সর্বজনীন পেনশন

ড.শাহাদাৎ হোসাইন সিদ্দিকী: পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর থেকে পুরো জাতি ছিল দিগভ্রান্ত। জাতির সামনে ছিল না কোন আশা আকাঙ্খা  ও স্বপ্ন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে বাঙালি জাতির জন্য সম্ভাবনার এক স্বর্ণদুয়ার উন্মোচন করে ‘দিন বদলের সনদ ‘ নির্বাচনি ইশতেহারে দুই- তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে  দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন। এর মাধ্যমে পুরো জাতিকে তিনি  ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর সরকার ‘ রূপকল্প -২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জনগণকে সাথে নিয়ে বাস্তবায়ন শুরু করেন।’ দিন বদলের সনদের ‘ মূল বিষয় ছিলো ক্ষুধা দারিদ্র্য মুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা যার ভিত্তি হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ। এই ‘দিন বদলের  সনদেই ‘ সর্বজনীন পেনশনের বিষয়টি সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ,  মৌলিক প্রয়োজনে ব্যবস্হা এর ( ঘ) “সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা  বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্য জনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যলাভের অধিকার। “- কে বিবেচনায় নিয়ে বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সর্বজনীন পেনশনের বিষয়টি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তখন থেকেই বিষয়টি আলোচনায় ছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে সরকার কর্তৃক প্রণীত জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রে একটি ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক পেনশন ব্যবস্হা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছিল।

২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেট বক্তৃতায়  অর্থমন্ত্রী সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের শ্রম বাজারের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। ২০০০ সালে দেশের মোট শ্রমশক্তির সংখ্যা ছিলো ৪ কোটি ৭ লাখ, জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ মোতাবেক বর্তমানে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়স্ক মোটসংখ্যা শতকরা ৬২.১৪ শতাংশ অর্থাৎ  সোয়া দশ কোটিরও বেশি। দেশে ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা এক কোটিরও বেশি যা  ২০৪১ সালে  ৩.১ কোটি এবং ২০৬১ সালে ৫.৫৭ কোটিতে দাঁড়াবে। বর্তমানে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭৩ বছর যা ২০৫০ সালে ৭৯.৯ বছর এবং ২০৭৫ সালে ৮৪.৩ বছর হবে। আগামী তিন দশকে মানুষের অবসর গ্রহণের পরও গড়ে ২০ বছরের বেশি আয়ু থাকবে। বর্তমানে নির্ভরশীলতার হার ৭.৭ শতাংশ, ২০৫০ সালে ২৪ শতাংশ এবং ২০৭৫ সালে ৪৮ শতাংশে উন্নীত হবে।

বর্তমানে প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি, এ সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক নিরাপত্তা না থাকায় বৃদ্ধকালে তাদের জীবনযাপনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। প্রত্যাশিত গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ধীরে ধীরে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।আমাদের দেশে পরিবারের মাধ্যমে বয়স্ক লোকের জন্য গ্রামে যে সুরক্ষাসহ নিরাপত্তাবলয় ছিলো তা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এতে বয়োবৃদ্ধদের নিরাপত্তা দিন দিন হুমকির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের দেশে বর্তমানে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর তুলনায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক বেশি বিধায় একটি সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালু করাটা এখন সময়ের দাবি।

