সীমানার বাইরে চলে গেলেন সীমানা

রোজ অ্যাডেনিয়াম

মায়ের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার সন্তান। সন্তানদের বুকে আগলে নিয়েই পৃথিবীর স্বর্গ তৈরি করেন মা। এমন অনুভূতি থেকেই অভিনেত্রী রিশতা লাবণী সীমানা তার দুই সন্তানের নাম রেখেছিলেন শ্রেষ্ঠ ও স্বর্গ। কিন্তু সন্তানদের ভালোবাসার চাদরে আবৃত হয়ে থাকা হলো না তার। দুই শিশু সন্তানকে রেখেই সম্প্রতি না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি।

কে এই সীমানা

সীমানা ছিলেন দেশের একজন জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেত্রী। তার অভিনীত দর্শকনন্দিত টেলিভিশন নাটকের সংখ্যা কম নয়। অনেকেরই মনে পড়বে জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘সাকিন সারিসুরি’তে তিনি কাকলি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ‘গুলশান এভিনিউ’ নাটকে সামিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। এরপর অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন।

সিনেমা দিয়ে পথচলা শুরু

অনেক বড় একটি আয়োজনের মধ্য দিয়ে মিডিয়ায় পা রেখেছিলেন সীমানা। ২০০৬ সালে লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিনোদন অঙ্গনে কাজ শুরু হয় তার। এরপর তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় ‘দারুচিনি দ্বীপ’ সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পান। ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমায় অভিনয় করে ব্যাপক প্রশংসিত হন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক নাটক ও বিজ্ঞাপনে দেখা মিলেছে তার। সর্বশেষ তিনি বিপ্লব হায়দার পরিচালিত ‘রোশনী’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন।

আলোচিত যতো কাজ

নৃত্য দিয়ে শৈশবে সীমানার পথ চলা শুরু। গুরুজি কমল পালের কাছে দীর্ঘদিন ভরতনাট্যম শিখেছেন সীমানা। ছোটবেলায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন খেলাঘর ও বাফা’র সঙ্গে। সরকারের বৃত্তি নিয়ে ভারত থেকে নাচের কোর্স করে এসেছিলেন। স্ট্যামফোর্ড  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ শেষ করেছিলেন সীমানা। ফেরদৌস হাসান রানার ‘নিলয়’ নাটকের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নাটকে যাত্রা শুরু করেন তিনি। কিন্তু সীমানাকে পরিচিতি এনে দেয় সালাউদ্দিন লাভলুর ‘সাকিন সারিসুরি’ নাটকটি। অভিনয় করেছিলেন তাহের শিপনের ‘সাদা মেঘ কালো মেঘ’ নাটকে। এছাড়া চান্দা মাহজাবিনের ‘ঘরজামাই’, মাসুম আজিজের ‘পিচ্চিহাজুতি’, শিমুল সরকারের ‘মামার হাতের মোয়া’, ‘একি কাণ্ড’। বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েও তাক লাগিয়ে ছিলেন সীমানা। তার উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে আছে প্রাণ লেমন, প্রাণ ডাল, অটবি, গ্রামীণফোন, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি। সীমানার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে আছে অগ্নিপথ, মেঘের খেয়া, পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে, কবিরাজ গোলাপ শাহ, অন্যরকম ঢাকা, বংশাল টু বারিধারা প্রভৃতি।

অভিনয় থেকে বিরতি

সীমানা ২০১৪ সালে সংগীতশিল্পী পারভেজ সাজ্জাদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মাতৃত্বের কারণে ২০১৬ সালে ইন্ডাস্ট্রি থেকে কিছু সময়ের জন্য বিরতি নিয়েছিলেন। তাদের দুই সন্তান আকাইদ সাজ্জাদ শ্রেষ্ঠ ও স্বর্গ। তবে এই দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। সীমানা ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন। বর্তমানে সীমানার বড় সন্তান শ্রেষ্ঠর বয়স আট বছর, আর ছোট সন্তান স্বর্গ তিন বছর বয়সী।

কী হয়েছিল

বেশ কিছুদিন ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন সীমানা। পরিবার জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ২১ মে রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন সীমানা। সেদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাকে দ্রুত ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে জানতে পারেন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। পরদিন আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য সীমানাকে ধানমন্ডির আরেকটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এরপর সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে এই হাসপাতালে তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়। অবস্থার অবনতি হলে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয় তাকে। সীমানার ছোট ভাই এজাজ জানান, অসুস্থতার ৭ম দিনেও জ্ঞান না ফিরলে তাকে প্রথমে আইসিইউতে রাখা হয় পরে  লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। টানা  ১৪ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ৪ জুন সকাল ৬টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সীমানা। তার বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর।

সাংবাদিকদের যা বলেছিল শ্রেষ্ঠ

সীমানার মৃত্যুর পরে শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকদের কাছে তার মাকে নিয়ে তার অনুভূতি প্রকাশ করে। মায়ের মৃত্যু প্রসঙ্গে বড় ছেলে শ্রেষ্ঠ বলে, ওই দিন মা বাথরুম থেকে আসার পরই মা’র হাত পা একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে যাচ্ছিল। সাধারণত এ সমস্যা মায়ের প্রায়ই হতো। হলে হাত-পা ম্যাসাজ করে দিলে ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু ওই দিন আর হয়নি। শ্রেষ্ঠ আরও বলে, মা কথা বুঝতে পারছিল না। বমি করছিল। অটোরিকশা করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা বলেন, ব্রেনের ক্ষতি হয়ে গেছে। মায়ের স্মৃতি মনে করে শ্রেষ্ঠ বলে, মা আমাকে খুব ভালোবাসতো। আমিও মাকে খুব ভালোবাসতাম। আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল আমাকে ক্যাডেটে পড়াবেন। কিন্তু সে ইচ্ছাটা আর মায়ের পূরণ হলো না। আমার জন্য দোয়া করবেন। আমার মায়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন।

তারকাদের শোক

দীর্ঘদিনের সহকর্মীকে হারিয়ে সীমানার সতীর্থরা কান্নায় বুক ভাসিয়েছেন। তার মৃত্যুতে শোবিজেও বিরাজ করে শোকের ছায়া। ফেসবুকে শোক প্রকাশ করছেন তার অনেক সহকর্মীরা।

চঞ্চল চৌধুরী: সীমানার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘সীমানা। জীবনের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গেলি মৃত্যুর সীমানায়! অনন্তলোকে তুই চির শান্তিতে থাকিস। তোর জন্য রইল গভীর শোক। সাকিন সারিসুরি, কলেজ টুডে, কত কত স্মৃতি!’

রুনা খান: শোক জানিয়ে অভিনেত্রী রুনা খান লিখেছেন, ‘২০১২-১৩ তে একটা সিরিজ করতে গিয়ে তোর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। একটামাত্রই কাজ হয়েছিল আমাদের একসঙ্গে। তারপর তোর বিয়ে সন্তানদের জন্ম। আমি নিজে সিরিজে কাজ করা বন্ধই করে দিই প্রায়। যোগাযোগ দেখা কিছুই ছিল না তোর সঙ্গে। ২১-এর ডিসেম্বরে হঠাৎ তোর টেক্সট-কল। আপু আমার ছোট-ভাইয়ের বিয়ে তোমাকে আসতেই হবে! কেন-কী ভেবে অমন পাগল হয়েছিলি ভাইয়ের বিয়েতে আমাকে নেবার জন্য কে জানে। সবগুলো আয়োজনে যেতে না পারলেও, জানুয়ারিতে তোর ভাইয়ের বৌভাতে গিয়েছিলাম। তোর এতো ভালোবাসার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। ২২-এর ২ জানুয়ারি তোকে দেখলাম প্রায় ৯-১০ বছর পর, তোর ছেলে দুটোকে দেখলাম। নিজে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলি আমি খাচ্ছি কি না ঠিক মতন! মাত্র ২ বছর আগে! আমি কি জানতাম ওটাই তোর সঙ্গে আমার শেষ দেখা সেজন্যই কি অমন করে ছোট্ট ছেলেকে কোলে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে শেষবার খাওয়ালি। আমরা কিছুই জানি না – কোনটা শেষ দেখা, শেষ কথা…কিচ্ছু জানি না! সীমানা, তোর আত্মার শান্তি হোক বাবু। আদর।’

