শেরপুরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভ্রমণ পিপাসুদের মুগ্ধ করছে

গারো পাহাড়ঘেরা শেরপুর জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যুগে যুগে ভ্রমণ পিপাসুদের মুগ্ধ করে আসছে। সৌন্দর্যে এ লীলাভূমি দেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশে বড় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি এর মাধ্যমে শেরপুরে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি অনুদান ও সংশ্লি­ষ্ট বিভাগের সঙ্গে যথাযথ সমন্বয় সাধন করার পাশাপাশি উন্নত অবকাঠামো ও সঠিক পরিকল্পনা দরকার পর্যটনের জন্য। পর্যটনশিল্পের উপাদান ও ক্ষেত্রগুলো দেশে ও বিদেশে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে জেলার পর্যটনশিল্পের অধিকতর বিকাশ ঘটানো সম্ভব। নতুন নতুন কৌশল ঠিক করে সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগালে এ জেলা পর্যটনের অন্যতম মডেল হতে পারে বলে ধারনা সচেতন মহলের।

স্থানীয় পর্যটন বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বে পর্যটনশিল্প আজ বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পর্যটনশিল্প সম্প্রসারণের উপর দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে। পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটলে কর্মসংস্থান ঘটবে ও বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন হবে। প্রাচীন যুগের ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রথার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ঐতিহাসিক স্থান দেখার জন্যও পর্যটকরা নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে দূর-দূরান্তে ছুটে চলে প্রতিনিয়ত। এ শিল্পের বহুমাত্রিকতার কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

আসুন জেনে নেওয়া যাক শেরপুরের পর্যটন সমূহের নাম ও বর্ণনা :

মধুটিলা ইকোপার্ক : জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁওয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে মধুটিলা ইকোপার্ক সম্প্রসারণ হয়। মধুটিলা ইকোপার্কে শোভাবর্ধনকারী ও বিরল প্রজাতির বৃক্ষের বনায়নের পাশাপাশি আছে বিশ একরের ওষুধি বৃক্ষের বনায়ন। এ ছাড়া রয়েছে রেস্টহাউস, বাসগৃহ, বিভিন্ন বন্য প্রাণির ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, আকর্ষণীয় রাইড, স্টার ব্রিজ, ক্যান্টিন, মিনি চিড়িয়াখানা, কার পার্কিং এবং বসার স্থান। মধুটিলার লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ৫টি দেশি নৌকা ও ৩টি প্যাডেল বোট রয়েছে। সবুজের সমারোহ আর পাহাড়ের হাতছানিতে প্রতিবছর সারা দেশ থেকে সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ মধুটিলায় বেড়াতে আসেন। মধুটিলায় দিনের বেলা ব্যবহারের জন্য ভ্রমণকারীদের জন্য রয়েছে মহুয়া রেস্টহাউস। তবে এখানে রাত্রি যাপন করা যায় এবং রেস্টহাউস ব্যবহার করতে চাইলে সংশ্লি­ষ্ট ব্যক্তিদের অনুমতি নিতে হয়।

রাজার পাহাড় : শেরপুর শহর থেকে মাত্র ৩৪ কিলোমিটার দূরে শ্রীবরদীর কর্ণঝোরা বাজার। বাস, টেম্পোসহ যেকোনো যানবাহনে যাওয়া যায় মনোমুগ্ধকর নয়নাভিরাম স্থান রাজার পাহাড়ে। পাশেই রয়েছে অবসর কেন্দ্র। রাত হলে সেখানে থাকার জন্য রয়েছে নিরাপত্তাবেষ্টিত আবাসিক ভবন।

গজনী অবকাশ কেন্দ্র : গজনী অবকাশ কেন্দ্র জেলার ঝিনাইগাতীর ভারতের মেঘালয় রাজ্য সংলগ্ন গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে অবকাশ কেন্দ্রের সারি সারি গজারি, শাল ও সেগুনগাছের সারি প্রশান্তি এনে দেয়। শীতকালে গারো পাহাড়ের সৌন্দর্য অবলোকন করতে ভ্রমণপিয়াসী মানুষ এখানে ছুটে আসেন। পাহাড়ি ঝরনা, লেক, টিলা, ছড়ার স্বচ্ছ জল ও ঘন সবুজ বন এখানকার পরিবেশকে দিয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

