অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে বৈশ্বিক সহযোগিতা দরকার

মুশফিকুর রহমান

২২-২৫ এপ্রিল  ঢাকায় ‘ন্যাপ এক্সপো ২০২৪’ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ‘ইউএনএফসিসিসি’ এর ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের নবম অনুষ্ঠান এ বছর ঢাকায় হলো। বৈশ্বিক পরিসরে জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী অভিঘাত মোকাবেলায় বিপদাপন্ন দেশগুলোর প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ, উন্নয়ন অংশীদারগণ পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করবার লক্ষ্যে প্রতিবছর ‘ন্যাপ এক্সপো’ সম্মেলনে মিলিত হন। জাতিসংঘের ‘ইউএনএফসিসিসি’ ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বার্ষিক এ সম্মেলন আয়োজন করে আসছে। প্রথম ‘ন্যাপ এক্সপো’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল জার্মানির বন নগরীতে; অষ্টম ন্যাপ এক্সপো ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে চিলি’র সান্তিয়াগোতে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২ এপ্রিল ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাপ এক্সপো ২০২৪ উদ্বোধন করেন। এবারের সম্মেলনে ১০২টি দেশের প্রায় ৩৮৩ প্রতিনিধি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, স্বেচ্ছাসেবক, উন্নয়ন অংশীদার ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিগণ অংশ নিয়েছেন। সম্মেলনে বিশেষজ্ঞগণ জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন দেশ কী ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন, পরিবর্তিত বাস্তবতার সাথে অভিযোজিত হবার জন্য কী কী কৌশল প্রণয়ন করেছেন এবং তা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবেলা করছেন তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলার আর্থিক, কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা সামর্থ্য ও তার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার জাতীয় অভিজ্ঞতা বিনিময়ে ‘ন্যাপ এক্সপো’ একটি অনন্য ফোরাম। ২০১০ সালের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে ইতিপূর্বে সিদ্ধান্ত হলেও এখন অবধি মাত্র ৫৪টি দেশ (বাংলাদেশ সহ) জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্পন্ন করে তা ইউএনএফসিসিসিতে পেশ করেছে। সে বিবেচনায় জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা (বাংলাদেশ ইউএনডিপি’র সহায়তায় ২০২২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ২০২৩-২০৫০ প্রণয়ন করেছে) ন্যাপ এক্সপো ২০২৪ এ অংশগ্রহণকারী অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়। প্রণীত জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে সম্মেলনের অনেক প্রতিনিধি সে অভিজ্ঞতা শুনতে আগ্রহী ছিলেন।

বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিজনিত বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। যদিও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের (মানব সৃষ্ট) ইন্ধন যোগান দেওয়ার বিবেচনায় বাংলাদেশের দায় নেহায়েৎ অনুল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান অনন্য; সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেশের সিংহভাগ ভূ-ভাগের উচ্চতা অতি সামান্য। বাংলাদেশে অতি ঘন বসতির কারণে বিশাল জনগোষ্ঠি সমুদ্র উপকূল ও নদী অববাহিকায় গাদাগাদি বসবাসে বাধ্য হয়। এদেশে বনভূমির আচ্ছাদন মাত্র ১৫.৫৮%। দ্রুত নগরায়ন এবং অন্যান্য কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি, বনভূমি বিলুপ্ত হচ্ছে। ২০০১-২০২৩ সময়কালে বাংলাদেশের প্রায় ২৪৬,০০০ হেক্টর বনভূমি বিলুপÍ হয়েছে। নদী ভাঙ্গনে হারিয়ে গেছে বিশাল কৃষি জমি। সমুদ্রপৃষ্ঠের ক্রমাগত স্ফিতির কারণে উপকূলের প্রায় ১৭টি জেলায় কৃষি জমিতে এবং ভূগর্ভের পানির সঞ্চয় আধারে লবণাক্ততা বাড়ছে। দেশের আবহাওয়ার দ্রুত এবং অস্থির পরিবর্তন কৃষি ও জীবিকাকে বিপন্ন করছে। অসময়ের বন্যা, ঝড়, প্রলম্বিত তাপ এবং শৈত্যপ্রবাহ কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। জীববৈচিত্র্য সঙ্কুচিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রোগবালাই, মহামারির প্রকোপ তীব্রতর করে তুলছে। দেশের অবকাঠামো সমূহকে বিপদাপন্ন ও ধ্বংস করছে। মানুষের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টাসমূহকে নিয়মিত চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের খাদ্য ও পানীয় জলের যে কষ্টার্জিত নিরাপত্তা বলয় তৈরি হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা চরম ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। সাম্প্রতিক উদাহরণ স্মরণ করা যাক। এ বছরের এপ্রিল ও মে মাসের দেশজুড়ে চলা ৭৬ বছরের রেকর্ড ভাঙা এবং প্রলম্বিত তাপপ্রবাহে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার সেচনির্ভর বোরো ধান ও মৌসুমী ফলের চাষ সঙ্কুচিত হচ্ছে; পোলট্রি ও গবাদি পশু, চিংড়ি সহ মাছ চাষে ব্যাপক বৈরী প্রভাব অবধারিত হয়ে উঠেছে। জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রলম্বিত তাপ প্রবাহ এবং খরা পরিস্থিতির কারণে মোট কত উৎপাদন হ্রাস ঘটেছে তার মূল্যায়নে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আবহাওয়াবিদগণ রেকর্ড দেখে গত ৭৬ বছরে বাংলাদেশে এমন চরম তাপপ্রবাহের প্রলম্বিত উপস্থিতি আগে দেখেননি বলে নিশ্চিত করেছেন। তারা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে দেশের আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তন সম্পর্কিত।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন জলোচ্ছাস, নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা বেড়ে যাবার সম্পর্ক নিবিড়। বাংলাদেশে প্রকৃতির রুদ্র রূপ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ অসংখ্য জীবন দিয়ে বারবার দেখেছে। তবে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে নির্মিত বহুতল সাইক্লোন সেন্টারগুলো গড়ে তোলা এবং সেগুলোর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার যে উদাহরণ বাংলাদেশ তৈরি করেছে, তাতে সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে মানুষ ও গবাদি পশুর জীবন কেবল নিরাপদ হয়েছে তাই নয়; উপকূল অঞ্চলের অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও নানামুখী ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সতর্কীকরণ ও তা মোকাবেলার অন্যতম বড় কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা পৃথিবীর অনেক দেশের জন্যই অনুসরণযোগ্য উদাহরণ। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব মোকাবেলা করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসলের বৈচিত্র্য, খাদ্য ও পুষ্টির নানামুখী যোগান পেতে বাংলাদেশের কৃষি গবেষণাকে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করার সামর্থ্য বহু দেশের জন্য অনুসরণীয় উদাহরণ।

এত ধরনের উদ্ভাবনী ও জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজিত কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় অভিযোজনের জন্যে বার্ষিক জাতীয় বাজেটের প্রায় ৬-৭% ব্যয় করছে। কিন্তু প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (২০২৩-২০৫০) বাস্তবায়নে চিহ্নিত ১১৩টি অভিযোজন কার্যক্রম সফল করতে ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থের প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ বছরে অন্তত ৮.৫ বিলিয়ন ডলার বা সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা গেলে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে অন্যান্যের মধ্যে দেশের অন্তত ১.১ মিলিয়ন হেক্টর কৃষি জমি রক্ষা, ৫% বৃক্ষ আচ্ছাদন সৃষ্টি, প্রায় ৪ মিলিয়ন মাছ শিকার ও মাছ চাষ নির্ভর খানা  রক্ষা পাবে। তাছাড়া, বছরে ১০.৩ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন বৃদ্ধি, ৪৩টি শহর-নগর এলাকার প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষকে বর্ধিত নগর সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। জলবায়ু  পরিবর্তনের অভিঘাতে বাধ্য হয়ে বাস্তুচ্যূত হবার হুমকিতে থাকা প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষের অভ্যন্তরীণ শরনার্থী হবার ঝুঁকি রোধ করা সম্ভব হবে।

স্পষ্ট, বাংলাদেশের একার সমস্ত ইচ্ছা এবং চেষ্টা থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতজনিত বিপন্নতা রোধে তাকে বৈশ্বিক আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ন্যাপ এক্সপো ২০২৪ এর আলোচনায় সে কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কীভাবে বাড়ানো যায়, বৈশ্বিক উৎসসমূহ থেকে প্রয়োজিনীয় আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায় সে আলোচনায় জোর দিয়েছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fourteen − 3 =