গোলাম ফরিদা ছন্দা: ছন্দা লিখেছেন, ‘সীমানা, জীবন বড়ই বিচিত্র কিন্তু মৃত্যু রঙহীন একরকম। তোকে এই পৃথিবীর আর কোনো কিছুই তার সীমানায় আবদ্ধ করতে পারল নারে, সব সীমানা পেরিয়ে তুই পাড়ি দিলি অনন্তলোকের অজানা সীমানায়। ভালো থাকিস বোন, চির শান্তিতে থাকিস। রেখে গেলি বাচ্চা দুটো, ওদেরকে ওপার থেকে দেখে রাখিস।’ অভিনেত্রী বন্যা মির্জা লিখেছেন, ‘চলেই গেলি সীমানা! তুই এত নিশ্চুপ থেকেছিলি সবসময়! চলেও গেলি নীরবে।’

শাহনাজ খুশি: খুশি লিখেছেন, ‘প্রতিদিন সকালে উঠেই, আগে নিউজ স্ক্রল করে দেখি, তোর কোনো ভালো খবর আছে নাকি। আজও তাই করতে যেয়ে, তোর এ খবর পেলাম! তোর সঙ্গেকার সব স্মৃতি দুই চোখে ভিড় করছে, তোর বাচ্চা দুইটা। সব যন্ত্রণার অবসান হলো আজ। শান্তিতে ঘুমা!’ মনিরা মিঠু লিখেছেন, ‘আহারে সীমানা, আহারে নারীর জীবন। বাচ্চা দুটো মা হারা হয়ে সারাজীবন যুদ্ধ করবে।’

সতীর্থ রহমান: সতীর্থ লিখেছেন, ‘সীমানা, বিন্দুমাত্র ভনিতা নেই। সত্যি সত্যিই খুব কষ্ট পাচ্ছি। এবং এর রেশ থেকে যাবে বেশ কিছুদিন। মেনে নেওয়া যায় না। তবুও মেনে নিতে হবে। এ কেমন প্রস্থান! মিডিয়ায় আমাকে স্বার্থহীনভাবে ভালোবাসতো এমন লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম। তারাও ধীরে ধীরে চলে যেতে শুরু করেছে। বুঝলাম যাবার সময় হলো বিহঙ্গের। যেখানেই থাকো ভালো থাকো।’ শামীমা তুষ্টি লিখেছেন, ‘ভালো থাকিস সীমানা চলেই গেলি!’ সীমানার মৃত্যুতে আরও শোক প্রকাশ করেছেন রওনক হাসান, সুষমা সরকার, জ্যোতিকা জ্যোতি, মুরাদ পারভেজ, সামিরা খান মাহি, মৌসুমী নাগ, মম মোর্শেদসহ অনেকে।

শেষ বিদায়

সীমানার মৃত্যুর পর তার মরদেহ চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয়। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন সীমানার স্বজন, সহকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীরা। এখানে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জানাজা। সবার তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান ও দোয়া করেন। দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা অভিনেত্রীকে ফুল দিয়ে শেষ বিদায় জানান। এরপর  মডেল-অভিনেত্রী রিশতা লাবণী সীমানার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শেরপুরের নকলা উপজেলার বাজারদি গ্রামে। দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × five =