পানিহাটা-তারানি পাহাড় : জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া এলাকায় সারি সারি পাহাড় দিয়ে ঘেরা পানিহাটা ও তারানি গ্রামের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত অঞ্চল পর্যটকদের কাছে পানিহাটা-তারানি পাহাড় হিসেবে সুপরিচিত। তারানি পাহাড়ের উত্তরে রয়েছে মেঘের আবছা আবরণে ঢাকা ভারতের তুরা পাহাড়। তুরা পাহাড়ের দূরের টিলাগুলো যেন মেঘের রাজ্যের সঙ্গে মিতালি করে চারপাশে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। তুরার অববাহিকা থেকে সামনের পশ্চিম দিকে বয়ে চলেছে পাহাড়ি ভোগাই নদী। এ নদীর স্বচ্ছ পানির নিচে, রোদের আলোয় চিকচিক করা নুড়ি পাথর আর শত ফুট উঁচুতে থাকা সবুজে জড়ানো পাহাড় চারপাশে এক ভিন্নধর্মী সৌন্দর্যের  আবহ তৈরি করেছে। তুরা নদীর পাশে আরও আছে খ্রিষ্টানদের উপসনালয়, ছোট একটি চিকিৎসা কেন্দ্র, বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের থাকার আবাসিক হোস্টেল। প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়ার পাশাপাশি মেঘ ও পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখার জন্য প্রতিবছর দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটক এ জায়গায় ঘুরতে আসে।

ব্রহ্মপুত্র নদ : হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদটি চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে। পরবর্তী সময়ে নদটি যমুনা নাম ধারণ করে প্রধান অংশ জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ হয়ে চলে যায় এবং জামালপুরের ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ হয়ে এ নদের বাকি অংশ শেরপুর-জামালপুর সীমারেখায় প্রবহমান হয়ে এ নদ ময়মনসিংহ হয়ে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করে।

ভোগাই নদী : ভারতের তুরা পাহাড়ে বিভিন্ন ঝরনার সম্মিলনে কংশ নদীর উৎপত্তি। শেরপুরের হাতিবাগার এলাকা দিয়ে কংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে শেরপুরের নালিতাবাড়ী পর্যন্ত এ নদীটির নাম ভোগাই। নালিতাবাড়ীর ৫ মাইল ভাটিতে এসে দিংঘানা, চেল্লাখালী, দেওদিয়া মারিসি, মালিঝি নামে উপনদীগুলো ভোগাইয়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভোগাই সে স্থানে বেশ খরস্রোতা বলে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে ফুলপুরের কাছাকাছি এসে খড়িয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

সুতানাল দিঘি : জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার শালমারা গ্রামে অবস্থিত সুতানাল নামের এক দিঘি। কারও মতে, কমলা রানি বা সুতানাল, আবার কারও কাছে রানি বিরহিনী নামে দিঘিটি পরিচিত। তবে প্রাচীনকালের এ দিঘিটি এলাকায় সুতানাল দিঘি নামে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। বিশাল ওই দিঘির নামকরণে রয়েছে চমকপ্রদ প্রাচীন কাহিনি। ৬০ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয় দিঘিটি। তবে সংশ্লি­ষ্ট ভূমি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে দিঘিটি সংকুচিত হয়ে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ একর ৭০ শতাংশ। এটি এলাকার প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন বলে প্রবীণরা জানিয়েছেন। দিঘিটিকে এক নজর দেখার জন্য বছরের প্রায় প্রতিদিন উৎসুক মানুষ ছুটে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। নালিতাবাড়ী উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে উত্তরে ভারত সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউপির শালমারা গ্রামে অবস্থিত এ সুতানাল দিঘি। ঐতিহাসিক এ দিঘিটিকে কখন কোন উদ্দেশ্যে খনন করা হয়েছিল, তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি আজও।

