শেয়ানে শেয়ানে যুদ্ধ শেষে জয়ী হলো অস্ট্রেলিয়া

সালেক সুফী 

বিশ্ব ক্রিকেট রঙ্গমঞ্চে স্মরণীয় ক্রিকেটের মঞ্চায়ন শেষে জয় পরাজয় নির্ধারিত হলো।  এবারের অ্যাসেজ মহাসমরে এজজবাস্টন টেস্টে আরো একটি তুমুল লড়াই শেষে জয়ী হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।  কাল ক্রিকেট তীর্থ লর্ডস ময়দানে শেষ দিনের শুরুতে ইংলান্ড ৬ উইকেট হাতে নিয়ে ২৫৭ রানে পিছিয়ে থাকায় ফলাফল অনেকটাই নির্ধারিত ছিল। কিন্তু বিশ্বক্রিকেটের সনাতন এবং বনেদি প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউকে কখনো বিনাযুদ্ধে এক ইঞ্চি ছাড় দেয় না। বাস্তবেও হলো তাই।

নিউ জিল্যান্ডে জন্মগ্রহণ কারী ইংরেজ সেনাপতি বেন স্টোকস খেললো অতিমানবীয় মহাকাব্যিক ১৫৫ রানের মারকুটে ইনিংস। ২১৪ বলে ৯টি করে চার এবং ছয়ে সাজানো পুষ্পিত, পল্লবিত ইনিংসটি জাগিয়ে তুলেছিল ঘুমন্ত ইংলিশ সিংহকে। কিন্তু জয়ের নেশায় মত্ত সারাক্ষণ দ্রুত এবং পাঁজর বরাবর বোলিং করতে থাকা অস্ট্রেলিয়ানদের সাঁড়াশি আক্রমণের মোকাবিলায় স্টোকসের উইকেট পতনের পর সাঙ্গ হলো যুদ্ধ।  যবনিকা পড়লো ক্রিকেট রঙ্গমঞ্চে নাটকের।

৪৩ রানে জয়ী অস্ট্রেলিয়া ২-০ এগিয়ে রইলো ৫ টেস্টের অ্যাসেজ সিরিজে। ব্যাবধান বিস্তর।  কিন্তু ইতিহাস হয়তো স্মরণে রাখবে এই টেস্টে প্রতিকূল অবস্থায় ইংরেজ সেনাপতির লড়াকু ইনিংসটির কথাও।  রমণীয় ক্রিকেট লাস্যময়ী রূপেই আবির্ভুত হয়েছিল শেষ দিন।  হলপ করে বলতে পারি  বিশ্ব জোড়া ক্রিকেট আমাদের টেস্ট ম্যাচটির শেষ দিন শ্বাসরুদ্ধ উত্তেজনায় উপভোগ করেছে।

প্রথম টেস্ট হেরে কিন্তু ইংল্যান্ড ঘুরে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় বলীয়ান হয়ে এসেছিলো। স্টোকস-মাকুলাম সূচিত বাজ বল  কৌশল নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। লর্ডসে টস জিতে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল স্বাগতিক দল। মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে কোনঠাসা করার সুযোগ ছিল। কিন্তু কৃতকল্প অস্ট্রেলিয়া সময়ের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান স্টিভ স্মিথ (১১০) এবং সাথী ট্রাভিস হেড (৭৭), ডেভিড ওয়ার্নার (৬৬), মারনাস লেবুসাং (৪৭) পুঁজি করে ৪১৬ রান করে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে।

বলতেই হবে উইকেট অনুযায়ী বোলিং করেনি ইংল্যান্ড। তবুও দ্বিতীয় দিন শেষে ২৭৮/৪ করে ইংল্যান্ড যুদ্ধ ময়দানে লড়াইরত ছিল। কৌশল পাল্টে তৃতীয় দিন অস্ট্রেলিয়া পাঁজর বরাবর শর্ট বোলিং করার কৌশল নিয়ে ৩২৫ রানেই গুটিয়ে দিয়েছিলো ইংল্যান্ড ইনিংস। ৯১ রানের পর্যাপ্ত লিড ম্যাচ জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বলতেই হবে। দ্বিতীয় ইনিসেংও অস্ট্রেলিয়া মরিয়া হয়ে থাকা ইংলিশ আক্রমণের মুখে ২৭৯ রান করে ৩৭১ রানের টার্গেট ছুড়ে দেয়। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় ফিল্ডিং করার সময় পায়ের মাংসপেশিতে আঘাত পাওয়া এই টেস্টে ক্রমাগত ১০০ টেস্ট খেলার মাইলফলক স্থাপনকারী একমাত্র বলার নাথান লায়নের ব্যাট হাতে দাঁড়ানোর সাহসী ভূমিকাকে।

