মাহবুব আলম
ম্যাজিক দেখতে কার না ভালো লাগে। ছেলে বুড়ো সব বয়সের মানুষই ম্যাজিক দেখে আনন্দ পায়। শুধু ম্যাজিক নয় ম্যাজিশিয়ানকে দেখেও আনন্দ উপভোগ করে। যখন ইয়া বড় আলখাল্লা আর পাগড়ি পরে ম্যাজিশিয়ান মঞ্চে হাজির হন তখন হল ভর্তি মানুষ করতালিতে ফেটে পড়ে। তারপর শুরু হয় ম্যাজিক দেখানোর পালা। শুরুতে সাধারণত হালকা কিছু ম্যাজিক দেখান ম্যাজিশিয়ান। তারপর ধীরে ধীরে একের পর এক কঠিন ম্যাজিক শুরু হয়।
হালকা ও চমৎকার ম্যাজিক হচ্ছে একটা ডিম থেকে শত শত ডিম, পকেট থেকে রুমাল বের করে সেই রুমাল হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আকাশে ছুড়ে দিতেই রুমাল থেকে বেরিয়ে আসে একেবারে জ্যান্ত কবুতর। তারপর এক কবুতর থেকে অনেক কবুতর। এই দেখে শিশু-কিশোররা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। তারপর যখন ওই শিশুদের দু একজনকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে ম্যাজিশিয়ান বলেন, এবার তোমাদের রসগোল্লা খাওয়াবো। যেই কথা সেই কাজ। ম্যাজিসিয়ান দুহাত প্রসারিত করে মুষ্টিবদ্ধ করতেই তার হাতে দেখা যায় রসগোল্লা। এই রসগোল্লা আবার শিশুদের খাওয়ানো। ম্যাজিকের রসগোল্লা হলে কি হবে। যথেষ্ট সুস্বাদু। এটা খেয়ে কিন্তু শিশুরা বেশ মজা পায়।
ম্যাজিক করে মিষ্টি খাওয়ানোর কথা বলতেই টাঙ্গাইলের একটা গল্পের কথা মনে পড়ল। ষাটের দশকে টাঙ্গাইল শহরে একজন নামকরা উকিলের বাড়িতে যাদু ফকির বলে একজন থাকতো। আসাম থেকে আসা এ জাদু ফকির অন্ধকার ঘরে মন্ত্র পড়ে থালা ভর্তি মিঠাই মণ্ডা সন্দেশ, এমন কি বিরিয়ানি পোলাও কোরমা আনতে পারত। জাদু ফকিরের এই তেলেসমাতি ও কেরামতির কথা কিছুদিনের মধ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি এসডিও, ভিডিও থেকে শহরে বড় বড় সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে এই খবর পৌঁছে যায়। তারপর তারা এর সত্য মিথ্যা যাচাই করতে জাদু ফকিরের কাছে হাজির হয়। তারা জাদু ফকিরকে বলেন, আমাদেরকে দিল্লির লাড্ডু খাওয়াতে পারবে? আর সেইসঙ্গে যদি পারো স্পেশাল কচুরি ও খাঁটি ছানার সন্দেশ, তাহলে খুব খুশি হব।
যথারীতি ‘জ্বি, নিশ্চয়ই পারব’ বলে যাদু ফকির বাড়ির ভেতরে একটা খালি ঘরে ঢুকে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে থালা ভর্তি সন্দেশ কচুরি ও দিল্লির লাড্ডু নিয়ে হাজির হন। এই অবাক ও অলৌকিক কাণ্ড দেকে হতবাক বিস্মিত কর্মকর্তারা ওগুলো খাবেন কি না এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন। শেষ পর্যন্ত খেয়ে দেখে মহা খুশি হন। তাদের ভাষায় তারা তাদের জীবনে এমন সুস্বাদু খাবার কখনোই খাননি।
ম্যাজিকের খাবার সুস্বাদু তো হবেই। ম্যাজিশিয়ানরা শুধু খাবার নয় আরো অনেক কিছু করতে পারেন। এমনকি মঞ্চে হাজার হাজার দর্শকের সামনে একজন নারীকে করাত দিয়ে কেটে দুই টুকরো করে আবার তা জোড়া লাগিয়ে দিতে পারেন।
জাদু সম্রাট পিসি সরকার লন্ডনে এই জাদু দেখাতে গিয়ে রীতিমতো লন্ডনবাসির রাতের ঘুম হারাম করে দেন।
সময়টা ১৯৫৬ সালের ৯ এপ্রিল; হঠাৎ শত শত দর্শকের টেলিফোনে বিবিসির সুইচ বোর্ড কেঁপে উঠেছিল।
যুক্তরাজ্যের টেলিভিশন দর্শকদের ধারণা, তারা পর্দায় ভয়াবহ খুনের ঘটনা সরাসরি দেখছেন; তাই আতঙ্কিত হয়েই তারা টেলিফোন করেছিলেন বিবিসিতে।
দর্শকরা দেখেছিলেন, টেবিলে রাখা হয়েছে ১৭ বছর বয়সি এক তরুণিকে। তারপর কসাইখানায় যেভাবে মাংস কাটা হয়, ঠিক সেভাবে তরুণির শরীর ধারালো ব্লেড দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে মাংস কাটছেন এক রহস্যময় জাদুকর।
জাদুর এক পর্যায়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, দর্শকরা ভেবেছিলেন ওই তরুণি খুন হয়েছেন। কারণ জাদুকর এবং তার সহকারী ওই তরুণিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তরুণির শরীর দ্বিখণ্ডিত রেখেই জাদুকর তার মুখ এবং মাথা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। ঠিক সে সময়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