সরকার সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্হাপনা আইন,২০২২ ইতিমধ্যে মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছে। প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে আইনটি পাশ হবে এমনটা দেশের মানুষের প্রত্যাশা। প্রস্তাবিত সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্হার উল্লেখযোগ্য ২১ দিক হলো: (১)১৮-৫০ বছর বয়সী সব কর্মক্ষম নাগরিক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্হায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। (২) বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীগণও এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। (৩) সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের আপাতত নতুন জাতীয় পেনশন ব্যবস্হার বাইরে রাখা হচ্ছে। ভবিষ্যতে তাদের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। (৪). জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে দেশের ১৮ থেকে ৫০ বসর বয়সী সব নাগরিক পেনশন হিসাব খুলতে পারবেন। (৫). প্রাথমিকভাবে এ পদ্ধতি স্বেচ্ছাধীন থাকবে,যা পরবর্তী সময়ে বাধ্যতামূলক করা হবে। (৬).ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়া সাপেক্ষে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্য হবেন। (৭). প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে, ফলে চাকরি পরিবর্তন করলেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। (৮). সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। তবে এক্ষেত্রে কর্মী বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দিবে। (৯) মাসিক সর্বনিম্ন চাঁদার নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসী কর্মীরা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা জমা দিতে পারবেন। (১০) সুবিধাভোগীরা বছরে নূন্যতম বার্ষিক জমা নিশ্চিত করবেন। অন্যথায় তার হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যাবে এবং পরবর্তী সময়ে বিলম্ব ফি সহ বকেয়া চাঁদা দেওয়ার মাধ্যমে হিসাব সচল করতে হবে। (১১). সুবিধাভোগীরা আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে চাঁদা হিসাবে বাড়তি অর্থ ( সর্বনিম্ন ধাপের অতিরিক্ত কোন অঙ্ক) জমা দিতে পারবেন। (১২). পেনশনের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা অর্থাৎ ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিত হারে পেনশন দেওয়া হবে। (১৩). পেনশনধারীরা আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। (১৪). নিবন্ধিত চাঁদা জমাকারী পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে জমাকারীর নমিনি বাকী সময়কালের( মূল জমাকারীর বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত)  মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। (১৫). পেনশন কর্মসূচিতে জমা করা অর্থ কোন পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে যা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। (১৬). কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে নিবন্ধিত চাঁদা দানকারী মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তাঁর নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। (১৭). পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে। (১৮). এ ব্যবস্হা স্হানান্তরযোগ্য ও সহজযোগ্য অর্থাৎ কর্মীর চাকরি পরিবর্তন বা স্হান পরিবর্তন করলেও তার অবসর হিসেবে স্থিতি চাঁদা প্রদান ও অবসর সুবিধা অব্যহত থাকবে। (১৯). নিন্ম আয়সীমার নিচে নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন কর্মসূচিতে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে।(২০). পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে। (২১). পেনশন কর্তৃপক্ষ তহবিলে জমা টাকা নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে ( সর্বোচ্চ রিটার্ন নিশ্চিত করণে)।

পেনশনভোগীদের স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে। পেনশনের উপর বার্ষিক ইনক্রিমেন্টেরও ব্যবস্হা থাকবে। বিশ্বজুড়ে  সাধারণত চার ধরনের পেনশন সুবিধা চালু আছে। এগুলো হলো আনফান্ডেড,ফান্ডেড,ডিফাইন্ড বেনিফিটস(ডিবি), ডিফাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস( ডিসি)। আনফান্ডেড পেনশনে কোন কর্মীকে চাঁদা দিতে হয় না। ফান্ডেড পেনশনে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান বা উভয়কে চাঁদা দিতে হয়। ডিবি পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ সরকারি কর্মচারীদের জন্য। আর   ডিসি পদ্ধতিতে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি তহবিলে অর্থ জমা হয় এবং সেখান থেকেই পেনশন দেওয়া হয়। ভারতে ২০০৪ সাল থেকে জাতীয় পেনশন ব্যবস্হা চালু হয়েছে। চীনে তিন ধরনের পেনশন ব্যবস্হা চালু আছে। শহরে কর্মরতদের জন্য আরবান পেনশন সিস্টেম, সরকারি ও আধাসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সিভিল ও পাবলিক সার্ভিস পেনশন সিস্টেম এবং গ্রামের বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিতদের জন্য রুরাল পেনশন সিস্টেম চালু আছে।ব্রিটেনে চার ধরনের পেনশন সুবিধা চালু আছে। এগুলো হলো রাস্ট্রিয়, পেশাগত, ব্যক্তিগত ও আনফান্ডেড। আমেরিকাতে ৯৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী রাস্ট্রিয় ব্যবস্হায় সামাজিক নিরাপত্তা আওতায় পেনশন পেয়ে থাকে। এছাড়াও চাকরি ভিত্তিক,আনফান্ডেড ও ব্যক্তিগত পেনশন ব্যবস্হা চালু আছে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বাজেট থেকে সবাইকে পেনশন দেওয়া হয়। জাপান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে পেনশন ব্যবস্হা চালু আছে।

সরকার বয়স্ক ও দুঃস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন কার্যক্রমের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সামাজিক সুরক্ষাকল্পে প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ সুবিধাভোগীকে সহায়তা প্রদান করছে। শুধুমাত্র বয়স্ক ভাতা হিসেবে ৫৭ লাখেরও বেশি উপকারভোগীকে মাসিক ৫ শত টাকা হারে প্রদান করা হচ্ছে। তবে এটা ঠিক এভাতা বয়স্কদের জন্য যথেষ্ট নয়। সার্বজনীন পেনশন চালু হলে এ সমস্যার সমাধান অনেকাংশে হয়ে যাবে। সার্বজনীন পেনশন  একটি কল্যাণকর রাস্ট্রের  চমৎকার উদ্যোগ। জাতীর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উপহার সার্বজনীন পেনশন।

লেখক: অর্থনীতিবিদ

পিআইডি ফিচার

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three + 14 =