সম্ভ্রান্ত সাহিত্যের অগ্রপথিক মধুসুদন

ইরানী বিশ্বাস

কোলকাতায় তখন রাজাদের রাজত্ব। সিপাহী বিদ্রোহের বছর খানেক পর ১৮৫৮ সালের কথা। পাইকপাড়ার রাজারা নাটক করবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু নাটক বলতে তখন সংস্কৃত ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। কিন্তু রাজারা বাংলা নাটক করবেন বলে স্থির করলেন। সংস্কৃত নাটক ‘রত্মাবলী’ থেকে বাংলায় অনুবাদ করলেন এক পণ্ডিত। সকলে ওটাই নির্বাচন করলেন। শুরু করলেন নাটকের পাত্র-পাত্রী নির্বাচন। যথাসময়ে মহড়া শুরু হয়ে গেল। এরই মধ্যে রাজাদের মনে হলো নাটক দেখতে ইংরেজ সাহেবদের আমন্ত্রণ জানাবেন। মুশকিল হলো সাহেবরা তো আর বাংলা বোঝেন না। কোলকাতার রাজারা তো ইংরেজ সাহেবদের আমন্ত্রণ জানাবেন তাদের খুশি করার জন্য। যদি নাটক না বুঝতে পারে, তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত হলো নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করা হবে। যাকে তাকে দিয়ে এ কাজ হবে না ভেবে তখনকার সময়ে ভালো ইংরেজি জানা গৌরদাস বসাকের শরণাপন্ন হলেন। গৌরদাস বসাক বললেন, এই অনুবাদ করতে পারবেন একজনই, তিনি আমার এক বন্ধু নাম মাইকেল মধুসুদন দত্ত। উপস্থিত সকলে সেদিন চমকে উঠেছিলেন। যথাসময়ে তাকে ডেকে আনা হলো।

মাইকেল মধুসুদন দত্ত। এক সম্ভ্রান্ত ঘরের রাজকুমার। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে জন্ম নেন। বাবা রাজনারায়ন দত্ত ও তার প্রথমা স্ত্রী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। যৌবনে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে মাইকেল মধুসুদন নাম ধারন করেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণবশত ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন।

নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। রামায়ন তর্কালঙ্কার বিরচিত সংস্কৃত নাটক ‘রত্মাবলী’ ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের লক্ষ্যেই তিনি নাটক লিখতে আগ্রহী হয়েছিলেন। ১৮৫৯ সালে তিনি রচনা করেন বাংলা নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। এটি বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক নাটক।

তিনি হিন্দু কলেজে গৌর দাসের সঙ্গে পড়তেন। মাদ্রাজ থেকে বছর দেড়েক হলো কোলকাতায় ফিরেছেন। কলকাতা পুলিশ কোর্টে দোভাষির কাজ করতেন। এ সময়ই তিনি নিজেকে অনুবাদক হিসেবে তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তার মন পড়ে আছে সাহিত্য চর্চায়। তবে মনে দোটানা ছিল। একদিকে ইংরেজিতে লেখার ইচ্ছা। অন্য দিকে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চার লোভ সামলাতে পারছেন না। মাদ্রাজ থেকে ফিরে সাহিত্য চর্চায় ভাটা পড়েছে। এরমধ্যে আবার পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা। তাছাড়া মনের মতো কাজও পাচ্ছিলেন না।

কিশোরী চাঁদের বাগানবাড়িতে মাঝে মধ্যেই মধুসুদন দত্তের দাওয়াত পড়ে। সেখানে সকলের সঙ্গে সাহিত্য বিষয়ে আলাপ হয়। কিশোরী চাঁদের ভাই প্যারীচাঁদ মিত্র তখন টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে লিখতেন। তিনি ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামে বাংলা সাহিত্যে প্রথম উপন্যাস লিখেছেন। অনেক আগ্রহ নিয়ে মাইকেল এই উপন্যাসটি পড়লেন। কিন্তু উপন্যাসটি তার পছন্দ হয়নি। তিনি একটু গুরুগম্ভীর ভাষা পছন্দ করেন। এ কথা জানতে পেরে প্যারীচাঁদ এতটা পাত্তা দিলেন না। এক আড্ডায় এ বিষয়ে কথা বলতেই মাইকেলকে ধমকের সুরে প্যারীচাঁদ একদিন বললেন, তুমি বাংলা সাহিত্যের কি বোঝ! মাইকেলেও কম যান না, তিনি মুখের ওপর বললেন, আপনি মেছোদের ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। দেখবেন আমি যে ভাষা তৈরি করবো তা হবে চিরস্থায়ী। উপস্থিত সবাই সেদিন উচ্চস্বরে হেসে উঠেছিলেন।

এরই মধ্যে কোলকাতায় মধুর ইংরেজি অনুবাদের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হয় একটি ইংরেজি কবিতার বই। এই বইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করতে থাকে সবাই। কাজেই ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রে তখন কার কলকাতায় তার থেকে আর যোগ্য লোক কোথায়! এদিকে মধুরও টাকা দরকার, তিনি রাজি হয়ে গেলেন ‘রত্মাবলী’ অনুবাদ করতে।

