২১ মানে মাথা নত না করা

প্রভাষ আমিন: দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে ৪ বছরের মাথায় ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যে প্রতিবাদটা হয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বাঙালিরা। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা গায়ের জোরে আমাদের মুখের ভাষা বাংলা কেড়ে নিয়ে উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে এ অঞ্চলের মানুষের ত্যাগও কম নয়। কিন্তু তাদের মোহ ভাঙতে সময় লাগেনি। তারা বুঝতে পেরেছিল, ধর্ম কোনো রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হতে পারে না। ভাষা আন্দোলনেই বাঙালি চিনতে পেরেছিল নিজেদের আসল পরিচয়, জাতিসত্তাকে। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিই বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা স্ফুরিত হয়েছিল, রোপিত হয়েছিল সার্বভৌমত্বের বীজ; যা অঙ্কুরিত হয়েছিল ২৩ বছরের সংগ্রামে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আসে চূড়ান্ত বিজয়।

আসলে একুশের কাছে আমাদের অনেক ঋণ। একুশ আমাদের নিজেদের চিনতে শিখিয়েছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের পূর্বসূরীরা জীবনের মায়া না করে প্রতিবাদ না করলে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ আজ কোথায় থাকতো? বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের পঞ্চম ভাষা বাংলার কেন্দ্র কিন্তু বাংলাদেশ। বাংলা একটি ভাষা, বাংলা একটি দেশ। দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য অনেকেই রক্ত দিয়েছে, সংগ্রাম করেছে। কিন্তু আমরা আগে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, তারই ধারাবাহিকতায় এসেছে এই প্রিয় দেশ, বাংলাদেশ। বাংলা ভাষার জন্য একটি দেশ, বাংলাদেশ।

তবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিছক বাংলা ভাষা রক্ষার সংগ্রাম ছিল না। ছিল মায়ের ভাষা রক্ষার লড়াই। একুশের মূল চেতনা আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পৃথিবীর সকল মানুষের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারার লড়াইয়ের নাম একুশে ফেব্রুয়ারি। যেখানেই কোনো ভাষা বিপন্ন, সেখানেই রুখে দাঁড়াবে একুশের চেতনা। বিশ্বে ৭ হাজারের বেশি ভাষা আছে, যার অনেকগুলোই বিপন্নপ্রায়। ৭ হাজারের বেশি ভাষা থাকলেও বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ কথা বলে মাত্র ২৩টি ভাষায়। বাংলাদেশের ৯৯ ভাগ মানুষ বাংলায় কথা বললেও এই দেশে আরো ৪১টি জীবিত ভাষা আছে। একুশের চেতনা হলো এই ৪১টি ভাষাকে টিকিয়ে রাখা। কখনো এই ভাষার ওপর আঘাত এলে রুখে দাঁড়ানো। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনা হলো বিশ্বের ৭ হাজার ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা। বিশ্বের কোথাও কারো মাতৃভাষার ওপর আঘাত এলে সবাই মিলে রুখে দাঁড়ানোই একুশের চেতনা, মাতৃভাষার দিবসের অঙ্গীকার।

একুশ আমাদের ভালোবাসতে শেখায়। ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য হলেও তাতে কিন্তু উর্দুর প্রতি বিদ্বেষ ছিল না। একুশের চেতনা নিজেদের অধিকার আদায়ের এবং সবার ন্যায্য অধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর। কেউ যেন বঞ্চিত না হয়, কারো ন্যায্য অধিকার যেন কেউ জোর করে কেড়ে নিতে না পারে। একুশ আমাদের জোর গলায় কথা বলতে শিখিয়েছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে।

শুরুতেই যে বললাম, একুশের কাছে আমাদের অনেক ঋণ। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পরও কি আমরা সেই ঋণের কানাকড়ি শোধ করতে পেরেছি বা শোধের চেষ্টা করেছি? ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা একমাসের জন্য বাঙালি হওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করি। আমাদের ইংরেজিপ্রেম ভুলে থাকার চেষ্টা করি, সর্বস্তরে কেন বাংলা ভাষা চালু হয়নি তা নিয়ে গলা ফাটাই, বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার তাগিদ অনুভব করি। কিন্তু বছরের বাকি এগারো মাস সব ভুলে যাই।

