সালেক সুফী
তৃতীয় পর্ব
যে কথাটি লিখতে ভুলে গেছি সাম্প্রতিক সময়ে বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বৃহত্তর কক্সবাজারে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটলেও হাতে গোনা কয়েকটি আবাসিক হোটেল ছাড়া আবাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত সাধারণ মানের। আর অনেকটা এই কারণেই ভরা মৌসুমেও কক্সবাজার বা সেন্ট মার্টিন কোথাও বিদেশি পর্যটকদের খুব একটা দেখা মেলেনি। ইচ্ছা ছিল জেলা প্রশাসন, পর্যটন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার। সময়ের অভাবে সম্ভব হয়নি।
কক্সবাজার এবং সেন্ট মার্টিনকে আদর্শ পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে কেবল সুন্দর সুন্দর স্থাপনা গড়ে তোলাই যথেষ্ট নয়। এগুলোর পেশাদারী দক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। আইকনিক রেল স্টেশন পুরোপুরি চালু হবার আগেই এটি পেশাদার দক্ষ ব্যাক্তিখাতের অপেরাটরদের কাছে অর্পণ করা উচিত। কক্সবাজারের আবাসিক হোটেলগুলোর আদর্শ মান নির্ধারণ করে নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন। জনগণের মাঝে পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগের অভাব দেখেছি কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন সর্বত্র।
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
ভাষা শহীদ স্মরণে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিনটি শুরু হলো সেন্ট মার্টিন উপকূলে সূর্যোদয় দেখে। সকালে ফজরের নামাজের আজান শুনতে পাইনি সম্ভবত মসজিদে বিদ্যুৎ না থাকায়, সৌভাগ্য আমার ডিভাইসগুলোর অ্যাপস আমাকে জাগিয়ে দিয়েছিল। ভাষা শহীদদের পবিত্র আত্মার শান্তি কামনা করেছি নামাজ শেষে।
সাগর পাড়ে জেলেদের মাছ ধরে ফিরতে দেখলাম। দেখলাম প্রচুর মাছ পেয়েছে। পাইকারি ক্রেতারা দাম দর করে কিনে নিচ্ছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে কর্মরত কয়েকজন পিএসএল সহকর্মীর সঙ্গে পরিচয় হলো। সাগরকূলে ব্যস্ত দিন শুরু হওয়ার আগেই হোটেলে ফিরলাম। আহত পা চলাচলে বাধা হয়নি প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তির কারণে।
হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিয়ে প্রাতঃরাশ করলাম। ভুনা খিচুড়ির সঙ্গে বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা ছিল খুব সুস্বাধু। তানভীর জানালো সফর সূচিতে আছে বাংলাদেশের শেষ প্রান্ত সীমায় অবস্থিত ছেঁড়া দ্বীপ পরিদর্শন।
সেন্ট মার্টিন শহরতলি থেকে কয়েক কিলোমিটার অনুন্নত সড়ক পেরিয়ে ব্যাটারি চার্জড তিন চাকার বাহনে বেশ কষ্টসাধ্য পথে যেতে হবে। আমার পা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন না হলেও সঙ্গীরা চিন্তায় ছিল। যে বাংলাদেশ গড়ায় সামান্য ভূমিকা ছিল শরীরে এক বিন্দু শক্তি থাকতেও তার শেষ প্রান্তে যাবো না সেটি হতে পারে না।