শ্বাসরুদ্ধকর সেই জাদু দেখিয়েছিলেন ভারতের জাদু সম্রাট পিসি সরকার। পশ্চিমাদের কাছে সেই অনুষ্ঠান পিসি সরকারের জন্য একটা অভ্যুত্থান হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিল। কারণ সেই সময় লন্ডনের ডিউক অব ইয়র্ক থিয়েটার তিন সপ্তাহের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছিল, শুধু পিসি সরকারের জাদু দেখানোর জন্য।
প্রথমে দর্শক পেতে পিসি সরকারকে বেশ বেগ পেতে হলেও তরুণির জাদু দেখিয়ে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কিন্তু টেলিভিশনে তরুণির জাদু দেখানোর মাঝপথেই অনুষ্ঠান শেষ করার ঘোষণার বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা দেয়, পিসির জন্য বরাদ্দ করা বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি জাদু শেষ করতে পারেননি।
ঘটনার পরদিন লন্ডনের সংবাদপত্রে প্রথম পাতায় খবর হয়েছিল যে, টিভি পর্দায় মর্মাহত করার মতো একজন তরুণিকে দ্বিখণ্ডিত করার ঘটনা দেখানো হয়েছে। পর দিনই পিসির জাদু দেখানোর জন্য ভাড়া নেওয়া হলের তিন সপ্তাহের টিকেট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
১৯৩৭ সালে কলকাতার ইজেরিয়াল রেস্টুরেন্টে একবার জাদু প্রদর্শনীর সময় পিসি সরকার দেখলেন মঞ্চে সম্মুক্ষ সারিতে বসে আছেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক ও তার মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্য। এটা দেখে তিনি মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে একটি সাদা কাগজে কিছু লিখতে বললেন। এবং তার নিচে মন্ত্রীদের স্বাক্ষর করার অনুরোধ করলেন। তারপর তিনি সেই কাগজ নিয়ে মঞ্চে উঠে সকলকে সেই সই করার কাগজ দেখালেন। তারপর তা মুড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন দয়া করে পড়ুন কাগজে কি লেখা আছে। মুখ্যমন্ত্রী পড়লেন, আমরা সম্মতিক্রমে সকলেই এই মুহূর্তে মন্ত্রীর পদত্যাগ করলাম। এবং আজ হতে জাদুর পিসি সরকার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
এছাড়া তার আর একটা প্রিয় জাদু ছিল সাদা কাগজ মুড়িয়ে তাকে ডলার অথবা রুপি করে দেওয়া। আমাদের দেশে সেরা জাদু শিল্পী জুয়েল আইচের এটা একটা প্রিয় জাদু। এই জাদুর মঞ্চে দর্শকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি চিনি ও জানি। দেশে-বিদেশে জাদু প্রদর্শন করে তিনি অনেক খ্যাতি অর্জন করেছেন। দেশে সম্মানিত হয়েছেন। একুশে পদক পেয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে কোনো ধনী ব্যক্তি নন। ওই যে বলেছিলাম মঞ্চে সাদা কাগজকে ডলারের পরিণত করতে পারলেও এটা মঞ্চের বাইরে নয়। কারণ এটা জাদু। জাদু জাদুই।
তবে এক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম আছে। অন্য দেশে থাক বা না থাক আমাদের দেশে এখন অনেক জাদুকর আছেন যারা সত্যিই তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে সাদা কাগজকে ডলার পাউন্ডে পরিণত করতে পারেন। এবং করেছেন। এই অনেকের মধ্যে এক শ্রেণির সাংবাদিকও আছেন। এই সাংবাদিকরা সাদা কাগজকে ডলারে পরিণত করতে পারেন। পারেন ১০০ টাকার এক বান্ডিল বা ১ প্যাকেট টাকাকে ডলার পাউন্ড ইউরোতে পরিণত করতে। শুধু তাই নয়, এরা খেলনা গাড়িতে কালো কাপড় দিয়ে মুড়ে যাদু করে খেলনা গাড়িকে নামিদামি ব্রান্ডের বিলাসবহুল গাড়িতে পরিণত করতে পারেন। যা পরে শোভা পায় তাদের গাড়ি বারান্দায়। এবং সেই গাড়িতে চেপে দাপিয়ে বেড়ান নগরীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
পিসি সরকার যেমন মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক সাহেবের লেখা পরিবর্তন করে নিতে পারতেন ঠিক একইভাবে এই শ্রেণির সাংবাদিকরা মন্ত্রী এমপিদের সুপারিশ বদলে নিজের নামে অথবা পছন্দের ব্যক্তির নামে করতে পারেন। সে দিক দিয়ে দেখলে নিঃসন্দেহে কোনো সাংবাদিক পিসি সরকার, জুয়েল আইচের চাইতেও বড় জাদুকর। তারা এদের চাইতেও বেশি শক্তিশালী জাদু জানেন। তাইতো অনেকে বলেনন অবিশ্বাস্য হলেও সত্য সাংবাদিকরা জাদু জানে।
লেখাটির পিডিএফে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা