সালেক সুফী
একদশকের বেশি সময় বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ওডিআই সিরিজে অপরাজিত ছিল। এবার সেন্ট কিট্স্ অনুষ্ঠিত তিন ম্যাচের ওডিআই সিরিজের সবগুলো হেরে ধবল ধোলাইয়ের লজ্জা বরণ করলো বাংলাদেশ জাতীয় দল। কাল শেষ ম্যাচটিতে ৫ উইকেট হারিয়ে ৩২১ রান করে জয়ের আশা জাগিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের অভিষিক্ত তরুণ আমির জাঙ্গুর ৮৩ বলে অপরাজিত মারকুটে ১০৪ রান এবং গুডাকেশ মতিকে (৪৪*) সঙ্গী করে বাংলাদেশের বিশাল স্কোরকে অনায়েসে অতিক্রম করে ৪ উইকেটের ম্যাচ জয় এবং সিরিজ ধবল ধোলাই এনে দেয়। ক্রমাগত পরাজয়ের বৃত্তবন্দী হয়ে শেষ হয় বাংলাদেশ জাতীয় দলের ২০২৪ মিশন। বয়সভিত্তিক দল এমনকি মেয়েদের দল যেখানে বাংলাদেশকে আশা জাগাচ্ছে সেখানে জাতীয় ক্রিকেট দলের বর্ণহীন রূপ ক্রিকেট প্রশাসনের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওডিআই সিরিজের প্রথম ম্যাচে ২৯৪ করে হেরে যাওয়ার পর আফসোস ছিল কেন আরো ২৫-৩০ রান হলো না। দ্বিতীয় ম্যাচ বাংলাদেশ মেরুদন্ড বিহীন ব্যাটিং করেছে। কাল যখন ভালো ব্যাটিং করে ৩২১ রান করেও হেরে গেলো বাংলাদেশ তখন বলতেই হবে বাংলাদেশের ম্যাচ পরিকল্পনায় নিঃসন্দেহে ঘাটতি আছে।
কাল ইনিংসের সূচনায় আগের দুই ম্যাচে ভালো ব্যাটিং করা তানজিদ তামিম আউট হবার পরক্ষনেই বিদায় নেয় দারুন রান খরায় ভুগতে থাকা লিটন কুমার দাস। এই সিরিজের তিনটি ম্যাচ শুধু নয় ওডিআইতে বেশ কিছু দিন যাবৎ নিজেকে হারিয়ে খুঁজে চলেছে লিটন। এমন একজন ব্যাটসম্যানকে ক্রমাগত ব্যার্থতার পরও কেন বারবার সুযোগ দেয়া হচ্ছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয়। টপ অর্ডারে বার বার বার্থ হবার পর কেন এই সিরিজে বিকল্প কাউকে লিটনের জায়গায় সুযোগ দেয়া হলো না প্রশ্ন জাগতেই পারে। ব্যার্থ লিটনকে আবার টি ২০ সিরিজে অধিনায়ক করা হয়েছে।
৯ রানে দুই উইকেট হারানোর পর বাংলাদেশের ইনিংসের গতিপথ পাল্টে দেয় তৃতীয় উইকেট জুটিতে অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ (৭৭) আর সৌম্য সরকারের (৭৩) ১৩৬ রানের জুটি। বাংলাদেশের বড় অর্জন সৌম্য সরকারের স্বমূর্তিতে প্রত্যাবর্তন। একই সঙ্গে অধিনায়ক মিরাজ টপ অর্ডারে ব্যাটিং করে নিয়মিত নিজেকে প্রমান করছে। বিশেষত এই সিরিজে মিরাজ মুশফিকের অনুপস্থিতিতে নিজের দায়িত্ব ভালো ভাবে পালন করেছে। কাল কিন্তু মেহেদী ম্যাচ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে স্ট্রাইক রোটেট করে খেলেছে। আট চার আর দুই ছয়ে সাজানো ৭৩ বলে ৭৭ রানের ইনিংসটি রান আউটে কাটা না পড়লে হয়তো বাংলাদেশ ইনিংস আরো বিস্তৃত হতে পারতো। বাংলাদেশের স্বস্তির কারণ মেধাবী সৌম্য সরকারের আগ্রাসী রূপে ফিরে আসা। ৭৩ বলে ৭৩ রান করা সৌম্যর ইনিংসটিও বড় হতে পারতো। যাহোক সৌম্যর ফর্ম ফায়ার পাওয়া এবং তানজিদ তামিমের পরিণত হয়ে ওঠা বাংলাদেশের জন্য শুভ লক্ষণ। কাল কিন্তু আফিফ অথবা রিয়াদকে প্রমোট করার সুযোগ ছিল। লিটন হয়তো ৫ -৬ নম্বরে ভালো খেলতেও পারতো। হয়তো টি ২০ সিরিজের কথা মাথায় রেখে তা করা হয়নি। কাল আবারো নিজের ছন্দে খেলে ৬৩ বলে অপরাজিত ৮৪ রানের আরো একটি আলোক উজ্জ্বল ইনিংস উপহার