মাধবী লতা
দেশের শোবিজ অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম তারিন জাহান। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই সবার মন জয় করে আছেন তিনি। নাচ-গান করে আর ছোট-বড় পর্দা সবখানেই অভিনেত্রী হিসেবে আলো ছড়িয়েছেন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে গতিময় তারিনের শোবিজ ক্যারিয়ার। সর্বশেষ ২০২৩ সালে মুক্তি পায় তারিন অভিনীত ‘১৯৭১: সেই সব দিন’। হৃদি হকের পরিচালনায় এ সিনেমায় প্রশংসিত হয় তারিনের অভিনয়।
অনেকদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এবার কলকাতার সিনেমায় দেখা যাবে তারিনকে। সব জল্পনা কল্পনা শেষে কলকাতার সিনেপর্দায় হাজির হলেন তিনি। সম্প্রতি টালিউডে অভিষেক হয়েছে তারিনের। ২৬ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছি তারিনের প্রথম টালিউড সিনেমা ‘এটা আমাদের গল্প’। সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন অভিনেত্রী মানসী সিনহা।
দুই বয়োজ্যেষ্ঠের প্রেমের গল্প নিয়ে সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত। কলকাতার বাঙালি ও পাঞ্জাবি পরিবারের দুই প্রবীণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় ভালো লাগা। ভালো লাগা রূপান্তর হয় প্রেমে। সেই প্রেমে বাধা হয়ে আসে সমাজব্যবস্থা। ছক ভাঙা এমন এক সম্পর্কের গল্প নিয়ে এ সিনেমা। এতে প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও অপরাজিতা আঢ্য। অপরাজিতা আঢ্যর ছেলের বউয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তারিন।
বেশ ভেবে চিন্তেই ‘এটা আমাদের গল্প’ সিনেমায় অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নেন তারিন জাহান। সিনেমাটি নিয়ে নানা সময় গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। জানিয়েছেন তার অনুভূতির কথা। এই সিনেমার গল্প প্রসঙ্গে তারিন বলেন, বউ-শাশুড়ির ভালোবাসা, রাগ-অভিমান নিয়েই গল্প। কলকাতায় ‘বেলা শেষে’ সিনেমায় যেমন পারিবারিক বন্ধনের গল্প দেখা গেছে, তেমনটা এ সিনেমাতেও দেখেছেন দর্শক।
তারিন কীভাবে জড়িয়েছিলেন ‘এটা আমাদের গল্প’ সিনেমার সঙ্গে? কীভাবে পরিচয় হয়েছিল পরিচালক মানসীর সঙ্গে? সেসব প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন তারিন। তারিন বলেন, ‘পরিচালক মানসী সিনহার সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। তিনি একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন একটি সেমিনারে অংশ নিতে। তখন সিনেমা নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। কলকাতা ফিরে গিয়ে ফোনে সিনেমার গল্প শুনিয়েছিলেন তিনি। গল্প শুনে সম্মতি জানাই।’ এক গণমাধ্যম তারিন জাহান বলেন, ‘করোনার ঠিক আগে আগে সিনেমাটির শুটিং করেছিলাম। তখন ভারত করোনা নিয়ে বেশ সতর্ক ছিল, অনেকে মাস্ক পরা শুরু করেছে। আমরা বেশ ভয়ে ভয়ে শুটিং করেছিলাম। এই বুঝি করোনা আক্রান্ত হই, এমন সংশয় কাজ করতো সব সময়। শুটিং শেষে দেশে ফেরার পর দীর্ঘদিন প্রডাকশনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। সত্যি বলতে, করোনায় তো দুই বছর এমনিতে চলে গেল। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এর মধ্যে নির্বাচনও গেল। সম্প্রতি মানসী সিনহা দিদি যখন জানালেন ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে। খবরটি শোনার পর অন্য রকম স্বস্তি লেগেছে। ছবির গল্পটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। দর্শকদেরও ভালো লাগার কথা। ছবিতে দেখা যাবে, আমি বাংলাদেশের হিন্দু পরিবারের মেয়ে। আমার বিয়ে হয় কলকাতার এক বনেদি পরিবারে। অপরাজিতা দিদি আমার শাশুড়ি। বউ-শাশুড়ির ভালোবাসা, রাগ-অভিমান নিয়েই গল্প। কলকাতায় এর আগে ‘বেলা শেষে’ নামের একটি ছবি হয়েছিল। পারিবারিক বন্ধনের গল্প ছিল ছবিটিতে। এটাও সেই রকম। বলতে পারেন গল্পটির কারণেই ছবিটিতে যুক্ত হওয়া। ‘এটা আমাদের গল্প’ ছবির পরিচালক মানসী সিনহা নিজেই একজন গুণী অভিনেত্রী।