আমি বলছি না, ইংরেজিকে ঝেটিয়ে বিদায় করে সর্বস্তরে বাংলা চালু করে ফেলতে হবে। সেটা আত্মঘাতী হবে, ভিন্ন ভাষার প্রতি বিদ্বেষ আমাদের কেবলই বিচ্ছিন্ন করবে। বাঙালি মুসলমান একসময় ইংরেজি ভাষা না শিখে পিছিয়ে পড়েছিল। তেমন যেন না হয়। তবে অবশ্যই আগে হবে বাংলা ভাষা শিক্ষা, তারপরে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া। বাংলা দিয়েই লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে, তারপর বিশ্বজয়।

আমাদের অনেকেই সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াই। তারা যখন ফটফট করে ইংরেজি বলে, গর্বে আমাদের বুক ফুলে যায়। কিন্তু বাংলা বলতে গেলেই তাদের মুখে রাজ্যের জড়তা। ব্রিটিশরা এ দেশ শাসন করতে এসে প্রয়োজনের তাগিদে কিছু বাংলা শিখেছিল। এখনও গল্প উপন্যাসে ‘টোমাকে আমার বালো লাগে’ ধরনের বাংলিশ দেখা যায়। ব্রিটিশরা চলে গেছে ৭৫ বছর আগে। কিন্তু সেই বাংলিশ এখনও যায়নি। আমাদের সন্তানদের মুখে, এফএম রেডিওতে আবার যেন ফিরে এসেছে, ‘টোমাকে আমার বালো লাগে’। এই বাংলিশই নাকি এখন চলতি হাওয়া। আমাদের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের উত্তরসূরীরা এখন ইংরেজিতে গল্প-কবিতা লেখে। এটা যে ভুল, সেটা তো শত বছর আগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।

সর্বস্তরে বাংলা চালুর প্রবণতায় আমরা যদি সব সাইনবোর্ড বাংলায় লিখি, তাহলে পর্যটকরা বাংলাদেশকে চিনবে কিভাবে? বিদেশে গিয়ে স্থানীয় ভাষায় সাইনবোর্ড দেখলে আমরা যেমন বিরক্ত হই, বিদেশিরাও তো বাংলাদেশে এসে বিরক্ত হবে। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে হবে অন্তর থেকে। ভালোবাসাটা হতে হবে অনুভবের, দেখনদারির নয়।

একুশ আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। প্রতিবাদ মানে সব অন্যায়ের প্রতিবাদ, বেছে বেছে নয়। নির্বাচন ভালো না হলে প্রতিবাদ করতে হবে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে হবে, আইনের শাসন না থাকলে প্রতিবাদ করতে হবে, দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে হবে, টাকা পাচারের প্রতিবাদ করতে হবে, আন্দোলনের নামে কেউ সহিংসতা চালালে প্রতিবাদ করতে হবে, কেউ ভোটের হিসেবে যুদ্ধাপরাধী-সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপস করলে প্রতিবাদ করতে হবে।

একুশে আমাদের চিৎকার করতে শিখিয়েছে, জোর গলায় কথা বলতে শিখিয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে পাওয়া পবিত্র সংবিধানেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু মতপ্রকাশের বদলে মুখ বন্ধ করার সংস্কৃতি আজ প্রবল। এটার জন্য সরকার যতটা না দায়ী তারচেয়ে বেশি দায়ী আমরা। নানারকম সুবিধা নিয়ে, আপস করে করে আমরাই আমাদের কণ্ঠগুলো ভোতা করে ফেলেছি। আমার কাছে একুশ মানেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। আমার কাছে একুশ মানেই গণতন্ত্রের জন্য, সুশাসনের জন্য, সত্যের জন্য সংগ্রাম। আমার জন্য একুশ মানেই মাথা নত না করা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: প্রচ্ছদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 + thirteen =