‘১৯৭১-এর জেনোসাইডের দায় স্বীকার করাতে পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োজন হতে পারে’

মাহফুজা জেসমিন: পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত সুইডিস বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকারের মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দ্বারা সংঘটিত জেনোসাইডের দায় পাকিস্তান আদৌ স্বীকার করে নেবে কিনা তা নির্ভর করছে দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমর্থন ও চাপের ওপর। জাতীয় জেনোসাইড দিবসের প্রাক্কালে বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেন।

তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান নির্ভর করবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয়ের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমর্থন ও চাপের ওপর। এটা সম্ভব যে ভবিষ্যতে, ১৯৭১ সালের ঘটনার স্বীকৃতি এবং ক্ষতিপূরণের দিকে অগ্রগতি হতে পারে, তবে কখন বা কীভাবে এটি ঘটবে তা অনুমান করা কঠিন।’

সৈয়দ আসিফ শাহকার জন্মসূত্রে পাঞ্জাবী হলেও তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা ক্র্যাকডাউনের পর বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান ও প্রচার প্রচারণার দায়ে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারারুদ্ধ হন এবং যুদ্ধের পুরো সময়টা তিনি কারাগারে বন্দী ছিলেন। একই অপরাধে তিনি নিজ পরিবার থেকে বিতাড়িত হন এবং সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে চলে যান। বর্তমানে তিনি সুইডেনে বাস করছেন এবং বাংলাদেশ জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কাজ করছেন।

সৈয়দ আসিফ বলেন, ‘এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে,  ১৯৭১ সালের ঘটনার স্বীকৃতি এবং ক্ষতিপূরণের প্রশ্নটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি জটিল এবং সংবেদনশীল বিষয় হয়ে রয়ে গেছে। পাকিস্তান এর আগে ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে সেগুলোকে গণহত্যা বলে স্বীকার করেনি।’

তবে, তিনি বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সার্বিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের উদ্যোগ রয়েছে বলে আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, সমস্যাটি সমাধানের লক্ষ্যে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।    যেমন সংঘাতের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন প্রতিষ্ঠা করা। যাইহোক, অগ্রগতি ধীরগতিতে হয়েছে এবং ১৯৭১ সালের ঘটনা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এখনও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে।’

২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশে পাকিস্তানের পরিচালিত ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উপর একটি নৃশংস সামরিক ক্র্যাকডাউন, যা একটি বড় আকারের মানবিক সংকট এবং ব্যাপক সহিংসতা ঘটিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ঘটনাগুলি এই অঞ্চলে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখে চলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন,  এখনও দুই দেশের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সম্পর্কিত ঐতিহাসিক বিতর্ক এবং চলমান আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রি সম্মাননা’ প্রাপ্ত আসিফ শাহকার জাতীয় জেনোসাইড দিবসে বাংলাদেশের জনগণের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সেই সময়ে ঘটে যাওয়া ক্ষতি ও দূর্ভোগের জন্য আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

তিনি বলেন, জাতীয় গণহত্যা দিবসে বাংলাদেশের জনগণের কাছে, আমি ১৯৭১ সালের ঘটনার সময় যে বিপুল যন্ত্রণা ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা স্বীকার করতে চাই। বাঙালি জনগণের উপর সংঘটিত সহিংসতা ও নৃশংসতা ছিল ধ্বংসাত্মক এবং  সেই সময়ের ক্ষত এখনও অনুভূত হচ্ছে।

পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত একজন মানুষ হিসেবে, আমি স্বীকার করি যে ১৯৭১ সালের ঘটনাগুলো আমাদের দুই দেশের ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে, আমি আশাবাদি যে, সংলাপ, বোঝাপড়া এবং মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রতি অঙ্গীকারের মাধ্যমে আমরা আমাদের জাতির মধ্যে নিরাময় এবং পুনর্মিলনের দিকে কাজ করতে পারি।

বাসস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

six + 7 =