অনুবাদ করার জন্য রাজি হওয়ার পর তিনি একদিন গেলেন নাটকের মহড়ায়। নাটক দেখার পর ফিসফিস করে বন্ধু গৌরিদাসের কানে কানে বলেন, এই নাটক! তার জন্য আবার এত পয়সার শ্রাদ্ধ করছেন? গৌরিদাস মধুর কথা শুনে বললেন, কী আর করা যাবে। ভালো নাটক  আর কোথায় পাওয়া যাবে।  মধু তখন বললেন, আমাকে আগে বললে, আমিই লিখে দিতাম। এ কথা শুনে গৌরদাস তো হেসে উঠলেন। মাইকেল মধুসুধনের স্বভাবই এমন। তিনি হচ্ছেন বিলেতি। ঘরে রয়েছে বিলেতি মেমসাহেব। সবসময় স্যুট-বুট-টাই পরেন। বাংলা লেখা তো দূরের কথা, বাংলাভাষায় কথাই তেমন বলতে চান না। অথচ তিনি নাকি বাংলা নাটক লিখবেন। একবার এক আড্ডায় বন্ধুর সাথে তর্কজুড়ে ছিলেন। তিনি বলছেন পৃথিবী লিখতে নাকি প্র-থি-বী হবে।

বন্ধু গৌরদাসের সঙ্গে যখন কলেজে পড়েন তখন মধুসুদন একটা বাংলা কবিতা লিখেছিলেন। ‘গৌরদাসের গভীর গর্জন/ সদা করে জলধর/ উথলিল নদনদী ধরণী উপর’। সবাই খুব প্রশংসা করেছিলেন। অল্প বয়স থেকে মাইকেলের ঝোঁক ছিল ইংরেজিতে লেখার প্রতি। তখন থেকেই তিনি ইংরেজিতে কবিতা লিখতে আরম্ভ করেন।  তখনকার পত্র-পত্রিকায় ছাপা হতো নিয়মিত। তবে গৌরদাস জানতো মাইকেল প্রতিভাবান। সেই বিশ্বাসেই তাকে রত্মাবলী নাটকের অনুবাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

পরদিন সকালে গৌরদাসের কাছে এসে হাজির মাইকেল। তিনি কয়েকটি সংস্কৃত আর বাংলায় লেখা বই নিয়ে চলে গেলেন। কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলো। ততদিনে সকলে ভুলে গেছে পাইকপাড়ার রাজাদের সঙ্গে কি কথা হয়েছে। তারপর একদিন এসে একটি খাতা রাখলেন গৌরদাসের সামনে। একটু অবাক হয়ে পাতা উল্টিয়ে দেখলেন স্পষ্ট বাংলা হরফে লেখা ‘শর্মিষ্ঠা’। শুরুতে এক দৈত্যের কথা দিয়ে শুরু। গৌরদাস তো অবাক। মধু নাটক লিখেছে! আনন্দে তখনই তিনি পাইকপাড়ার রাজাদের খবর দিলেন। তারপর সবাই মিলে নাটক পড়লেন। সকলের মধ্যেই একটা উচ্ছাস।

যথাসময়ে নাটক মঞ্চস্থ হলো। শর্মিষ্ঠা নাটকটি আবার বই আকারে প্রকাশ পেল। সেখানে তিনি ভূমিকা লিখলেন পদ্যে। এই ভূমিকার মাধ্যমে তার সমালোচক বন্ধুদের দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, শুধু নাটক নয়, বাংলা পদ্যেও তার লেখার হাত রয়েছে। তিনি লিখলেন,

শোন গো ভারতভূমি, কতো নিদ্রা যাবে তুমি

আর নিদ্রা উচিত না হয়।

উঠ ত্যাজ ঘুম ঘোর, হইল হইল ভোর

দিনকর প্রাচীতে উদয়।

মাইকেলের লেখা শর্মিষ্ঠা নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পর সকলে বুঝতে পারলেন, তার শক্তি কোথায়। সেই ধারাবাহিকতায় মাইকেল স্থির করে নিলেন, বাংলাই হচ্ছে তার আসল উৎস। তার মনের মধ্যে আর কোনো দ্বিধা নেই। এরপর বাংলা সাহিত্যে যা ঘটেছে তা রীতিমতো একটি সাইক্লোন। এ ঘটনার মাত্র চার বছরের মধ্যে মাইকেল বাংলা সাহিত্যকে ওলট-পালট করে দিলেন। বদলে গেলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। তিনি সৃষ্টি করলে নতুন নাটক, নতুন কবিতা, নতুন ছন্দ, তিনি বিশ্বকে নতুন করে দেখার রাস্তা তৈরি করে দিলেন বাঙালিদের। বাঙালি পেল এক সম্ভ্রান্ত সাহিত্য ভান্ডার।

লেখাটির পিডিএফে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × 5 =