পা শক্ত ভাবে জড়িয়ে রওয়ানা দিলাম কষ্টসাধ্য পথে। যাত্রাপথে অনেক তরমুজের বাগান, সবজি বাগান চোখে পড়লো, বেশ কিছু রিসোর্ট দেখলাম। জানিনা ছেড়া দ্বীপে পরিদর্শন নিরুৎসাহিত করার কারণে কি না, সড়ক যোগাযোগ খুব নিম্নমানের। এমনকি নেভি, কোস্ট গার্ড দপ্তরের যোগাযোগ ব্যাবস্থাও অনুন্নত।
সাগর পারে পৌঁছে অনেকটা একপায়ে ভর করেই তিনটি বিচ্ছিন্ন ছেড়াদিয়া দ্বীপের প্রথমটিতে পৌঁছে বাংলাদেশ বন এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নোটিশ দেখলাম ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে পরিদর্শন নিষিদ্ধ। অবাক হলাম নোটিশ আছে কিন্তু প্রতিপালন হচ্ছে কি না দেখার কেউ নেই। তিনটি বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট চর নিয়ে সেন্ট মার্টিনের সবচেয়ে দক্ষিণে ছেড়াদিয়া প্রবাল দ্বীপ। হেঁটে হেঁটেই গেলাম দ্বিতীয় বিচ্ছিন্ন চরটিতে।ততক্ষণে সঙ্গীরা সব এসে গেছে।
দেখলাম অযত্ন অবহেলায় এবং অনেক পর্যটকদের ফেলে যাওয়া পলিথিনের কারণে পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক কোরালের মৃত্যু ঘটছে। চর তিনটি ভাটার সময় জেগে ওঠে, জোয়ায়ের সময় উপকূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরিবেশ সংরক্ষণের কোনো প্রচেষ্টাই চোখে পড়লো না। আমি দ্বিতীয় চরটিতে একটি বিশাল আকারের বিরল প্রজাতির কাছিমের মৃতদেহ দেখলাম। সম্ভবত কোনো জাহাজের প্রপেলারে আহত হয়ে উপকূলে আশ্রয় নিয়েছিল। উদ্ধার করে সুশ্রষা করলে বা বাঁচতে পারতো বিরল প্রাণীটি। হয়নি অবহেলায়।
আমি অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড বিচে এই ধরনের আহত সামুদ্রিক প্রাণী উদ্ধার করে সুশ্রষা করে আবার সাগরে অবমুক্ত করতে দেখেছি। যাই হোক পরিশ্রান্ত থাকায় তৃতীয় বিচ্ছিন্ন চরটিতে যাওয়া হলো না। জীবনে এই প্রথম ইচ্ছা শক্তি হেরে গেলো শরীরের অবস্থার কাছে। জোয়ার আসা শুরু। ফিরতে হলো। ফিরতি পথে একজন জেলেকে দেখলাম হাত জাল ছুড়ে আধা জল মগ্ন পাথরের উপরে ছুড়ে মাছ ধরছে। ইচ্ছা হলো জাল ছুড়বো। অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত করেছি।
বসে ছিলাম পাথরের উপরে। কি জানিনা কেন একটি ছোট মাছ লাফিয়ে আমার হাতের মুঠোয় এলো। লোকে বলে আমার মাছের রাশি। অনেক কষ্ট হলো এক পায়ে ভর করে ফিরে আসতে। ভাবলাম সাগর কূলে বসে ডাইক স্থাপন করে ছেড়াদিয়া দ্বীপ বরাবর ল্যান্ড রিক্লেইম করা বাস্তবসম্মত কি না। তবে দ্বীপ অঞ্চলটির পরিবেশ রক্ষায় পরিদর্শন নিয়ন্ত্রণ জরুরি এবং অত্যাবশ্যক মনে করি।
ফিরে আসলাম অতৃপ্ত মন নিয়ে। শেষ প্রান্তে যাওয়ার মতো শারীরিক শক্তি আসলেও ছিল না। ফিরতি পথে নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিভাবে সফরটির অভিজ্ঞতা দেশের কাজে লাগানো যায়। সঙ্গী অনেকেই একমত হলো দ্বীপটি সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরো আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। বিধাতার অফুরন্ত নেয়ামত রক্ষায় অতি সামান্য করা হচ্ছে।
