স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক আমি সিরিয়াসলি নেই না: রেহমান সোবহান

রেহমান সোবহান বলেন, কোনো পাকিস্তানি মেজরের বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ কোনো বিষয় নয়। কোনো জাতির দেশ বা রাষ্ট্র ঘোষণা দিয়ে শুরু হয় না। এটা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হয়। হাজারটা দেশ আছে যেখানে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কারণ যে কেউ দাবি করতে পারে, এ ভূখণ্ড তার দেশ। তা বললেই তো হবে না। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থাকতে হবে, গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কোনো বিতর্ক আমি সিরিয়াসলি নেই না।

আজ (বৃহস্পতিবার) অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুম এবং ফেসবুক লাইভ-এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারিত ৭-৮ অক্টোবর ২০২১ “পঞ্চাশে বাংলাদেশ: অনিশ্চিত যাত্রা থেকে উন্নয়নের রোল মডেল” শীর্ষক দুদিনব্যাপী ভার্চুয়াল সম্মেলনে একথা বলেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান।

দুই দিনব্যাপী এই আয়োজনের শুরু হয় আজ (বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশ সময় ৯:৫০ মিনিটে। এতে সূচনা বক্তব্য রাখেন অনারারী সহযোগী প্রফেসর মো. আলাউদ্দিন, প্রফেসর শামস্ রহমান ও প্রফেসর তপন সাহা। এরপর মূল বিষয়ের উপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রফেসর রেহমান সোবহান। বাংলাদেশ-এর কৃষি স্বনির্ভরতা থেকে রপ্তানিমুখিতা বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, বাংলাদেশ-এর শিক্ষা: ২০৪১ রূপকল্পের প্রেক্ষিত মানবসম্পদ বিনির্মাণ নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রফেসর মুহাম্মদ জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ-এর স্বাস্থ্য সেবা: আত্মনির্ভরতা থেকে স্বাস্থ্য পর্যটন প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রফেসর মোহাম্মদ শহীদউল্লাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের জ্বালানী উৎপাদন: উন্নয়ন ও পরিবেশ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা।

রেহমান সোবহান বলেন, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার পর দেশে মানসিক এবং রাজনৈতিক অনেক রকম পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণে এটা ঘটেছিল। ফলে বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তিত হয়। তবে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনের পরে বাংলাদেশ আবার বঙ্গবন্ধুর ভিশন বাস্তবায়ন কার্যকরে সক্রিয় হয়।

উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পর বাঙালি তার আত্মপরিচয় খুঁজে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধু এ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৬৬ সালে ৬ দফা প্রণয়ন করে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ মেজরিটি পায়। বাঙালি জাতি এর মাধ্যমে ৬ দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিযে দেয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেমিনারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ছিল, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে কৃষিকে প্রাসধান্য দিতে হবে। বর্তমানে সে ভিশন বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ফলে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উপচে পড়া ঝুড়ির দেশে পরিণত হয়েছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। ধান উৎপাদনে আমরা তৃতীয়। ড্রাগন, স্ট্রবেরি, খেজুর, আপেলের মতো অপ্রচলিত ফলও এখন দেশে ‍উৎপাদন হচ্ছে। বাণিজ্যিক কৃষিতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা ‘গোলা ধরা ধান, পুকুর ভরা মাছ’ পরিচয় আবার ফিরে পেয়েছে। বন্যা, খরা মোকাবেলা করে দেশ এখন উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশ। সবজি উৎপাদন হচ্ছে ব্যাপকভাবে। কৃষির উপর নির্ভরশীল শিল্প গড়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করতে কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। এখন সময় এসেছে কৃষিকে বহুমুখি এবং বৈচিত্রময় করার। সরকার কৃষিতে সবধরনের সহায়তা চালু রেখেছে।

মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, বিশ্বদ্যিালয়গুলো শিক্ষা দিচ্ছে কিন্তু কোনো গবেষণা করছে না। জ্ঞান তৈরিতে সহায়তা করছে না। ভোকেশনার শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। ভোকেশনাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরও বাড়াতে হবে। ভোকেশনার পড়া শিক্ষার্থীদের সামাজিক মর্যাদা উচ্চ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ আমাদের এখন প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা মুখস্ত করাকে অগ্রধিকার দেয়া হচ্ছে। নম্বর বা জিপিএ প্রাধান্য পাচ্ছে, জ্ঞান নয়। দেশের অর্থনীতি এখন তিন চাকায় চলছে। কৃষি, গার্মেন্ট এবং অদক্ষ মানবসম্পদ হলো এ তিন চাকা। চতুর্থ চাকা হতে পারে জ্ঞান।

তিনি আরও বলেন, কারণ সামনে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আসছে। আমাদের এখন প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ। সেখানে প্রয়োজন হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স, রোবোটিক্স, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং ক্লাউড কম্পিউটিং। দক্ষ জনশক্তি না থাকলে আমরা এসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকব। আমাদের এখন যা করতে হবে তা হলো মেধা যেন বাইরে চলে না যায় তা দেখা। নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষা দিতে হবে। এছাড়া প্রযুক্তি কেনা নয়, প্রযুক্তি তৈরি করতে হবে। সেমিনারে অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ‘বাংলাদেশের শিক্ষা: ২০৪১ রূপকল্পের প্রেক্ষিত,  মানবসম্পদ বিনির্মাণ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে এসব কথা বলেন।

সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী’র জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা  ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম বলেন, বাংলাদেশ প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বিগত ১২ বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করেছে। প্রাথমিক জ্বালানি বিশেষ করে গ্যাস যোগানে সংকট থাকলে এলএনজি আমদানী করা হচ্ছে ঘাটতি মেটানোর জন্য। অনুসন্ধান কাজ অব্যাহত আছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন এখন ২৫ হাজার মেগাওয়টের বেশি। সঞ্চালন ও বিতরণে যে সংকট আছে তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিনিয়োগ করা হচ্ছে। জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ নিয়ে পরিকল্পিতভাবে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। জমি স্বল্পতার বিচেনায় নেটমিটারিং এর আওতায় শিল্পের ছাদে সোলার স্থাপনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে সাফল্য আসতে শুরু করেছে। কিন্তু আজকের বিশাল জ্বালানি খাত আরো দক্ষভাবে চালিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। দেশে যেমন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে তেমনি দেশের বাইরে থাকা দক্ষ ও মেধাবি বাংলাদেশি ব্যক্তিদের কিভাবে কাজে লাগান যায় তার পরিকল্পনা করা দরকার। এজন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া ধীরে ধীরে ফসিল ফুয়েল নির্ভরতা কাটিয়ে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করা যায় তা নিয়েও কাজ হচ্ছে।

অনলাইনে অনুষ্ঠিত এই কনফারেন্সের আয়োজন করে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি, আরএমআইটি ইউনিভার্সিটি, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি, গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড, ম্যাকুয়ারি ইউনিভার্সিটি, সুগার রিসার্চ অস্ট্রেলিয়া, কুইন্সল্যান্ড হেলথের সিনিয়র শিক্ষক ও গবেষকরা এবং অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক সংগঠন ‘আমরা ক’জন-দি লিগ্যাসি অফ বঙ্গবন্ধু অস্ট্রেলিয়া ইনক।#

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nineteen − 14 =