অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে: জ্বালানি সেক্টর সংস্কার

সালেক সুফী

কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে জানিনা। ১৫ বছরে সবাইকে বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় আনার চটকদার রাজনৈতিক স্লোগানের আড়ালে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে স্বেচ্ছাচার আর সীমাহীন দুর্নীতির কারণে সৃষ্ট মহাসংকটের খুব একটা কুল কিনারা করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো জ্বালানি সংকটে, শিল্পকারখানা গুলো তীব্র গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটে ন্যূব্জ হয়ে আছে।

সরকারি সংস্থাগুলো বিপুল বকেয়ার দায়ে দেউলিয়া হবার উপক্রম, অপরিকল্পিত ভাবে মেগা প্রকল্প স্থাপনের জন্য দেনার দায় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার, দেশীয় জ্বালানি কয়লা বিষয়ে উদ্যোগ নেই, গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়নে উদ্যোগ হলেও সেগুলো থেকে সাফল্য আসতে সময় লাগবে, জ্বালানি (কয়লা, গ্যাস, তরল  জ্বালানি) আমদানির পযাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করতেও সমস্যা।

ডিসেম্বর ২৪ থেকে জানুয়ারী ২৫ শীতের সময় চাহিদা কম থাকায় কোন রকম উৎরে যাবে, কিন্তু মহা সংকট শুরু হবে ফেব্রুয়ারির মাঝ সময় থেকে নিবিড় সেচ মৌসুম শুরু হলে। মার্চ থেকে শুরু রমজান। আর তৎপরবর্তী গ্রীষ্ম মৌসুমে তীব্র বিদ্যুৎ জ্বালানি সংকট এড়ানো যাবে না।

বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা গ্রিড নন গ্রিড মিলিয়ে ৩০,০০০ মেগাওয়াটের বেশি কিন্তু জ্বালানি সংকট এবং অন্যানো সীমাবদ্ধতার কারণে ১৫,০০০ হাজার মেগাওয়াট নিরবচ্ছিন্ন ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। বিশাল সংখ্যক বিদ্যুৎ প্লান্ট বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়।

দুর্নীতির কারণে বিদ্যুৎ সঞ্চালন এবং বিতরণ অবকাঠামোর অনেক প্রকল্প সেট হস্তিটিতে পরিণত হয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য গ্যাস সঞ্চালন অবকাঠামোর ক্ষেত্রেও।  এগুলোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি ছিল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নিজেই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, ছিলেন তার বিতর্কিত জ্বালানি উপদেষ্টা, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী।

সরকার কিছু ভালো কাজ করেছে। দ্রুত জ্বালানি বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ আইন ২০১০ (কালা কানুন) কার্যকারিতা স্থগিত করে এই আইনের অধীনে আলোচনারত সব নতুন প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। কিছু সত্যিকারের জরুরি প্রকল্প বাতিল হওয়ায় নতুন করে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে  চালু অন্তত দেড় থেকে দুই বছর পিছিয়ে যাবে। তবুও স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা সৃষ্টির জন্য এগুলো বাতিল করা সমর্থন যোগ্য।

আরেকটি সঠিক কাজ হয়েছে বার্ক এক্টের সংশোধনী বাতিল করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে পূর্ণ ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া।বার্কে সজ্জন ব্যাক্তিকে চেয়ারম্যান করার পর নতুন সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর কয়েকটিতে শীর্ষ পর্যায়ে কিছু পরিবর্তন করা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি বহাল আছে।

পেট্রোবাংলা কোম্পানি সমূহের পরিচালক মণ্ডলীতে পরিবর্তন হলেও গুণগত পরিবর্তন কতটা হয়েছে সময়ই বলে দিবে। জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সেক্টরের দুর্নীতির বিষয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালিখি হলেও এযাবৎ কোনো দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় আনা  হয়নি।

পেট্রোবাংলা ২০১০-২০২৪ জ্বালানি আহরণ, উন্নয়নে বার্থ হয়েছে নিরংকুশ আমলা নিয়ন্ত্রণের কারণে। অধিকাংশ চেয়ারম্যান, পরিচালক মন্ডলী জ্বালানি সেক্টরকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন ছিল না। তাই না পেরেছে কয়লা উত্তোলন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে, না করতে পেরেছে প্রয়োজন মাফিক গ্যাস উত্তোলন করতে।

সাগরে গ্যাস উত্তোলনে কিছুই হয়নি ১৫ বছরে। পরিণতি ৪২০০-৪৫০০ এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ২৮০০ এমএমসিএফডি। ঘাটতি বিপুল ১৪০০-১৫০০ এমএমসিএফডি। এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রেও ব্যার্থতা।  গ্যাস সেক্টরে ব্যাপক সিস্টেম লস নামের চুরি।

আদানির ঝাড়খন্ড কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির একপেশে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি নিয়ে কি করা যায় সেটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকার। বিপুল ব্যায়ে বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কখন কিভাবে গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করবে এখনো নিশ্চিত নয়।

ডিসেম্বর মাসে বঙ্গোপসাগরে গ্যাস তেল অনুসন্ধানের জন্য দরপত্র জমা দানের সময়সীমা। বিদ্যমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ঝুঁকি নিতে কতটা আগ্রহী হবে সন্দেহ আছে। একই সঙ্গে নতুন করে এলএনজি আমদানির জন্য ভাসমান টার্মিনাল এবং ল্যান্ড বেসড গ্রিড সংযুক্ত সোলার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের দরপত্রে কি  ধরনের সাড়া  দেখতে হবে। ভু রাজনৈতিক চাপে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে সন্দেহ আছে।

২০২৫ শুরু হতেই সরকার নির্বাচন নিয়ে চতুর্মুখি চাপে পড়বে। মার্চ এপ্রিলের জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট শুরু হলে সরকার কিন্তু বিপদে পড়বে।  সরকারের উচিত গ্যাস বিদ্যুৎ ব্যাবহারে কৃচ্ছতা সাধনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, চুরি-অপব্যবহার রোহিত করা। সাগর চুরির কিছু প্রমাণিত ঘটনার হোতাদের বিচারের আওতায় আনা। এই কাজগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাড়া কেউ করতে পারবে না.

করার ছিল অনেক কিছু, করেছে বেশ কিছু, বাকি আছে আরো অনেক কিছু।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen + 11 =