন

ব্যক্তিগত জীবনে বাপ্পা মজুমদার দুটি বিয়ে করেছেন। ২০০৮ সালের ২১ মার্চ মেহবুবা মাহনূর চাঁদনীকে বিয়ে করেন বাপ্পা মজুমদার। ২০১৭ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ সালের মে মাসের ১৬ তারিখে অভিনেত্রী ও মডেল তানিয়া হোসেনের সঙ্গে বাগদান সম্পন্ন হয় সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদারের। সেই বছরের জুন মাসেই বিয়ে হয় তাদের। তাদের একটি মেয়ে সন্তান আছে। বাপ্পা তার মেয়ের নাম রেখেছেন অগ্নিমিত্রা মজুমদার পিয়েতা। বর্তমানে তানিয়া ও মেয়ে অগ্নিমিত্রাকে নিয়ে বাপ্পা মজুমদারের সুখের সংসার।

সর্বশেষ

শ্রোতানন্দিত সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার সর্বশেষ তার ভক্তদের উপহার দিয়েছেন আর কেউ নেইশিরোনামের একটি গান। বাপ্পা নিজেই গানটিতে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন। গানটি প্রকাশ হয়েছিল ২১ জানুয়ারি। গানটি লিখেছেন এফএইচ সরকার স্বপ্নীল। গানটির ভিডিও বাপ্পা মজুমদারের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়। বাপ্পা জানান, গানটি বিইএমএমজেড ওয়ার্কস্টেশন থেকে নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘গানটি নিয়ে আমার ও স্বপ্নীলের একটা স্বপ্ন ছিল। ও যখন আমাকে গানটি লিখে দেয় তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নিই গানটি করব। এটি আরও পাঁচ বছর আগের কথা। সময় এবং ব্যস্ততার কারণে গানটি আর করা হয়নি। এবার সম্পন্ন হলো। ভালো লাগছে।বাপ্পা মজুমদার গানের প্রয়াত গীতিকার স্বপ্নীলকে নিয়ে আরও বলেন, ‘স্বপ্নীল তার গানটি আমাকে দিয়ে নিজে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। গানের রেকর্ড করার সময় চোখ বন্ধ করলেই স্বপ্নীলের চেহারা সামনে ফুটে উঠত। ও থাকলে আজ খুব খুশি হতো। এই গান স্বপ্নীলকেই উৎসর্গ করলাম আমি।গানটি এরই মধ্যে বেশ শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে। সামনে আরও নতুন নতুন গান নিয়ে হাজির হবেন বাপ্পা মজুমদার। আবারও জন্মদিনের শুভেচ্ছা তাকে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

18 + nine =