দুপুরে ঘরে ফিরে স্নান এবং উপাদেয় খাবার খেয়ে বিশ্রাম। বিকেলে স্থানীয় বাজারে কেনাকাটার পর বিকেল কাটলো দ্বিতীয় দিনের মতো সেন্ট মার্টিন বিচে সূর্যাস্তের অপরূপ শোভা দেখে। আমার বর্তমান আবাসস্থল প্রখ্যাত গোল্ড কোস্টের খুব কাছে। মাঝে মাঝে যাওয়ার সুযোগ হয়। তথাপি নিজের জন্মভূমি বলে কথা।
এদিন স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কথা হলো। নারিকেল দ্বীপটি বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য মিললো। মূলত মাছ ধরা এবং পর্যটকদের সেবা করা এদের পেশা। লেখাপড়ার সুযোগ সীমিত। সৌর বিদ্যুৎ এবং কয়েকটি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ যন্ত্র দিয়ে মাঝ রাত পর্যন্ত বিদ্যুৎ দেওয়া হয়। আধুনিক বাংলাদেশের অনেক সুবিধাই এখানে পৌঁছায়নি।
সন্ধ্যায় একজন স্থানীয় গায়কের পরিবেশনায় গানের সঙ্গে বারবিকিউ আয়োজন ছিল সবাই সেটি উপভোগ করেছে। অনুষ্ঠানে রাফেল ড্র আয়োজন ছিল। গানগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি, উপরে ছিল পূর্ণিমার চাঁদের চাঁদোয়া। আমি ড্রতে ভাগ্যবান ছিলাম।
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
দেখতে দেখতে সেন্ট মার্টিন ছেড়ে যাওয়ার দিন এসে গেলো। সকালে নামাজ শেষে হোটেল রিসেপশনে বসে ছিলাম। দুটো বিড়াল আছে হোটেলে। একটি সাদা আরেকটি কালো, সাদা বিড়ালটি সারা রাত নৈশপ্রহরীর মতো হোটেল পাহারা দিয়ে ক্লান্ত। আমাকে দেখে কি মনে করে কোলে চড়ে বসলো কালো বিড়ালটি। আমার মা বিড়াল পালতেন, আমি আফগানিস্তান থাকার সময় বিড়াল ছিল।
জানিনা কোথাও কেন জানি কিছু জিনিসের মায়ার বাঁধনে বাধা পড়ি। সকালে আবারো সূর্যোদয় দেখলাম। ফিরে আসার পর সব কিছু গুছিয়ে নিলাম। ফিরে যাবো দুপুরে কেয়ারী সিন্দাবাদ যোগে টেকনাফ। সেখান থেকে সড়ক পথে কক্সবাজার। সকালের নাস্তার পর আবারো স্পিড বোট নিয়ে ছেড়া দ্বীপ যাওয়ার চেষ্টা হলো।
বেয়াড়া বোট চালক শেষ অংশে আমাদের নিলো না। ফিরে আসার সময় বোট থেকে নামার সময় কিছুটা আহত হয়েছিলাম। দেখলাম আমার চেয়ে আমার সফর সঙ্গীরা আমাকে নিয়ে বেশি চিন্তিত। তাইতো সবাই জানে ‘ভাইয়ে মায়ে এতো স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ…’।
যাবার সময় ঘনিয়ে আসলো। নির্দিষ্ট সময় কেয়ারী সিন্দাবাদ চড়ে ফিরতি যাত্রা। জীবনে হয়তো আর কোনো দিন সেন্ট মার্টিন যাওয়া হবে না। বালুচরে ঘুড়ি উড়ানো, কালো বিড়ালটির সঙ্গে খুনসুটি, কত মধুর স্মৃতি।
এভাবেই কেটে গেছে একটি প্রাণবন্ত পিএসএল কর্মী গ্রুপের সঙ্গে প্রবাল দ্বীপে স্মরণীয় সময়। মানুষের ব্যাস্ত জীবনে বিনোদনের সুযোগ খুব একটা আসে না। সারা দুনিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো ঘোরার পরে সেন্ট মার্টিন দর্শনের পর মনে হলো ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া…”