দিয়ে বর্ষীয়ান মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ প্রমান করলো এখনো বাংলাদেশ দলে রিয়াদের বিকল্প কেউ গড়ে উঠেনি। উদীয়মান জাকের আলীর অপরাজিত ৬২ রানের ইনিংস প্রমান করেছে দলে লেট্ মিডল অর্ডারে ওর স্থান পাকাপোক্ত হয়ে উঠছে। রিয়াদ – জাকের আলীর অপরাজেয় ১৫০ রানের জুটি ষষ্ট উইকেট জুটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ছিল নতুন মাইল ফলক। রিয়াদের ইনিংসের ৪ টি ছক্কা ওডিআই ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে ১০৭ ছক্কার নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। নিজের ক্রিকেট জীবনের গধূলি লগ্নে মাহমুদুলহ রিয়াদের এভাবে জ্বলতে থাকা দেখে আফসোস হয় রিয়াদকে হয়তো পরিমিত ভাবে ব্যবহার করেনি বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট।
৩২১/৫ উইকেট ইনিংস শেষ করার পর অনেকেই ভেবেছিলেন কাল হয়তো ম্যাচ জয় করে ধবল ধোলাই এড়াতে পারবে বাংলাদেশ। ব্রেন্ডান কিং, আলিক এথানেজ, শাই হোপকে ৩২ রানের মাঝে ফিরিয়ে আশার প্রদীপ জেলেছিলো বাংলাদেশ। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে দেয় প্রথমে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসাবে বিকশিত হতে থাকা কেসি কার্টি (৮৮ বলে ৯৫ রানের ইনিংস খেলে)। কাল এই ম্যাচে অভিষেক হয় ত্রিনিদাদের বাম হাতি উইকেট রক্ষক ব্যাটসম্যান আমির। জাঙুর ৮৩ বলে অপরাজিত ১০৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে আমির ম্যাচটি বাংলাদেশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ধবল ধোলাই নিশ্চিত করে।
সিরিজ ধবল ধোলাই। হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষত যখন দশকেরও বেশি সময় পর ওডিআই সিরিজ পরাজয় হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে আইসিসি ওডিআই রাংকিংয়ে তলানিতে নেমে যাওয়া। সিরিজে যা কিছু পজিটিভ সেইগুলোকে পুঁজি করে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের অন্যতম দুর্বলতা উইকেটে থিতু হয়েও ম্যাচ জয়ী ইনিংস খেলতে ব্যর্থ হয়। তিন তিনটি ম্যাচে লেট মিডল অর্ডারে বড় ইনিংস খেলে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ আবারো প্রমান করেছে বাংলাদেশের অনিশ্চিত টপ অর্ডারে রিয়াদ ৪-৫ নম্বরে ব্যাটিং করার যোগ্যতা রাখে। এই সিরিজে সেই সুযোগ পেলে অন্তত একটি শত রান হতেও পারতো। সেই সঙ্গে হয়তো বাংলাদেশ একটি ম্যাচ জয়ের পুঁজি পেতো।
যাহোক যা হয়নি তা নিয়ে হা হুতাশ করে কি ফায়দা? যা অর্জিত হয়েছে সেটি পুঁজি করে এগিয়ে যেতে হবে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল পেশাদারি দক্ষতায় তিনটি ম্যাচ যথা প্রযোজ্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করে জিতে নিয়েছে। দেখতে হবে টি ২০ সিরিজে বাংলাদেশ কি করতে পারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনেক খেলোয়াড় কিন্তু বিশ্ব জুড়ে টি ২০ ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা। বাংলাদেশকে নিজেদের সেরাটা দিয়েই প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে হবে। সাকিব আল হাসানকে কিন্তু দারুণভাবে মিস করবে বাংলাদেশ।