পর্যাপ্ত সময় ছিল। উইকেট তখন নিষ্প্রাণ ব্যাটিং সহায়ক। ইংল্যান্ডের মারকুটে কৌশলের মোকাবেলায় অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আক্রমণ নতুন বলের ফায়েদা তুলে নিয়ে চতুর্থ দিনে ১১৪ রানেই প্রথম দিকের চারটি উইকেট তুলে নিয়েছিল। জিততে হলে শেষ দিনে ৬ উইকেট হাতে নিয়ে করতে হবে ২৫৭ রান। উইকেটে ছিল অধিনায়ক বেন স্টোকস, সঙ্গী দুবার জীবন পেয়েও টিকে থাকা বেন ডাকেট। এমন অবস্থায় অনেক দল হাল ছেড়ে দেয়।

ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া অ্যাসেজ মহাযুদ্ধে কোনো দল বিনা যুদ্ধে হার মানে না। সবাই জানে যুদ্ধে আর প্রেমে কোনো কিছুই ভালো মন্দ নেই। বেন ডাকেট ৮৩ রানে ফিরে যাবার পর যেভাবে জনি বেয়ারস্টোকে আউট করা হয়েছে সেটি ব্যাকরণগত ভাবে সঠিক। কিন্তু ক্রিকেট কুলীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে কতটুকু সঠিক সেটি বিতর্কের বিষয়।

১৯৩ রানে ৬ উইকেট হারানো ইংল্যান্ড তখন বেপরোয়া। স্টার্ক, হেজেলউড, কুমিন্স ক্ষুদার্থ বাঘের মতো হামলে পড়ছে অফ স্টাম্পের বাইরে দ্রুত গতির শর্ট বোলিং করে। স্মরণে আসছিলো ডগলাস জার্ডিন এমনি ভাবে হ্যারল্ড লারউডকে দিয়ে বডিলাইন বোলিং কৌশল নিয়েছিল সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানকে নিরস্ত্র করতে।

এই অবস্থায় ইংরেজ দলপতি বেন স্টোকস উপহার দিলো দৃষ্টি নন্দন ১৫৫ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস।  সঙ্গী বোলার স্টুয়ার্ট ব্রডকে নিয়ে ১০৮ রান জুড়ে দিলেন ৭ম উইকেট জুটিতে। বার্মি আর্মি সহ ইংলিশ ক্রিকেট অনুরাগী স্বপ্ন দেখছিলো নাটকীয় জয়ের। কিন্তু যেই না হ্যাজেলউডের বলে ফিরে গেলো স্টোকস, ঝরে পড়লো ইংলিশ ইনিংস।  ৩২৭ রানে সাঙ্গ হলো ইংলিশ প্রতিরোধ। ৪৩ রানে জয়ী অস্ট্রেলিয়া ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেলো অস্ট্রেলিয়া। কঠিন উইকেটে প্রথম ইনিংসে শত রান করায় স্টিভ স্মিত প্লেয়ার অফ দি টেস্ট মনোনীত হয়। যদিও বেন স্টোকসের সঙ্গে যৌথভাবে দেওয়ার সুযোগ ছিল।

খেলায় জয় পরাজয় থাকবেই। আর ঐতিহ্যবাহী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ক্রিকেট তীর্থে অনুষ্ঠিত তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলার আকর্ষণ ভিন্ন মাত্রার। এবারের অ্যাসেজের দুটি টেস্ট ক্রিকেট প্রেমিকদের মন জুড়িয়েছে বলতেই হবে। সবাই মানবেন সাদা বল ক্রিকেটের রমরমা সময়ে এই ঘরনার খেলায় টেস্ট ক্রিকেটকে নব যৌবন দান করবে।

সালেক সুফী: আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 + twenty =