মাইসাহেবা জামে মসজিদ : এর নির্মাণকাল আনুমানিক ২৫০ বছর আগে। এটিও এ জেলার প্রাচীন নিদর্শনের একটি। বর্তমানে মসজিদটি আধুনিক ভাবধারায় পুননির্মাণ হয়েছে। বক্রাকারে খিলানের ব্যবহার এবং দৃষ্টিনন্দিত ২টি সুউচ্চ মিনার। স্থাপত্যকলার আধুনিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায় এ মসজিদটিতে। এটি শহরের প্রাণকেন্দ্র শেরপুর সরকারি কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে অবস্থিত। শহরে প্রবেশের সময় এর মিনার দুটি অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। বিশাল এ মসজিদের সামনের অংশে অনেক জায়গা রয়েছে। এখানে প্রতিবছর ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। শহরে প্রবেশের পর যে কারও মসজিদটি নজর কাড়বে।

গড়জরিপা বারোদুয়ারি মসজিদ : স্থাপত্য নিদর্শনের অন্যতম গড়জরিপা বারোদুয়ারি মসজিদ। এটি এ অঞ্চলের ঐতিহ্য। জনশ্রুতিতে আনুমানিক ৭০০-৮০০ বছর আগে জরিপ শাহ নামক এক মুসলিম শাসক কর্তৃক নির্মাণ করেছিলেন মসজিদটি। তবে এটি বর্তমানে পুননির্মাণ করা হয়েছে। আসল মসজিদটি ভূগর্ভেই রয়ে গেছে। তার ওপরেই স্থাপিত হয়েছে বর্তমান মসজিদটি। জামালপুর সদর উপজেলার তিতপল্লা ইউনিয়নের পিঙ্গলহাটী (কুতুবনগর) গ্রামের (ব্রাহ্মণ ঝি বিলের উত্তর পাড়ে) জনৈক পীর আজিজুল হক সাহেব খননকাজ চালান এবং বের করেন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। মসজিদটির ইটের ধরন খানবাড়ি মসজিদের ইটের সঙ্গে যথেষ্ট মিল লক্ষ করা যায়। প্রাচীন রীতির সঙ্গে আধুনিক রীতির সংমিশ্রণে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে, যা সহজেই দর্শকদের মন জয় করে। অপরূপ সুন্দর এ মসজিদটি আসলে পুরাকীর্তিও নিদর্শন। ১২টি দরজা থাকায় এর নামকরণ করা হয় বারদুয়ারি মসজিদ। আগেও তাই ছিল। অপূর্ব কারুকাজসংবলিত মেহরাব ও কার্নিশগুলো সবার দৃষ্টি কাড়ে। এছাড়া কিছু দূরে জরিপ শাহের মাজার অবস্থিত। এর অনতিদূরে কালিদহ সাগর রয়েছে। জনশ্রুতিতে আছে চাঁদ সওদাগরের ডিঙ্গা এখানেই ডুবেছিল। নৌকার আদলে কিছু একটা অনুমান করা যায় এখনো। অঞ্চলটিতে একবার ঘুরে এলে যেকোনো চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিয়ে তুলবে। খননকাজ চালালে হয়তো বেরিয়ে আসবে এ অঞ্চলের হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার নানা উপকরণ।

ঘাঘড়া খানবাড়ি জামে মসজিদ : এর নির্মাণকাল আনুমানিক ৬০০ বছর আগে। কথিত আছে, পালানো খাঁ ও জব্বার খাঁ দুই সহোদর কোনো এক রাজ্যের সেনাপতি ছিলেন। পরাজিত হয়ে ভ্রাতৃদ্বয় এ অরণ্যে আশ্রয় নেন এবং সেখানে এ মসজিদ স্থাপন করেন। মসজিদটির বিশেষত হলো যে এর ইটগুলো চারকোনা টালির মতো। প্রায় ৭০০ বছর আগে এ ইটগুলোর ব্যবহার ছিল। আস্তরণ বা পলেস্তারা ঝিনুক চূর্ণ অথবা ঝিনুকের লালার সঙ্গে সুররি, পাট বা তন্তুজাতীয় আঁশ ব্যবহার করেছে। এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির নির্মাণকৌশল গ্রিক ও কোরিন থিয়ান রীতির প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। প্রবেশপথের ওপর রয়েছে আরবি ভাষায় নির্মাণকাল ও পরিচয় শিলালিপি, দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, সেই যুগেও দক্ষ স্থপতি এ অঞ্চলে ছিল। মসজিদটি পুরাকীর্তির এক অনন্য নিদর্শন। যা দেখে যেকোনো পর্যটক আকৃষ্ট হবেন, বিমোহিত হবেন।