নন্দিত অভিনেত্রী তারিনের পুরো নাম ইয়াসমিন তাজরীন জাহান তারিন। ১৯৮৫ সালে জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিভা অন্বেষণ নতুন কুঁড়িতে অভিনয়, নাচ এবং গল্প বলা প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। তখন থেকেই তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে ছোট পর্দায় কাজ করতে শুরু করেন।
তারিন ওস্তাদ হাসান ইকরাম উল্লাহ্র কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন। এই অভিনেত্রী ও গায়িকা ২০১১ সালে ‘আকাশ দেবো কাকে’ শিরোনামে প্রথম একক অ্যালবাম বের করেন। সেখানে ১০টি গানের মধ্যে ৪টি দ্বৈত গান ছিল। গানগুলো তারিন কলকাতার রাঘব চ্যাটার্জি ও রূপঙ্কও বাগচী এবং বাংলাদেশের ইবরার টিপু ও তপন চৌধুরীর সাথে গেয়েছিলেন। তারিন একটি নাটকে টাইটেল সংগীতও গেয়েছেন। তিনি একটি বাংলা চলচ্চিত্রে শাবনূরের হয়ে কণ্ঠ দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি দুটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রে প্রিয়াংকা ত্রিবেদী এবং প্রিয়াংকা ব্যানার্জীর হয়ে কণ্ঠ দিয়েছেন।
ছোটবেলায় গান শুনলেই তিনি নাচতেন। আরো ছিল মিমিক্রি করার অভ্যাস। নাচের প্রতি আগ্রহ দেখে মা তাহমিনা বেগম সাড়ে তিন বছরের তারিনকে ভর্তি করিয়ে দেন তপন দাসগুপ্তার কাছে। ১৯৮২ সালে তিনি নাচ শেখা শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে তারিন প্রথম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন। ধীরে ধীরে কুমিল্লায় তিনি পরিচিতি পান। বিভিন্ন অনুষ্ঠান হলেই ডাক পড়তো শিশু শিল্পী তারিনের। তিনি বেড়ে উঠেছেন এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। মা তাহমিনা বেগম বকুল ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। পাঁচ বোনের মধ্যেই তিনি ছিলেন সবার ছোট। সব বোনদের কাছে পেয়েছেন আদর এবং ভালোবাসা।
তারিন জাহান অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক হলো এইসব দিনরাত্রি, সংশপ্তক, ফুল বাগানের সাপ, কথা ছিল অন্যরকম, ইউ টার্ন, মায়া, হারানো আকাশ, রাজকন্যা, সবুজ ভেটে, অগ্নিবলাকা ইত্যাদি। তিনি অভিনয় করেছেন বেশকিছু টেলিফিল্মে। তারিন ‘পিরিত রতন পিরিত যতন’ এবং ‘কাজলের দিনরাত্রি’ নামের দুটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তিনি ‘সকাল সন্ধ্যা’ ধারাবাহিক নাটকে প্রধান ভূমিকায় প্রথম শিশু চরিত্রে অভিনয় করেন। তারপর তিনি ১৯৮৮ সালে শহীদুল্লা কায়সারের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ধারাবাহিক নাটক ‘সংশপ্তকে’ শিশু চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি প্রথম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তৌকির আহমেদের সাথে ‘কাঁঠাল বুড়ি’ নাটকে, যেটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট চ্যানেল এটিএন বাংলায় প্রচারিত প্রথম নাটক।
তারিন ও তার দুই বোন শামিমা নাহরিন জাহান তুহিন এবং নাহিন কাজীর মালিকানায় ‘তানা’ নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বর্তমানে তারিন নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘এ নিউ ট্রি এন্টারটেইনমেন্ট’-এর সাথে যুক্ত। উপস্থাপক হিসেবেও বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন তারিন। নানা সময় বিশেষ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে তাকে পাওয়া গেছে।
এবার ঈদে কাজ করতে পারেননি তারিন। ঠান্ডা লেগেছিল তার। তারিন বলেন, গলাটা একদম বসা ছিল। চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছিলেন তিন সপ্তাহ কথা না বলতে। এই সময়টায় ফোনটা পর্যন্ত বন্ধ রেখেছিলাম। ফলে কেউ কোনো কাজের প্রস্তাবও দিতে পারেননি। এবার ঈদে হানিফ সংকেতের নাটক ‘আলোকিত অন্ধকার’ ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি। আসলে এই নাটকটি করার সময়ও আমার গলা ভাঙা ছিল। খুব কষ্টে সংলাপগুলো বলেছিলাম। এখন মোটামুটি সুস্থ আছি। শিগগিরই নতুন কাজ নিয়ে মেতে উঠুক তারিন। এই শুভকামনা।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি