সাম্প্রদায়িক ঘৃণা: কুমিল্লা থেকে পঞ্চগড়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: বাংলাদেশে বহুদিন ধরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার নজির আছে। তবে ২০২১ সালে দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন কুমিল্লা শহরের নানুয়া দীঘির পাড় পূজামণ্ডপে যা ঘটেছে তা ছিল একেবারেই অকল্পনীয়। পূজামণ্ডপে এক যুবক পবিত্র কোরআন রেখে গিয়ে অবমাননার গল্প ছড়ায়। এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথমে কুমিল্লা শহরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেয়। এর জের ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালীর চৌমুহনী, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, ফেনী এবং রংপুরের পীরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। মন্দির-মণ্ডপে হামলা, ভাঙচুরের পাশাপাশি আক্রমণের শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। পীরগঞ্জে পুড়িয়ে দেওয়া হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতবাড়ি।
পরের বছর এরকম কিছু না ঘটলেও হিন্দু শিক্ষক, অধ্যক্ষ, হিন্দু নারী আক্রমণের শিকার হয়েছেন। প্রতিমা ভাংচুর তো নিয়মিত কাণ্ডে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে বাংলাদেশে। যারা এর চর্চা করে তারা দুর্গাপূজার সময় দেখিয়েছে, এবার পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করেও দেখিয়েছে। পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জলসাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি যা ঘটেছে, তা এক কথায় উদ্বেগজনক।

কোনো সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় আয়োজনকে কেন্দ্র করে দুজন তরুণের প্রাণহানি, প্রায় দু’শ বাড়িঘর ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে এখন হয়তো স্বাভাবিক বলেই মনে করা হবে। বাংলাদেশে যে শুধুই ধর্মকে কেন্দ্র করে অশান্তির ঘটনা বেড়েছে, তাই নয়; সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ, বিধিনিষেধ আরোপ ও ধর্মকে কেন্দ্র করে সামাজিক অস্থিরতা ঘটানোর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর পরিদর্শন করছিলেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, তিনি সেই জেলারই মানুষ। সোমবার শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর এলাকায় তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের সমবেদনা জানাতে গেলে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন একত্রে চিৎকার করে রেলমন্ত্রীকে বলতে থাকেন, এই এলাকার (শালশিড়ি) বাড়িঘরে যারা হামলা-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা এখনো মন্ত্রীর আশপাশেই আছেন। এই হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচার করা না হলে তারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবেন।

এদেশের সংখ্যালঘুরা আসলে মরে বেঁচে আছে। বেড়েছে ঘৃণাজনিত অপরাধের ঘটনা, সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক উগ্রতা, ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাস। বেড়েছে ধর্মাচরণে বাধা দেওয়ার ঘটনা। তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে পোশাক না পরায় নানাভাবে নারীদের হেনস্থা করার ঘটনাও।
বাংলাদেশে যারা রাজনৈতিক ইসলাম চর্চা করে তারা আহমদিয়াদের মুসলমান হিসেবে স্বীকার করে না। এটি ধর্মীয় বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। এ নিয়ে বিতর্ক নিশ্চয়ই আছে এবং থাকতে পারে। কিন্তু কোনো সম্প্রদায়কে জলসা করতে না দেওয়া কিংবা বাড়িঘরে হামলা চালানোর মতো অপরাধ করে যখন সফল হওয়া যায় তখন সমাজে ধর্মীয় বিভেদের ছবিটা আরও স্পষ্ট হয়।

হামলাকারীরা যে দলেরই হোক না কেন সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, এটা হলো স্বাভাবিক চাওয়া। কিন্তু তদন্তের আগেই যদি অপরাধী চিহ্নিত করা হয় রাজনৈতিক জায়গা থেকে, তাহলে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে, যেমন আগের সব ঘটনায় থেকেছে।
প্রশাসনিক ব্যর্থতা অবশ্যই খুঁজে দেখতে হবে। কিন্তু যে রাজনৈতিক ব্যর্থতায় সহিংস সাম্প্রদায়িক শক্তির এই বাড়বাড়ন্ত সেটা রুখবার রাজনীতি নেই দেশে। এক সময় দেশের প্রগতিশীল বাম রাজনীতি শক্তি যতখানি সংগঠিতভাবে মানুষকে সচেতন ও প্রগতিমুখী করার কাজ করেছিল, সেই শক্তিতে বেশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এমনকি তখন সাধারণ রাজনৈতিক দলগুলোও ছিল অনেক উদার ও অসাম্প্রদায়িক। এখন তাদের রাজনীতি হলো ধর্মীয় কার্ড ব্যবহার করা এবং সহিংস মৌলবাদী গোষ্ঠীর সাথে আপস করে চলা। সেই দুর্বলতারই সুযোগ নিচ্ছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, যাদের মূল দর্শন সহিংসতা ও বিভেদ।

যারা সচেতন, যারা দেশকে নিয়ে ভাবেন, যারা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, যারা ক্ষমতা কাঠামোর ভিতরে বসে হালুয়া রুটির ভাগ বাটোয়ারায় লিপ্ত নন, তারা এই সত্যটা বুঝতে পারছেন। আর পারছেন বলেই বিপন্ন বোধ করছেন। তারা বুঝতে পারছেন, যে শক্তিতে আমরা ১৯৭১-এ ঐক্যের বন্ধন গড়েছিলাম সেই শক্তি আলগা হতে শুরু করেছে এবং সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে। এখানেই আমাদের সমূহ বিপদ।

তাদের নির্দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ্যবই বদলে যায়, তারা যখন যা মন চায় করতে পারে। এরা মাহফিলে, ওয়াজে, সামাজিকমাধ্যমে অশিক্ষা কুশিক্ষা ছড়াচ্ছে দাবানলের মতো। মানুষের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে জাগানোর কাজ করছে এই রাজনৈতিক ইসলাম, যার সঙ্গী হয়েছে একদা যারা উদার ছিলেন তারা। নিজেদের স্বার্থেই জঘন্য কুরুচিকর ভাষায় চলে এদের প্রচার। কে কত বেশি জঘন্য ভাষা ব্যবহার করতে পারে, কে কতটা উত্তেজনা ছড়াতে পারে, কতটা সাম্প্রদায়িকভাবে তাতিয়ে দিতে পারে সাধারণ মানুষকে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। অসহিষ্ণুতা তাদের রাজনীতির পুঁজি। গণতন্ত্রের দেশে মানুষ কী এটাই চায়? নিশ্চয়ই না। অবশ্য সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা কোথাও প্রতিফলিতও হচ্ছে না।

যারা অন্য ধর্মের চর্চায় বাধা দেয়, খুন করে, জ্বালাও পোড়াও করে; তারা শুধু অসহিষ্ণু নয়, তারা বর্বর, ধর্মান্ধ খুনি, অপরাধী। একটা লড়াই চলছে সমাজে, প্রকাশ্য লড়াই। এ লড়াই ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মৌলবাদের মধ্যে শুধু নয়। লড়াইটা বিজ্ঞানমনস্কতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যে, যুক্তিবাদিতা আর কুসংস্কারের মধ্যে, জ্ঞান আর অজ্ঞানতার মধ্যে, সচেতনতা আর অচেতনতার মধ্যে, উদারতা আর পঙ্কিলতার মধ্যে।

সমাজে অশিক্ষা, জড়তা আর মুর্খতা চলবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। শিক্ষা আর সচেতনতার পাশাপাশি ধর্মান্ধ রাজনীতিকে মোকাবেলা করার নীতি না থাকলে সমাজটাকে অন্ধকারেই ফেলে রাখব আমরা। পরিস্থিতি না বদলালে পঞ্চগড় বা কুমিল্লার মতো একটা করে ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিন দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eighteen − 14 =