গোপী নাথ ও অন্নপূর্ণা মন্দির : এর নির্মাণকাল ১৭৮৩ সাল। নির্মাতা জমিদার সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরী। মন্দিরটি স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম নিদর্শন। পাঁচটি কক্ষবিশিষ্ট মন্দিরটি পদ্মস্তম্ভ দ্বারা দন্ডায়মান। স্তম্ভ শীর্ষে ও কার্নিশে ফুল ও লতাপাতার নকশাসংবলিত এক অপরূপ স্থাপত্য। ডরিক ও গ্রিক ভাবধারায় নির্মিত। বেদির ওপরে স্থাপিত অনেকগুলো ধাপে। জানালাগুলোর ওপরেও রয়েছে অনেক অলংকার। দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে ওপরের কার্নিশ রাজকীয় মুকুটবিশিষ্ট তাজিয়া স্থাপন করা হয়েছে, যা দেখে মৌর্য যুগের স্থাপত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

নয়আনি জমিদার বাড়ির রংমহল : জমিদারবাড়ির ঠিক দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত রংমহল, যা দেখে সহজেই ধারণা করা যায় জমিদাররা ছিলেন সংস্কৃতিপ্রিয়। নাচ-গানের প্রতি ছিল অনুরাগ। উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি এ স্থাপত্যটিতে রয়েছে অনেকগুলো কাঠের জানালা। জানালার ওপরে দর্শনীয় ভেন্টিলেশনের ব্যবহারও রয়েছে, যা ইচ্ছামতো ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া ছাদের নিচের অংশে কাচের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো ও বাতাস প্রবেশ করতে পারে। পুরো ভবনটির গা-জুড়ে বিভিন্ন রকমের নকশা ফুল, লতাপাতা ও মোটিভ ব্যবহার করা হয়েছে। কার্নিশ ও কার্নিশের নিচে রয়েছে অপরূপ নকশা। দক্ষিণ অংশটিতে অনেক কারুকাজের ব্যবহার। এ দিকটাই ভবনটির সম্মুখ অংশ। ৬টি গোলাকৃতি স্তম্ভ¢ ও ২ কোনায় দুটি ৪ কোনা স্তম্ভের নিচ থেকে শেষ ভাগ পর্যন্ত নকশাখচিত। দক্ষিণ দিকের অংশের সম্মুখভাগে রয়েছে ৬টি গোলাকার স্তম্ভ। দুই কোনায় কোণাকৃতির স্তম্ভে ব্যবহার করা হয়েছে ব্লক। স্তম্ভগুলোর নিচে থেকে শেষ পর্যন্ত অলংকৃত। ছাদ এবং কার্নিশের ওপরের অংশে পাঁচটি প্রধান ও অনেকগুলো মিনারাকৃতি গম্বুজের আদলে নকশা রয়েছে, যা স্থাপত্যটিকে অধিক আকর্ষণীয় করেছে। কার্নিশেও বিভিন্ন ফর্মের ব্যবহার দেখা যায়। ২০০৪ সালে বিএনপি জামাত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর হিন্দু জমিদার দ্বারা নির্মিত আকর্ষণীয় রংমহলটি সাম্প্রদায়িক কারণে এটিকে ভেঙে ফেলে। সে সময় শেরপুরের সুশিল সমাজ রংমহলের সংরক্ষণের দাবি জানালেও তা কর্ণপাত করা হয়নি

পৌনে তিন আনি জমিদার বাড়ি : জমিদার সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরীর বাড়িকে বলা হতো পৌনে তিন আনি জমিদারবাড়ি। গ্রিক স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত স্থাপত্যটি এখনো অক্ষত অবস্থায় সাক্ষ্য বহন করছে জমিদারি আমলের। এ বাড়িটির নির্মাণকাল গোপীনাথ মন্দির নির্মাণেরও অনেক আগে। সুপ্রশস্ত বেদি। প্রবেশপথে অনেকগুলো ধাপ। প্রবেশদ্বারের দুই প্রান্তে অনেকগুলো অলংকৃত স্তম্ভ। স্তম্ভগুলোর নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত কারুকাজখচিত নকশা। কার্নিশেও বিভিন্ন প্রকারের মোটিভ ব্যবহার করা হয়েছে। তা ভবনটিকে অনেক আকর্ষণীয় করে তুলেছে। চারপাশের স্তম্ভগুলো চতুষ্কোণবিশিষ্ট এবং এতে বর্গাকৃতি ফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে। আস্তরণ ও পলেস্তারা চুন ও সুরকির ব্যবহার লক্ষণীয়। ছাদগুলোতে গতানুগতিকভাবে লোহার রেলিংয়ের সঙ্গে চুন সুরকির ঢালাই।

বারোমারি মিশন ও মরিয়ম নগর গির্জা : এ দুটি স্থাপনা জেলার নানা ধর্মের ঐতিহ্য বহন করে। স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন গির্জাগুলোর নির্মাণে অনেক কলাকৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।

শেরপুর শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যত স্থাপত্য নির্মাণ হয়েছিল, তার বেশির ভাগই নির্মাণ হয়েছিল জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিংবা তাদের প্রয়োজনেই। যেমন বাসভবন, রংমহল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষা ভবনের মধ্যে শেরপুর সরকারি ভিক্টোরিয়া একাডেমি, ১৮৮৭ সালে জমিদার রায় বাহাদুর চারু চন্দ্র চৌধুরী নির্মিত ভবনটি ছিল অনিন্দ্য সুন্দর, যা বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত।

লোকনাথ মন্দির ও রঘুনাথ জিওর মন্দির : এ মন্দিরের প্রতিমাগুলোর একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দর্শনার্থীরা সহজেই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে। দেয়াল, কার্নিশ স্তম্ভগুলো ফুল, লতাপাতার নকশাখচিত নানা রঙে রঞ্জিত করা হয়েছে। এটিও একটি দর্শনীয় প্রাচীন স্থাপত্য।

এ ছাড়া নকলার রুনিগাঁওয়ের অলৌকিক গাজীর দরগাহ, আড়াইআনি জমিদারবাড়ি, কসবা মুঘল মসজিদ, গড়জরিপা কালিদহ গাংয়ের ডিঙি, গড়জরিপা ফোর্ট (১৪৮৬-৯১ খ্রিষ্টাব্দ), জরিপ শাহের মাজার, নয়আনি জমিদারবাড়ি, নয়আনি বাজার নাট মন্দির, নালিতাবাড়ীর বিখ্যাত রাবারড্যাম, পানিহাটা দিগি, মঠ লস্কর বারী মসজিদ (১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দ), নকলার বিবিরচর এলাকার নয়াবাড়ি মুন্সি দাদার মাজার, শাহ কামালের মাজার (১৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ), শের আলী গাজীর মাজারসহ আরও উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থাপনা রয়েছে এ জেলায়।

এছাড়াও নকলার নারায়নখোলায় রয়েছে হাজার বয়সী বৃহৎ বটবৃক্ষ। এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা বটবৃক্ষটি দেখার জন্য বেড়াতে আসেন। বটবৃক্ষের হাজারো পাখির কলরবে দর্শনার্থীদের মন কাড়ে।

শেরপুরের জেলা প্রশাসন উপপরিচালক এটিএম জিয়াউল হক বলেন, শেরপুর জেলাকে পর্যটকদের আকর্ষণীয় করার জন্য ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে শেরপুর জেলার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মহীন মানুষের জন্য বিভিন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যে শেরপুর জেলার ব্র্যান্ডিং হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা হয়েছে ‘তুলশীমালার সুগন্ধে, পর্যটকদের আনন্দে’।

শেরপুর জেলা প্রশাসনের তথ্য বাতায়ন থেকেও অনলাইনের মাধ্যমে শেরপুরের আকর্ষণীয় স্থানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।

বাসস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × 1 =